আপন আলোয় মানবজমিন
পঁচিশ বছরের পথচলা
বাবর আশরাফুল হক, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, মানবজমিন
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বুধবার
প্রতিটি দিন কেটেছে টিকে থাকার যুদ্ধ করে। এভাবেই কেটে গেছে পঁচিশটি বছর। মনে হয় এই তো সেদিন। ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮। বহু গবেষণা, পরিকল্পনা ও কর্মতৎপরতার পর প্রকাশিত হয় বাংলা ভাষায় প্রথম রঙিন ট্যাবলয়েড দৈনিক মানবজমিন। দৈনিক মানবজমিন পরিবারের সকলের মধ্যেই একটি প্রশ্ন কাজ করছিল, পাঠক ট্যাবলয়েড পত্রিকাটি গ্রহণ করবে তো?
পরম করুণাময়ের অপার অনুগ্রহে পাঠক লুফে নিলো পত্রিকাটি। প্রথমদিনই মুদ্রিত হয়েছিল লক্ষাধিক কপি। দুপুর ১২টার মধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছিল সবগুলো কপি। দ্বিতীয় দিন থেকে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সব সড়কের মোড়গুলোতে বিক্রি হতে থাকে মানবজমিন। সাড়া পড়ে যায় সংবাদপত্র জগতে।
সকলের মধ্যে এ মনোভাব না থাকলে এতটা পথ চলা সম্ভব হতো না। একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা নিয়মিতভাবে প্রকাশ করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। প্রয়োজনীয় বা জরুরি সব খবরের সন্নিবেশ ঘটাতে সুশিক্ষিত জনশক্তি প্রয়োজন। তাঁদের কাজ করার জন্য কার্যালয়, প্রত্যেকটি ওয়ার্ক স্টেশনের জন্য চেয়ার ও কম্পিউটার। পত্রিকা ছাপানোর জন্য নিউজপ্রিন্ট ও ছাপাখানার খরচ। দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় পত্রিকা পৌঁছে দেয়ার জন্য বিরাট পরিবহন ব্যয়। সব মিলিয়ে প্রতি মাসে বিরাট খরচ। সব খরচ হিসাব করে প্রতি সংখ্যায় বর্তালে একটা পত্রিকার প্রতি কপির দাম আসবে প্রায় ২৫ টাকা। অথচ পত্রিকা বিক্রি থেকে আসে এর সামান্য। খরচের প্রায় সব টাকাই জোগাড় করতে হয় বিজ্ঞাপন থেকে। বর্তমানে বিজ্ঞাপন পাওয়া বা জোগাড় করা খুবই কঠিন। বিজ্ঞাপনের বাজার খুবই ছোট কিন্তু বিজ্ঞাপন সংগ্রহের প্রতিযোগিতা পীড়াদায়ক। আর সরকারি বিজ্ঞাপন পেতে হলে সরকারের সুদৃষ্টি প্রয়োজন। সবসময় সবদিক ঠিক রেখে পত্রিকা প্রকাশ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। একটু এদিক সেদিক হলেই পড়তে হয় রোষানলে। কারণে অকারণে মামলা, হামলা তো আছেই। বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানে জনগণের জানার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। জনগণকে সঠিক তথ্য জানাতে গেলেও বিপদের শেষ নেই। এ দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় অনেক গুণীজনকে পেয়েছি সহকর্মী হিসেবে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই চলে গেছেন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে; অনেকে এখন আছেন আবার অনেকে চলে গেছেন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। এদের কয়েকজনের মধ্যে শ্রদ্ধেয় আজিজ মিসির, সায্যাদ কাদির, মোশাররফ রুমী, আওলাদ হোসেন, কাজী আদর ও আবুবকর সিদ্দিক-এর কথা আমরা ভুলে যাইনি। সে স্মৃতি বিস্মৃত হওয়ার নয়। এক এক করে কেটে গেছে পঁচিশটি বছর। সুখে-দুঃখে, হাসি-কান্না বা সংকটে সবসময়ই ছিলাম মানবজমিনের সঙ্গে। কখনো এ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইনি। সবসময় মনে হয় মানবজমিনই আমার একমাত্র ঠিকানা। মনে পড়ে ২০০৬ সালে আমার পরিবার নিয়ে লন্ডনে গিয়েছিলাম বড় ভাইয়ের বাসায়। বড় ভাইয়ের আদর-যত্নে অভিভূত হয়েছিলাম। দেশে ফিরে আসার কয়েকদিন আগে বড় ভাই জাহাঙ্গীর আমিনুল হক আমাকে বললেন, ভাই তোমরা আর ফিরে যেও না।
আমি বললাম কীভাবে থাকবো, কয়েক মাস পরই তো আমার ভিসা ফুরিয়ে যাবে তখন কী হবে? ভাইয়া বললেন, তুমি চিন্তা করো না, তোমাকে ব্যবসা দিয়ে দিবো আর একটা ফ্ল্যাট কিনে দিবো। তোমার নামে ফ্ল্যাট ও ব্যবসা থাকলে তুমি আইনসিদ্ধভাবেই এদেশে থাকতে পারবে। এমন লোভনীয় প্রস্তাবের পরও আমি সেদেশে থাকিনি। আমার কন্যা কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ টরেন্টোতে পড়ালেখা করতো, সেই সূত্রে আমি দুইবার গিয়েছি কানাডা বেড়াতে। দু’বারই কানাডায় বসবাসরত আমার আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবরা সেদেশে থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে; কিন্তু পাশ্চাত্যের উন্নত ও আধুনিক জীবন ব্যবস্থা আমাকে কখনো আকৃষ্ট করতে পারেনি। কখনো আমি আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ এবং আমার প্রাণের প্রতিষ্ঠান মানবজমিন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে চাইনি। যতদিন বেঁচে থাকবো এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই থাকতে চাই। সকল সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না এ পরিবারের সঙ্গে ভাগাভাগি করে বাঁচতে চাই। মানবজমিন ছেড়ে কোথাও থাকতে চাইনি। দৈনিক মানবজমিনের রজতজয়ন্তী উৎসবে পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার কাছে কামনা, দয়া করুন মানবজমিন পরিবারের সবাইকে। বাঁচিয়ে রাখুন আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠানকে। আজকের এ মাহেন্দ্রক্ষণে দৈনিক মানবজমিন পরিবারের সকলের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি ‘এসো মিলি প্রাণের উৎসবে’।