ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

আপন আলোয় মানবজমিন

একটি অনুভূতির নাম মানবজমিন

আশরাফুল নওশাদ, নিউইয়র্ক প্রবাসী
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বুধবার
mzamin

দৈনিক মানবজমিন পত্রিকা ২৫ বছর পূর্ণ করছে। এই বাক্যটি শোনামাত্রই মনের অন্দরে অন্যরকম একটা শিহরণ অনুভব করলাম। বার্তা সম্পাদক কাজল ঘোষ আমাকে সংবাদটি জানিয়ে মানবজমিন সম্পর্কে স্মৃতিচারণমূলক কিছু লিখতে অনুরোধ করেছেন। সেজন্যে তাকে ধন্যবাদ। আমরা যারা মানবজমিনের জন্মের সঙ্গে জড়িত ছিলাম তন্মধ্যে দায়িত্বের বড় একটা অংশ আমার কাঁধেই ছিল। সেটা অবশ্য একান্তই মতি ভাই’র ইচ্ছায়। জানি না তিনি হয়তো আমার মাঝে বিশেষ কোনো নির্ভরতা খুঁজে পেতেন।  সেজন্যে উনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তবে হ্যাঁ এটা বলতে পারি যতদিন মানবজমিনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম ততদিন সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি।
সুতরাং মানবজমিন সম্পর্কে লিখতে গেলে কিছু পেছনে ফিরে তাকাতেই হবে। তাহলে জানা যাবে কেন মানবজমিন পত্রিকার জন্ম।

বিজ্ঞাপন
১৯৯১ সাল আমি সবেমাত্র বৃটিশ- আমেরিকান ট্যোবাকো  কোম্পানির চাকরি ছেড়েছি। চাকরি ছেড়েছিলাম ঢাকার বাইরে যাবো না বলে। ঢাকায় থাকাটা জরুরি ছিল। নাট্যকেন্দ্র,  রোটারেক্ট ক্লাব, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে ঢাকার বাইরে যাওয়াটা আমার পক্ষে কঠিন ছিল।
মতি ভাই তখন ইত্তেফাক’র কূটনৈতিক রিপোর্টার। সাংবাদিক হিসেবে তার সুনাম চতুর্দিকে। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী লেখা ‘দুর্নীতিবাজদের উল্লাসের নৃত্য’ শীর্ষক রিপোর্টসহ স্বৈরাচার বিরোধী বিভিন্ন রিপোর্টের জন্যে মতি ভাই তখন স্বনামধন্য সাংবাদিক। আমার আবার টুকটাক ছড়া, কবিতা লেখার শখ ছিল। তার মানে এই না  যে, আমি কোনো পরিচিত কবি-লেখক ছিলাম। মতি ভাই’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে উনার মাধ্যমে ইত্তেফাকে মাঝেমধ্যে ছড়া-কবিতা প্রকাশের সুযোগ  পেতাম। তা না হলে আমার মতো লেখকের লেখা ইত্তেফাক কি আর ছাপতো? এরইমধ্যে একদিন মতি ভাই’র টেবিলের সামনের  চেয়ারে বসে গ্লুকোজ বিস্কুট আর চা খাচ্ছি। মতি ভাই বললেন, নওশাদ একটা পত্রিকা প্রকাশের প্ল্যান করছি। নামও ঠিক করে  রেখেছি। জানতে চাইলাম কী নাম। তিনি বললেন, ‘আজ কাল পরশু’। সম্ভবত  সেটা সাপ্তাহিক পত্রিকার ডিক্লারেশন ছিল। আমি বললাম কবে প্রকাশ করতে চাচ্ছেন? তিনি বললেন,  এখনো ঠিক করিনি। এর আগে অভিজ্ঞতা দরকার। একটা পত্রিকা পরিচালনা করার অফার আছে। যেহেতু পত্রিকা প্রকাশের চিন্তা-ভাবনা আছে সেহেতু একটু অভিজ্ঞতা দরকার। অফারটা নিয়ে  নেবো ভাবছি। জিজ্ঞেস করলাম কোথায়? তিনি বললেন, কাউকে বলবেন না প্লিজ। দৈনিক আজকের কাগজে। ইতিমধ্যে আজকের কাগজের মালিকানা সংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল। সে যাই হোক ক’দিনের মধ্যে মতি ভাই তার দীর্ঘদিনের পুরনো কর্মস্থল ত্যাগ করে  যোগ দিলেন আজকের কাগজে। আমি নিয়মিতই মতি ভাই’র অফিসে যাতায়াত করতাম।
এমনি করে বেশ ক’দিন চলে  গেল। আমি তখন থাকতাম জিগাতলায়। আজকের কাগজের অফিসও ছিল জিগাতলায়।
আমি তখন আমেরিকা চলে যাওয়ার প্ল্যান করছি। মতি ভাই বললেন, নওশাদ বাদ দেন আমেরিকার প্ল্যান। আপাতত ঢাকায় একটা চাকরি খুঁজেন। আমিও দেখছি কী করা যায়।
পত্রিকা বের করবো সিদ্বান্ত নিয়ে ফেলেছি। আপনাকে আমার সঙ্গে কাজ করতে হবে। আমি বললাম, আমি কী করবো? আমার তো কোনো অভিজ্ঞতা নেই। মতি ভাই বললেন, আপনার লেখালেখির অভ্যাস যেহেতু আছে সেহেতু পারবেন।
তাছাড়া লেখালেখি ছাড়াও অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আছে। সমস্যা হবে না। তাছাড়া আমি তো আছিই। আমি অবশ্য কয়েকদিন পর আইসিডিডিআরবি’র একটা প্রজেক্টে যোগদান করি। মতি ভাই আজকের কাগজ নিয়ে ব্যস্ত।
আমি কাজ শেষে প্রায় প্রতিদিনই মতি ভাই’র অফিসে একটু দেখা করে যেতাম। এভাবে মাস তিন কেটে  গেল। 
আমাকে দেখে একদিন মতি ভাই বললেন, নওশাদ  ভালোই হলো আপনি আসছেন। মতি ভাই’র একটা বিশেষ গুণ আছে; তিনি ছোট-বড় সবাইকে আপনি সম্বোধন করেন।
আমি বললাম কেন বলেন তো? মতি ভাই বললেন, এখানে বেশিদিন কাজ করা যাবে না। সমস্যা আছে।
মনে মনে রেডি থাকেন, আমরাই নতুন পত্রিকা প্রকাশ করবো।
তারপর দু’দিনের মাথায় মতি ভাই আজকের কাগজ থেকে ইস্তফা দিলেন। শুরু হলো নতুন পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তুতি।
একটি ভালো পত্রিকা প্রকাশের নিমিত্তে শুরু হলো অনেকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা। আমার প্রস্তাবে সকলের মতে প্রকাশনার পীঠস্থান পুরনো ঢাকার বাংলাবাজারের নামানুসারে মতি ভাই পত্রিকা শব্দটি যুক্ত করে পত্রিকার নতুন নাম রাখলেন ‘বাংলাবাজার পত্রিকা’।
শুরু হলো এক মহাকর্মযজ্ঞের। এই কর্মযজ্ঞে অনেকের নাম জড়িত আছে। সবার নাম উচ্চারণ ও তাদের অবদান উল্লেখ করলে নির্দিষ্ট শব্দের গণ্ডির মধ্যে তার সংকুলান হবে না।
মতি ভাই বিভিন্ন পত্রিকা থেকে নবীন-প্রবীণ একঝাঁক সাংবাদিকসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করত পুরনো ঢাকার বাংলাবাজারেই রক্ত সংগ্রহের  প্রোগ্রাম আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাবাজার পত্রিকা প্রকাশ করলেন। নানা চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে বাংলাবাজার পত্রিকা মোটামুটি চলছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এক বছরের মধ্যেই আর্থিক টানাপোড়েন ও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে পত্রিকাকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে একরকম বাধ্য হয়েই মতি ভাই তার সন্তানতুল্য পত্রিকাকে কসকো গ্রুপের কাছে মালিকানা হস্তান্তরসহ সকল সাংবাদিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে নিজেও  যোগদান করলেন। রক্তঝরা পরিশ্রম করে পত্রিকাকে  যেহেতু বেশিদিন ধরে রাখতে পারেননি সেহেতু এক অদৃশ্য ব্যর্থতার গ্লানি আমাকে আচ্ছন্ন করে।  সে কারণে আমি আর নতুন ব্যবস্থাপনার অধীনে যুক্ত হতে পারিনি। তবে ব্যর্থতার গ্লানি যে শুধু আমাকে গ্রাস করেছিল তা কিন্তু নয়, মতি ভাইকেও করেছিল আমার  চেয়ে বেশি। তিনি শুধু সাংবাদিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চাকরি ও পত্রিকাকে বাঁচাতে সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। আমি এদিকে বিজ্ঞাপনী সংস্থা ও প্রিন্টিং ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই। তবে মতি ভাই’র সঙ্গে ছিল নিয়মিত যোগাযোগ। এভাবেই চলছিল। ১৯৯৭ সালের জানুয়ারির প্রথম দিকে সম্ভবত মতিভাই’র বাসায় গেলাম। তিনি বললেন, নওশাদ কাজ তো আরও একটা শুরু করতে হবে। মানবজমিন পত্রিকা নামে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকার কাজ শুরু করতে হবে। আমি এবং হাসান শাহরিয়ার মিলে যাবতীয় প্রশাসনিক কাজ শেষ করলাম। কিছুদিনের মধ্যেই সাপ্তাহিকের কাজ শুরু হলো। অফিস হলো ওয়ালসো টাওয়ারের  বেইসমেন্টে। সম্পাদক হিসেবে বাংলা একাডেমির সাবেক ডিজি প্রফেসর হারুনুর রশিদের নাম যুক্ত হলো। সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলাম আমি। অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে বাংলাবাজার থেকে দায়িত্ব পালন করতেন অনেকেই তন্মধ্যে মিসির ভাই অন্যতম। প্রকাশনা ও সার্কুলেশন দেখতেন  তোফায়েল আহমদ  চৌধুরী। কম্পিউটারে সহযোগিতা করতেন সানাউল্লাহ নুরী ও মুশফিকসহ আরও দু-একজন। বার্তা সম্পাদক হিসেবে যুক্ত ছিলেন মহসিন আব্বাস। রিপোর্টার হিসেবে যুক্ত ছিলেন রাজীব নূর, কাজী হাফিজ প্রমুখ। সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে এক বছর পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মতিভাই আবারো বললেন, নওশাদ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মানবজমিনকে  দৈনিক করতে হবে। আবারো শুরু হলো দৌড়ঝাঁপ। সাপ্তাহিক অফিসে শুরু হলো ডামি তৈরির কাজ। এরইমাঝে কোনো এক বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটায় তৎকালীন ঢাকার  জেলা প্রশাসক সাপ্তাহিক মানবজমিনকে  দৈনিক পত্রিকা হিসেবে অনুমতি দান করেন। সাপ্তাহিক মানবজমিনকে  দৈনিক পত্রিকা হিসেবে অনুমতি নিতে গিয়েই আমি প্রথম  জেনেছিলাম ঢাকার  জেলা প্রশাসকরা রাতেও অফিস করেন। এমনি করে সকলের অক্লান্ত পরিশ্রম ও কর্মদক্ষতায় বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক ট্যাবলয়েড পত্রিকা হিসেবে  দৈনিক মানবজমিন প্রকাশিত হয়। অবশ্য প্রকাশের আগেই অফিস স্থানান্তরিত করি ওয়ালসো টাওয়ারের বেইজমেন্ট থেকে প্রথম তলায়। আজ মানবজমিনের রজতজয়ন্তী। যা অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ। আমি নিজেও অপার আনন্দে আনন্দিত এবং গর্ববোধ করছি এই জন্যে  যে এই পত্রিকার জন্মের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম। এই ২ যুগ ধরে বহুজনের অক্লান্ত পরিশ্রমে মানবজমিনের এই দীর্ঘ যাত্রা। শুরু থেকে যারা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারা অনেক এখনো যুক্ত আছেন, অনেকে অন্যান্য পত্রিকা, টেলিভিশন মিডিয়া ও সরকারি বেসরকারি চাকরিতে যুক্ত হয়েছেন। মানবজমিনের সঙ্গে যাদের এখন আর সম্পৃক্ততা নেই তাদের সবারই শ্রম জড়িয়ে আছে মানবজমিন এর এই ২৫ বছরে। অন্যদিকে আমরা আমাদের অনেক সহকর্মীকে আমাদের জীবন থেকে একেবারে হারিয়েও  ফেলেছি। যাদের অবদান স্বীকার করত তাদের নাম উল্লেখ করতেই হবে। মিসির ভাই, সাজ্জাদ কাদির ভাই, আওলাদ ভাই, মোশারফ রুমী, মনোয়ার  হোসেন, তৌফিক ভাই, হোসেন জাকিরসহ সহকর্মীদের আমরা চিরতরে হারিয়েছি। এরা সবাই আগে পরে বিদায় নিয়েছেন। আমি তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন তাদের সবাইকে ভালো রাখেন। আমি নিজেও মানবজমিন থেকে অনেক দূরে বাস করি। এখন পুরোদস্তর প্রবাসী। প্রায় একযুগ হতে চললো আমেরিকায় বসবাস করছি। তবে আমার সৌভাগ্য মানবজমিনের সঙ্গে এখনো আমার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। আমার বিশ্বাস, আমার সহকর্মীরা এখনো আমাকে ভালোবাসেন। অনেকে নিজে থেকেই আমার খোঁজখবর  নেয়। আজ মানবজমিনের শুভলগ্নে সকল সাংবাদিক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের প্রতি রইলো আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।
সেই সঙ্গে মানবজমিন পত্রিকার দীর্ঘায়ু কামনা করছি হৃদয়ের গভীর থেকে।

আপন আলোয় মানবজমিন থেকে আরও পড়ুন

   

আপন আলোয় মানবজমিন সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status