ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

আপন আলোয় মানবজমিন

জেগে থাকুক মানবজমিন

কাফি কামাল, যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বুধবার
mzamin

প্রতিযোগিতামূলক একটি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যোগ দিয়েছিলাম মানবজমিনে। কিছুটা নাটকীয়ভাবে এক বৃষ্টির দিন। মফস্বল বিভাগ হয়ে দেড় মাস পর সুযোগ মিলেছিল রিপোর্টিংয়ে। দুই সপ্তাহের মাথায় তৎকালীন প্রধান প্রতিবেদক সারোয়ার হোসেন জানতে চেয়েছিলেন, আমি রাজনীতি ও অর্থনীতির মধ্যে কোন বিষয়ে আগ্রহী। দেশ তখন রাজনৈতিকভাবে অস্থির এক সময় পার করছিল। দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই বলেছিলাম, রাজনীতি। প্রয়াত তৌফিক উদ্দিনের সহযোগী হিসেবে তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগ বিটে সুযোগ পেলাম। সেই যে বিরোধীদলের সংবাদ সংগ্রহ শুরু করেছিলাম, শেষ পর্যন্ত আমার ভাগ্যে লেখা হলো- বিরোধীদল বিট। দেশের চলমান অস্থিরতার ভেতর দিয়ে আসে ওয়ান ইলেভেন। বিএনপি ততদিনে বিরোধী দল এবং নিয়াজ মাহমুদ মানবজমিন ছাড়লে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ-ধানমণ্ডির বদলে আমার বিচরণ ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায় গুলশান-নয়াপল্টন।

বিজ্ঞাপন
সে এক অদ্ভূত, অস্থির সময়। বিপর্যন্ত দলটির সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে সার্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছিল।

 এক সময় সংশ্লিষ্টজনদের আস্থা-বিশ্বাস অর্জন ও বিশ্বস্ত সংবাদ সূত্র তৈরির মধ্যদিয়ে বিটে একটি অবস্থানও তৈরি হয়েছিল। ঝুঁকিপূর্ণ রাজনৈতিক সংবাদের পাশাপাশি রাতের ঢাকা সিরিজ লিখতে গিয়ে দেখেছি রাজধানীর রাতবিরাতের নানা রং-রূপ। সময়ের পরিক্রমায় ওয়ালসো টাওয়ার ছেড়ে মানবজমিনের নতুন ঠিকানা হয়েছে কাওরান বাজারের জেনিথ টাওয়ার। নানা সময়ে রিপোর্টিং বিভাগের সিদ্ধান্ত, যেমন- দৈনিক সর্বাধিক রিপোর্ট, শব্দের সংখ্যায় সর্বাধিক রিপোর্ট, সর্বাধিক বাইলাইন- প্রতিযোগিতায় প্রায় সময় শীর্ষে থাকতাম। মানবজমিনের আর্কাইভ সবসময় তার সাক্ষ্য দেবে। তবে বিএনপি’র রাতবিরাতের কর্মকাণ্ডের কারণে বিলম্বে রিপোর্ট জমা দেয়ার ক্ষেত্রেও আমিই ছিলাম অদ্বিতীয়। রাজনৈতিক বিটে কাজ করতে গিয়ে রাজনীতিবিদদের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি হলেও প্রয়োজনে তাদের সমালোচনা করে রিপোর্ট লিখতে দ্বিধা করিনি। ‘বিএনপির ময়নাতদন্ত’ সিরিজটি ব্যাপক ক্ষোভের কারণ হয়েছিল অন্ধ দলদাসদের। ‘আত্মীয়তার বন্ধনে রাজনীতি’ সিরিজটি মনোযোগ কেড়েছিল রাজনীতিসচেতন মানুষের। আতঙ্কের জনপদ ফেনীতে একরাম হত্যাকাণ্ডের পর সেখানে অবস্থান করে ঢাকার একমাত্র সাংবাদিক হিসেবে টানা দুই সপ্তাহ ধারাবাহিক প্রতিবেদন করেছি মানবজমিনে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষের সময় আমার ধারাবাহিক প্রতিবেদনগুলো দুইপক্ষেই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। সুযোগ এসেছিল কূটনীতিক রিপোর্টার হবার। পেশাগত কাজে ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছি প্রায় পুরো বাংলাদেশ। আমার কবি মনকে বাস্তবমুখী করতে মিলান ফারাবী, কবি মন বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়াত সাযযাদ কাদির, ভাষাকে পরিমার্জিত করে শামীমুল হক, সারোয়ার হোসেন ও কাজল ঘোষ চিরঋণী করেছেন। নানা সময়ে সহকর্মীদের সঙ্গে যেমন রাগ-ক্ষোভ করেছি, আবার সহকর্মীদের পক্ষ নিয়ে সপ্তাহিক মিটিংগুলোতে উচ্চকিত থেকেছি। সহকর্মীকে বিপদ থেকে বাঁচাতে গিয়ে শাস্তিও মেনে নিয়েছি বিনা বাক্যব্যয়ে। মানবজমিনে দীর্ঘ দেড় দশকে অনেকের সঙ্গে কাজ করেছি, যাদের কেউ কেউ নিজেদের মুখচ্ছবিগুলো অঙ্কিত করেছেন আমার হৃদয়ে।   

পেশাগত জীবনে আমার যেটুকু পরিচয় ও অর্জন, তার জন্য প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো চিরকাল। সম্পাদক মাহবুবা চৌধুরীর প্রতিও অশেষ কৃতজ্ঞতা। কেবল এটুকু লিখলে অকৃতজ্ঞতা হবে। আমাকে সম্ভাব্য বিপদ থেকে একাধিকবার রক্ষা করেছেন মতিউর রহমান চৌধুরী। একবার প্রকাশ্য শাস্তি দিয়ে, পুরষ্কৃত করেছেন গোপনে। সবচেয়ে গৌরবের কথা, দেড় দশকের সাংবাদিকতা জীবনে সম্পাদক বা প্রকাশকের বিশেষ স্বার্থ বিবেচনা করে কোনোদিন কাজ করতে হয়নি। সম্পাদক-প্রকাশকের ব্যবসা-বাণিজ্যের লবিং-তদবিরে ব্যবহৃত হতে হয়নি। মানবজমিন কর্তৃপক্ষের স্বার্থরক্ষা বা উদ্ধারে কোনো রিপোর্ট লিখতে হয়নি। স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কারণে রিপোর্টের অপমৃত্যুও দেখতে হয়নি। সম্পাদকের মুখে অশ্রাব্য ভাষা শুনতে হয়নি। মতিউর রহমান চৌধুরীর মতো কিংবদন্তির অধীনে কাজ করার মোহ, বেশি রিপোর্ট প্রকাশের সুযোগ ও মানবজমিনের সার্বিক পরিবেশের কারণে নানা সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় ভালো বেতনের অফার এলেও কখনো মানবজমিন ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। অন্যত্র হয়তো বেশি বেতন পেতাম, চাকরি ছাড়লে কিছু এককালীন অর্থও পাওয়া যেতো; কিন্তু একাধিক বস, নানামুখী গ্রুপিং আর সর্বোপরি রিপোর্ট প্রকাশে অদৃশ্য দেয়াল দাঁড়াতো প্রায় সময়। আর মানবজমিনে একজনই বস, মতিউর রহমান চৌধুরী। বাংলাদেশে হাত খুলে লেখার এমন অবারিত স্বাধীনতা অন্য কোনো সম্পাদক দেন বলে জানা নেই। বাকস্ববাধীনতার কণ্ঠরুদ্ধ একটি দেশে দেখেছি, কীভাবে একজন সম্পাদক অন্যদের দিয়ে উচ্চারণ করিয়ে নেন- অপ্রিয় বাস্তব। কীভাবে বস্তুনিষ্ঠ সত্য লিখেন এবং লেখান কৌশলে। সাংবাদিক তৈরির পাঠশালা মানবজমিনে কাজ করার সুবাদে সবসময় গর্ব করে বলি- দেশের সব গণমাধ্যমেই রয়েছে মানবজমিন। যেখানেই দেখা হোক, মানবজমিনের সাবেকদের মধ্যেও দেখেছি এক অন্যরকম টান। অনেকের অনেক প্রতিষ্ঠানে কাজের অভিজ্ঞতা আছে, আমার কেবল একটাই- মানবজমিন। দীর্ঘ পথচলায় মানবজমিনের প্রতি কিছু দুঃখবোধ যে নেই, তা নয়। তবে তা নিজের কাছেই অপ্রকাশ্য থাকুক। বরং ‘অব্যাহতিপত্রে সই দিতে দ্বিধার প্রকাশ’ ও ‘ডানা কাটা পড়ার আক্ষেপ’ নিয়ে প্রধান সম্পাদকের দুইটি বাক্য সারাজীবন উচ্চারিত হোক আমার কর্ণকুহরে। প্রার্থনা করি, বস্তুনিষ্ঠতা ও বাকস্বাধীনতার পক্ষে জেগে থাকুক মানবজমিন।

আপন আলোয় মানবজমিন থেকে আরও পড়ুন

   

আপন আলোয় মানবজমিন সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status