ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

আপন আলোয় মানবজমিন

জীবনের প্রথম চাকরি মানবজমিনে

আলমগীর শাহরিয়ার , কবি ও গবেষক, শিক্ষা বিষয়ে যুক্তরাজ্যে উচ্চ শিক্ষারত
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, রবিবার
mzamin

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে জীবনের প্রথম চাকরি ছিল মানবজমিনে। বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে পত্রিকা পড়ার সময় ছোট্ট একটি বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম স্টাফ রিপোর্টার নিয়োগ দেয়া হবে। আবেদন করি। লিখিত পরীক্ষা দিই। একটা প্রশ্ন ছিল- কেন সাংবাদিকতা করতে চাই? কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দুগুণসহ শীর্ষ সকল লেখক ও কবিরা গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাদের জীবনকথা জেনে মনে হয়েছিল লেখকদের সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গেই থাকতে হয়। জীবনে লেখালেখির সঙ্গে থাকতে চাই তাই সাংবাদিকতায় এত আগ্রহী।  ষাটের সাহিত্য আন্দোলনের অন্যতম কবি সাযযাদ কাদির তখন মানবজমিনের যুগ্ম সম্পাদক। মনে পড়ে, এই উত্তরটা দেখে উত্তরদাতার ব্যাপারে বেশ কৌতূহলী হয়েছিলেন। চিফ রিপোর্টার কাজলদা (কাজল ঘোষ) প্রথমদিনেই পাঠিয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘুরে এসে একটি প্রতিবেদন লিখতে।

বিজ্ঞাপন
তখন পিসিতে বাংলা অভ্রতে লিখি। বিজয় আত্মস্থ হয়নি। একদিনে বিজয়ে লেখা শিখে সুতন্নি ফ্রন্টেই প্রতিবেদন জমা দিতে হলো।
মাস্টার্স করছি একইসঙ্গে সাংবাদিকতা। রাতে অফিস করে বঙ্গবন্ধু হলের ৪১৩ নম্বর রুমে ফেরার সময় ক্যান্টিনে খাবারের সময় শেষ হয়ে যেতো। জিয়া হল আর সূর্যসেন হলের মাঝখানে ছিল একটা নার্সারি। বর্তমানে যেখানে বিজয় একাত্তর হল। তার সামনে ছোট্ট একটি পাকুড় গাছের পাশে ছিল একটি টং দোকান। প্রায় রাতেই এখানে ডিম খিচুড়ি খেয়ে হলে ঢুকতাম। অন্য হাউজে সাংবাদিকতা করা অনেক বন্ধু ও সিনিয়রদের সঙ্গে ফেরার পথে ওই টং দোকানে দেখা হতো। কিছুদিন আগে বন্ধু হাবীব হাতিরঝিলে এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বিশেষ আগ্রহ দেখে কাজলদা আমাকে প্রেস ক্লাব, বাম রাজনীতি, সংস্কৃতি, বিশেষ কোনো সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য পাঠাতেন। নির্দিষ্ট কোনো বিট ছিল না। অনেক প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী ও লেখকের সঙ্গে আলাপ ও সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগ ও সৌভাগ্য হয়েছে। এক দশকের ব্যবধানে তাদের অনেকেই আজ না ফেরার দেশে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ ও উত্থাল শাহবাগ একজন রিপোর্টার ও অংশগ্রহণকারী হিসেবে সেদিন খুব কাছ থেকে দেখেছি। ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বইমেলার প্রতিবেদন করা খুব দারুণ উপভোগ্য একটি অ্যাসাইনমেন্ট ছিল। অনেক প্রকাশক মেলায় সেদিন প্রকাশিত নতুন বইয়ের সৌজন্য কপি দিতেন। নতুন বই পেতে কার না ভালো লাগে।
মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী এদেশে অনেক তরুণকে সাংবাদিকতার হাতেখড়ির সুযোগ করে দিয়েছেন। একজন সফল সম্পাদক হিসেবে তিনি বিশ্ব রাজনীতি ও কূটনীতির অন্দরমহলের যেমন খোঁজখবর রাখেন তেমনি ঢাকা শহরে কতিপয় ভিক্ষুকরা এক রাতেই কোটি টাকার বাণিজ্য করে তারও সরজমিন প্রতিবেদন করিয়েছেন আমাদের দিয়ে। মাসে একবার অফিসের সকলকে নিয়ে বসতেন। দিকনির্দেশনা দিতেন। নিউজ কনটেন্ট নিয়ে মতামত নিতেন। জাতীয় জীবনে বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটলে তার জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নিতেন। যেমন জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর সম্পাদকের রুমে রিপোর্টারদের ডাক পড়লো। বাংলা ভাষার তুমুল জনপ্রিয় এই লেখকের মৃত্যুতে যে সারা দেশের মানুষ শোকাভিভূত হবে এবং দেশের মিডিয়ায় এ নিয়ে তুমুল আগ্রহ দেখাবে ঠিকই আন্দাজ করলেন। আমার অ্যাসাইমেন্ট ছিল বিমানবন্দরে যাওয়ার। নিউ ইয়র্ক থেকে হুমায়ূন আহমেদের লাশ আসলো। মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আহসান হাবীব, ডা. এজাজ প্রমুখের দেখা পেলাম ভিআইপি কর্নারে। বিমান ল্যান্ড করলে রানওয়েতে সাংবাদিকরা ছুটলেন। টানা ক’দিন হুমায়ূন শোকে আচ্ছন্ন ছিল মিডিয়া এবং দেশবাসী। কোনো লেখকের মৃত্যুতে দেশের সকল মিডিয়ায় লাগাতার এমন কাভারেজ আর দেখিনি। ভবিষ্যতে দেখবো কিনা জানি না। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পরও ধারাবাহিক নানা নিউজ করেছিলাম। প্রকাশিত বইয়ের রয়্যালিটির উত্তরাধিকার নিয়ে সৃষ্ট একটি বিতর্ককে ঘিরেও প্রতিবেদন ছিল। 
সব হাউজের মতো মানবজমিনেরও নিজস্ব কিছু বিশেষত্ব আছে। কোনো একদিন নিউজে রাষ্ট্রপতি লিখেছিলাম। বার্তা সম্পাদক শামীম ভাই বললেন মানবজমিন রাষ্ট্রপতি লেখে না। সবসময় প্রেসিডেন্ট লেখে। বাংলা ভাষার সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ও জনপ্রিয় ট্যাবলয়েড পত্রিকার ধারণাটি বিলেতের জনপ্রিয় প্রিন্ট মিডিয়ার আদল থেকেই নেয়া। এখানে এসে দেখলাম শীর্ষ সব দৈনিকই ট্যাবলয়েড আকারে প্রকাশ হয়।
ঢাকা শহরের নানা প্রান্তে অ্যাসাইনমেন্ট শেষে পত্রিকা অফিসে ঢুকেই প্রথম কাজ ছিল প্রতিবেদন লেখা। প্রতিবেদন জমা দিয়েই পত্রিকার ফাইলে চোখ বুলাতাম। ফাইলটা আমার কাছে দীর্ঘ সময় থাকতো। একসঙ্গে দেশের শীর্ষ সব দৈনিকে চোখ বুলানোর পুরনো অভ্যাসটি বরাবরই আনন্দের ছিল। লেখাকে নির্ভুল করা, কারও নামের বানানের ব্যাপারে যত্নশীল হওয়া সে সময়েই শেখা। যেমন আলী বানানে দীর্ঘ-ই কার ব্যবহার করা হলেও আকবর আলি খানের নামে হ্রস্ব-ই হয়। সচরাচর সাঈদ বানান দীর্ঘ-ই দিয়ে হলেও আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ব্যতিক্রম। এমন খুঁটিনাটি অনেক কিছু। প্রায় দিনই প্রুফ রিডারের চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে সংশোধন দেখতাম। এইতো মনে হয় সেদিন। অথচ চোখের পলকে এক দশক পেরিয়ে গেছে। পেছন ফিরে তাকালে সে সময়ের বার্তা সম্পাদক শামীম ভাই, কূটনৈতিক রিপোর্টার মিজান ভাই, লুৎফর ভাই, ফটো সাংবাদিক শাহীন কাওসার ভাই, মুজাহিদ সামিউল্লাহ, একসঙ্গে যোগ দেয়া সহকর্মী উৎপল রায়, ফরিদ ভাই, শর্মি চক্রবর্তী, রোকেয়া সুমি ছাড়াও ক্যাম্পাস প্রতিবেদক অনুজপ্রতিম সানাউল হক সানী ও ফররুখ মাহমুদসহ আরও অনেক প্রিয় মুখের কথাই মনে পড়ছে। কাওরান বাজারের হইচই কোলাহলে ইত্তেফাক ভবনের সামনে চা খাওয়ার আয়েশী মুহূর্তগুলোর কথাও এই দূর প্রবাস থেকে আজো মনে পড়ে। মনে পড়ে ঢাকা শহরে এক তরুণের স্বপ্ন বিহ্বল চোখে দেখা সেই যে আমার নানান রঙের দিনগুলো। সরাসরি সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত না থাকলেও এখনো জাতীয় অনেক পত্রিকায় প্রায়ই কলাম ও মতামত লেখার চেষ্টা করি। তার ভিত রচনা হয়েছিল সে সময় পত্রিকায় কাজ করার সুবাদেই। কর্মজীবনের প্রথম ভালোবাসা মানবজমিন প্রতিষ্ঠার সিকি শতাব্দী পেরিয়ে সুসাংবাদিকতায় আরও অনেক দীর্ঘ হোক প্রতিষ্ঠানটির গৌরবোজ্জ্বল পথ চলা।
[email protected]

আপন আলোয় মানবজমিন থেকে আরও পড়ুন

   

আপন আলোয় মানবজমিন সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status