আপন আলোয় মানবজমিন
আমরা যাদের হারিয়েছি মনে পড়ে তোমাদের
শামীমুল হক, যুগ্ম সম্পাদক, মানবজমিন
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বুধবার
একটি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়েই জন্ম মানবজমিন পত্রিকার। যার জন্ম অন্যায়ের প্রতিবাদে, তার পথচলাও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। শুরু থেকে আজও চলছে। দৈনিক মানবজমিনের প্রথম বার্তা সম্পাদক ছিলেন আহমেদ ফারুক হাসান। যার অক্লান্ত পরিশ্রম আর ভালোবাসায় মানবজমিন এগিয়ে গেছে। আজ ২৫ বছর পেরিয়েছে। ২৬শে পা দিয়েছে। দীর্ঘ এ সময়ে আমরা বেশ কয়েকজন সহকর্মীকে হারিয়েছি। এরমধ্যে অন্যতম আহমেদ ফারুক হাসান। সকাল ৯টা থেকে রাতে পত্রিকা নিয়ে ঘরে ফিরতেন।
বিজ্ঞাপন
এছাড়া প্রয়াত নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের ‘চাচার পাঁচালি’ মানবজমিন পাঠকদের কাছে ছিল ব্যাপক জনপ্রিয়। প্রয়াত আহমদ জামান চৌধুরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমৃত্যু লিখে গেছেন মানবজমিন-এ।
মানবজমিনের আরেক সহকর্মী আজিজ মিসির। ছিলেন সবার শ্রদ্ধেয়জন। যিনি শুরুতেই সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। বয়সে সবার সিনিয়র হলেও মনের দিক থেকে তিনি ছিলেন একেবারে তরুণ। মানবজমিন-এর প্রাণ। মাতিয়ে রাখতেন গোটা অফিস। ২০০৩ সালের ৩রা অক্টোবর তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান পরপারে। কিন্তু রেখে যান তার কাছ থেকে পাওয়া অনেক উপদেশ, সাহস এবং এগিয়ে চলার মন্ত্র।
আরেকজন কবি সায্যাদ কাদির। যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন ছিলেন আমাদের সঙ্গে। বাংলা ডিকশনারি হিসেবে তিনি পরিচিতি পান মিডিয়া জগতে। যেখানে কেউ আটকে যেতেন, সেখানেই তিনি। জট খুলে দিতেন বানানের, রাজনীতির কিংবা চলচ্চিত্রের খুঁটিনাটি বিষয়ের। তিনি কবি এবং বাংলার শুদ্ধ শব্দ গঠনের পণ্ডিত ছিলেন। তিনিও হারিয়ে গেলেন আমাদের মাঝ থেকে। তার চলে যাওয়া আমাদের যেমন বিরাট ক্ষতি, তেমনি ক্ষতি হয়েছে বাংলা সাহিত্যের।
কাজী আদর। মানবজমিন পত্রিকার বিশেষ প্রতিবেদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার লেখার ভক্ত ছিল দেশজুড়ে। প্রচুর পড়তেন। লিখতেন তথ্য উপাত্ত দিয়ে। যুক্তি খণ্ডন করতেন বুদ্ধি দিয়ে। তিনি নিজেকে আড়ালে রাখতে পছন্দ করতেন। আর আড়ালে রেখেই চলে গেছেন। প্রতিদিন সকালে অফিসে আসতেন। নিমগ্ন মনে লিখতেন। সঙ্গে নিয়ে আসতেন চকলেট। সহকর্মীদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। তার আদরমাখা ডাক আর মিষ্টি হাসি এখনো কানে বাজে। দীর্ঘদিনের এই প্রিয় মানুষকে হারিয়ে শোকাহত মানবজমিন পরিবার।
আওলাদ হোসেন। বিনোদন বিভাগের সিনিয়র সাংবাদিক। তিনি ছিলেন বিনোদন বিভাগের প্রাণশক্তি। একটা পিকনিক শেষ হলে আর একটির মহড়া দিতেন। অফিসে ঢুকেই বলতেন আমি এলাম। চলেন, চা খেয়ে আসি। এমন একজন প্রাণবন্ত মানুষকে আমরা হঠাৎ-ই হারিয়েছি। তার হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট আমরা ভুলিনিÑভুলতে পারবো না।
বিনোদন বিভাগের প্রধান মোশাররফ রুমী। সদা হাস্যোজ্জ্বল এক মানুষ। দিনরাত কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। মানবজমিনকে আপন করে নিয়েছিলেন। সহকর্মীদের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অসীম। ছিলেন ভীষণ অভিমানী। এ অভিমান নিয়েই তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান দুই বছর আগে।
মনোয়ার হোসেন। স্পোর্টস বিভাগের সহকর্মী ছিলেন। একদিন সকালে তার মৃত্যু সংবাদ আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় হলে থাকতেন। রাতে বুকে ব্যথার যন্ত্রণা শুরু হয়। নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। সেখানেই তিনি মারা যান। মনোয়ারের অকাল মৃত্যু মেনে নেয়া সবার জন্য ছিল কষ্টকর। কর্মচঞ্চল মনোয়ার হোসেন আমাদের স্মৃতিতে আছেন, থাকবেন।
মো. আবুল কাসেম। কম্পিউটার বিভাগে কাজ করতেন। কখনো দেখিনি তিনি রাগ করেছেন। কোনো লেখা কম্পোজের জন্য অনুরোধ করতে হয়নি। হঠাৎ একদিন শুনি সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটি ক্যান্সারে আক্রান্ত। মৃত্যুর আগের দিনও মুখের হাসিটা ম্লান হতে দেখিনি। ভালো মানুষ বেশিদিন পৃথিবীতে থাকেন না। কাসেম তারই একজন।
তৌফিক উদ্দিন। পুরান ঢাকার ছেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে যোগ দেন সাংবাদিকতায়। মানবজমিনে আওয়ামী লীগ বিট করতেন। ছিলেন সাদাসিদে এক মানুষ। তিনিও অকালে সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে পাড়ি জমান পরপারে।
এ হাই স্বপন। জাদরেল ফটো সাংবাদিক। মানবজমিন-এর শুরু থেকেই ছিলেন জড়িত। একজন সহজ-সরল মানুষ স্বপন ভাই শেষ দিকে চলে যান আমেরিকায়। সেখানে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। করা হয় বাইপাস সার্জারি। প্রায়ই খোঁজ নিতেন সহকর্মীদের। সেখানেই তিনি মারা যান।
হুসাইন জাকির। ছিলেন জাদরেল রিপোর্টার। লেখক আহমেদ ছফার ভাইপো। মানবজমিন থেকে তার সাংবাদিকতা শুরু। সহকর্মী হুসাইন জাকিরও আমাদের ছেড়ে চলে যান পরপারে।
মো. বাহেজ উদ্দিন। সিনিয়র সম্পাদনা সহকারী ছিলেন। সদা হাসিখুশি আর আহ্লাদি একজন মিশুক মানুষ। শেষদিকে পত্রিকার চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় মনোযোগ দেন। সাফল্যও পান। হঠাৎ খবর আসে বাহেজ উদ্দিন আর নেই।
আরেক সহকর্মী আবু বক্কর সিদ্দিক। কম্পিউটার বিভাগে কাজ করতেন। অল্প বয়স। ভীষণ বিনয়ী। কথা বলতেন আস্তে। মানবজমিন পরিবারের সবার প্রিয় ছিল বক্কর। আকস্মিক জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান। মানবজমিন পরিবার আছে। তার বসার চেয়ার-টেবিল-কম্পিউটার আছে-শুধু সে নেই।
হুমায়ুন কবীর খোকন। মানবজমিনের শুরুতে যোগ দেন। সবার সঙ্গে তার ছিল নিবিড় সম্পর্ক। ক’বছর পর মানবজমিন ছেড়ে অন্য পত্রিকায় যোগ দেন। কিন্তু মানবজমিনকে ভুলতে পারেন নি। তাই সময় পেলেই ছুটে আসতেন এখানে। সুখ-দুঃখের কথা বলতেন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। তার মৃত্যুতে মিডিয়াপাড়া শোকে কাতর হয়ে পড়ে।
স্টাফ রিপোর্টার হবিগঞ্জ, মো. আমির হোসেন। আইন পেশায় জড়িত আমির হোসেন মনে- প্রাণে ছিলেন একজন সাংবাদিক। একজন ভালো মানুষ। তার চলে যাওয়া আমাদের কাঁদিয়েছে। হার্টের রিং বসানোর পর সুস্থ হন। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এ মৃত্যু মেনে নেয়ার মতো নয়।
মো. আবু জাফর খান, পটুয়াখালী প্রতিনিধি, শুরু থেকে শেষদিন পর্যন্ত মানবজমিনের সঙ্গে ছিলেন। যেমন ছিলেন মিশুক তেমনি বন্ধুবৎসল ছিলেন। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যান। সেখানে হই-হুল্লোড় করেন। আনন্দ উল্লাসে মেতে থাকেন। এরই মধ্যে হার্ট অ্যাটাক করেন। ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে।
ফিরোজ আহমেদ স্বপন, নীলফামারী জেলা প্রতিনিধি। ঢাকায় আসতে ভয় পেতেন। জীবনে মাত্র একবার এসেছিলেন মানবজমিন পত্রিকা অফিসে। তা-ও দুজনকে সঙ্গে নিয়ে। মানবজমিন পরিবারের কেউই তাকে দেখেন নি। কথা হতো ফোনে। নম্র ও বিনয়ী মানুষটি খুব অল্প বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে।
শাহনেওয়াজ জাহান, সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি ছিলেন। তার চেহারা দেখে মনে হতো তিনি খুব রাগী। মুখোমুখি দাঁড়ালে মনে হতো একটা শিশু। রাগ করতে জানতেন না। এসে বলতেন, একটা ছবির বিশেষ দৃশ্যে অভিনয় করতে এসেছি। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানÑ এটা তিনি উচ্চারণ করতেন গর্বের সঙ্গে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তিনি অকালে চলে গেলেন।
এসএম ওহাব আলী। ছিলেন গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি। একজন নিভৃতচারী মানুষ। নিউজ পাঠিয়ে খোঁজ নেননি। তদবির করেন নি। কিন্তু নিউজ প্রকাশিত হলে ফোন করে বলতেন, ভাইয়া নিউজ পেয়েছি। পত্রিকা ভালো চলছে। ক্যান্সার তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আমাদের মন থেকে তাকে সরাতে পারে নি।
সেলিম রেজা। পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলা প্রতিনিধি ছিলেন। ঢাকায় ২-১ মাস পর পরই আসতেন। একজন ভদ্র, শান্ত ছেলের মতো বসে থাকতেন ডেস্কে। জোরে কথা বলতেন না। কিন্তু ক্যান্সার তাকেও কেড়ে নিলো। সদ্য বিবাহিত বউ রেখে বিদায় নিলেন। তার চলে যাওয়ার আকস্মিক খবর হতভম্ব করে আমাদের।
মো. আবুল কাসেম। নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি ছিলেন। হঠাৎ এক বিকালে ফোন, ভাই নিউজ পাঠিয়ে দিলাম। এর ঠিক ১৫ মিনিট পর আবার ফোন ফতুল্লার সানারপাড় থেকে দৈনিক জনকণ্ঠের স্টোরকিপার বলছি। টেম্পো দুর্ঘটনায় একজন নিহত হয়েছেন। তার পকেটে একটি আইডি কার্ড পাওয়া গেছে। এতে লেখা মানবজমিন পত্রিকার সাংবাদিক। খোঁজ নিয়ে জানা গেল আমাদের আবুল কাসেমই সেই নিহত ব্যক্তি। তার এই মৃত্যুতে বুকে কষ্টের পারদ জমে। একজন ভালো মানুষের এভাবে চলে যাওয়া আমাদের কাঁদায়।
বাবর মাহমুদ ছিলেন লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি। খুব অল্প সময় আমাদের সঙ্গে থেকে তিনি নিজেকে যোগ্য করে তুলেছিলেন। ছিলেন একজন সৎ মানুষ এবং আদর্শবান পুরুষ। লক্ষ্মীপুর থেকে ঢাকায় আসার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি আহত হন। এরপর তাকে রাখা হয়েছিল স্কয়ার হাসপাতালে। পক্ষকাল মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে সবাইকে ছেড়ে তিনি চিরবিদায় নেন।
আখলাকুর রহমান খেলু। হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলা প্রতিনিধি ছিলেন। তার সঙ্গে কথা হতো প্রতিনিয়ত। নিউজ পাঠিয়েই ফোন দিতেন। একজন ভালো মানুষ যেমন ছিলেন তেমনি ছিলেন সৎ এবং স্পষ্টভাষী ।
সামাদুল ইসলাম ছিলেন মেহেরপুর প্রতিনিধি। মৃত্যুর মাসখানেক আগে আইডি কার্ডের ছবি দিয়ে যান। এরপর তার আর কোনো সন্ধান পাইনি। হঠাৎ একদিন জানতে পারি সামাদুল ইসলাম আর নেই। মনে পড়েছে, মোংলা প্রতিনিধি আবুল কালাম আজাদ, পাকুন্দিয়ার মানিক আহমেদ, মাদারীপুর জেলার কালকিনি প্রতিনিধি দেলোয়ার হোসেন, নীলফামারী জেলার জলঢাকা প্রতিনিধি শামসুল আলম, রংপুর বদরগঞ্জের রমজান আলী, দিনাজপুরের ফুলবাড়ী প্রতিনিধি রেজাউল ইসলাম বাবুল। যাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কথা হতো। তারাও আমাদের ছেড়ে দূর পরবাসে। কোনোদিন তাদের সঙ্গে আর দেখা হবে না। কথাও হবে না। এখনো আমরা আছি। কাজ করছি। কথা বলছি। রজতজয়ন্তীর এই দিনে তাদের স্মরণ করতে গিয়ে সবকিছুই গুলিয়ে ফেলছি। তারা এখন পরপারের বাসিন্দা। ভালো থাকবেন আপনারা পরপারে।