ঢাকা, ১৩ মে ২০২৫, মঙ্গলবার, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৪ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

আপন আলোয় মানবজমিন

ফিরে দেখা জীবনের সুখকর ১৬ বছর

দীন ইসলাম, সাবেক বিশেষ প্রতিনিধি, মানবজমিন
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বুধবার
mzamin

ট্যাবলয়েড দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার তখন শিশুকাল। বাজারে ব্যাপক কাটতি। মানবজমিন-এর সংবাদ মানেই বিশেষ কিছু। গডফাদার রাজনীতিবিদ, দুর্নীতিবাজদের আতঙ্কের নাম। শক্তিশালী রিপোর্টিং টিম। সারোয়ার হোসেন (সম্পাদক, এটিএন নিউজ), কাজী হাফিজ (সিটি এডিটর, দৈনিক কালেরকণ্ঠ), জাহেদ চৌধুরী, শওকত ওসমান রচিসহ অনেকেই ছিলেন সেই রিপোর্টিং টিমের সদস্য। এমন সময়েই  ২০০৩ সালের ১লা আগস্ট  যোগদান করি বাংলাদেশের একমাত্র ট্যাবলয়েড দৈনিক মানবজমিন-এ।  কাজ করেছি ৩০শে সেপ্টেম্বর ২০১৯ সাল পর্যন্ত। সব মিলিয়ে ১৬ বছর ১ মাসের মানবজমিন  জীবন বেশ স্মৃতিময়, সুখকর, মধুর ও আবেগীয়। এককথায় বলা চলে জীবনের সেরা সময় পার করেছি। বাংলাদেশে আমার প্রথম এবং সর্বশেষ চাকরি করা প্রতিষ্ঠানের নামও ‘দৈনিক মানবজমিন’। বললে অত্যুক্তি হবে না, নামকরা তিনটি সংবাদপত্রে ভালো বেতনে চাকরির অফার পেয়েও ভালোবাসার প্রতিষ্ঠানটি ছেড়ে যাইনি। এর একমাত্র কারণ অসাধারণ কাজের পরিবেশ, জিরো গ্রুপিংবাজি এবং মালিকপক্ষের অসীম আন্তরিকতা। মানবজমিন’র কর্মী হয়ে কাজ করার সময়ে বেতনভুক্ত কর্মচারী বলে আমি নিজেকে কখনো ভাবিনি। ‘মানবজমিন’ -এর ভালো হয় এজন্য জীবনের সেরাটা দেয়ার চেষ্টা করেছি (কতটুকু দিতে পেরেছি দৈনিক মানবজমিন কর্তৃপক্ষ সেটা ভালো বলতে পারবেন)। 

একটি কথা বলতেই হয়, দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক মাহবুবা চৌধুরী, প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী এবং ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কেএম বাবর আশরাফুল হকের বিনয়, শ্রদ্ধাবোধ এক অর্থে অসাধারণ। প্রতিষ্ঠানটির সাবেক এবং বর্তমান কর্মীদের সবাই আমার এ কথার সঙ্গে একবাক্যে একমত হবেন। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমন, মতি ভাই দৈনিক মানবজমিন’র আনিস, সুরুজ বা ইয়ামিনসহ অন্যদের কখনো পিওন হিসেবে ডাকতেন না। কেউ ডাকলেও তাকে বারণ করতেন (আমাকে দু’বার করেছেন)। সব সময় বলতেন অফিস স্টাফ। হাজিরা খাতায়ও তাদের পদবী অফিস স্টাফ লেখা থাকতো (এখনো হয়তো বা আছে)। সবাইকে আপনি বলে সম্মোধন করা মতি ভাইয়ের অন্য রকম সৌন্দর্য। অনেকে লেখাটি পড়ে বিরক্ত হলেও আমি বলবো, মতি ভাই মালিক ও সম্পাদক হলে তার চলনে বলনে সেটা কখনো প্রকাশ পেতো না। মতি ভাই হলেন সম্পাদকদের সম্পাদক (বর্তমানে অনেক সম্পাদক মতি ভাইয়ের অধীনে কাজ করেছেন)। তবে বাংলাদেশে কিছু সম্পাদকের মতো সেটা কখনো জাহির করে বলেন না মতি ভাই।     
অগোছালো রিপোর্ট লিখলে মতি ভাই মাঝে মধ্যে আমাকেসহ অন্যদের ধমক (বছরে একবার বা বড় জোড় দু’বার) দিতেন। তবে ধমকের এক ঘণ্টা পর ডেকে কথা বলতেন পরম স্নেহে। নির্দেশনা দিতেন ভালো রিপোর্ট করার। মাঝে মধ্যে অফিসে বসে ফেসবুক বা ইউটিউবে ভিডিও দেখার সময় কখন যেন মতি ভাই পেছনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন তা টেরই পেতাম না। কিন্তু মতি ভাই মুচকি হেসে কিছু বুঝতে না দিয়ে চলে যেতেন। মতি ভাইয়ের বিদেশ যাত্রা ছিল আমিসহ রিপোর্টারদের জন্য ঈদের চাঁদের মতোই আনন্দের। মতি ভাই বিদেশে থাকলে অফিস থেকে দ্রুত প্রস্থান ছিল নিয়মিত বিষয় (রিপোর্ট ফাঁকি দিয়ে নয়)। এরপর বিদেশে বসে আমাদের গতিবিধি ফলো করার জন্য মতি ভাই লাগালেন সিসি ক্যামেরা। তাতে আমার ক্ষেত্রে খুব বেশি কাজে দেয়নি। কারণ আমি উপর তলার মনিটরে লক্ষ্য করলাম আমার অবস্থান সিসি টিভিতে ভালোভাবে দেখা যায় না। তাই মতি ভাই বিদেশে থাকলে আমি অফিস দ্রুত ত্যাগ করতাম। মতি ভাই বিদেশ থেকে দেশে ফিরলে লুৎফর রহমান (সিটি এডিটর ও চিফ রিপোর্টার) বলতেন, ‘দীন ভাই। মতি ভাই কিন্তু দেশে আসছে। আজকে আগে বের হইয়েন না’। এমন হাজারো মজার স্মৃতি মনে করে সত্যি আনন্দ অনুভব করি।       

প্রিয় পত্রিকাটির ২৫ বছর পূর্তিতে একটি কথা চোখ বন্ধ করে বলতে পারি, দৈনিক মানবজমিনের কর্মী হিসেবে ভয়-ডরহীন সাংবাদিকতা করেছি। প্রধান সম্পাদক মতি ভাই (মতিউর রহমান চৌধুরী) সব সময় ভালো রিপোর্ট করার উৎসাহ দিয়েছেন। বলেননি ওর বিরুদ্ধে লেখা যাবে না, তার বিরুদ্ধে লেখা যাবে না। অমুক আমার আত্মীয়, তমুক আমার এলাকার মানুষ। কানাডায় বাইচান্স প্রবাস জীবনে আসার আগে সচিবালয় বিটের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় প্রায় একযুগ কাজ করেছি। এ সময়ে অন্য পত্রিকার সহকর্মীদের দেখেছি পত্রিকার মালিক বা পত্রিকার সিনিয়র সহকর্মী কারও কাজ বা প্রটোকল করতেই সারা দিন ব্যয় করছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে আমি ভাগ্যবান। কারণ মতি ভাই কখনো কোনো তদবিরের কাগজ আমাকে ধরিয়ে দেননি। বলেননি, এই তদবিরটা করে নিয়ে আসেন। সচিবালয়ে মিটিং (মতি ভাইয়ের এক্রিডিটেশন কার্ড না থাকার পরও) থাকলেও আমাকে জানাতেন না। নিজের আমন্ত্রণপত্র ব্যবহার করে সচিবালয়ে ঢুকে চুপচাপ মিটিং করে চলে যেতেন। মাঝে মধ্যে জিজ্ঞেস করলে বলতেন, আরে ভাই...আপনি কাজে ছিলেন। আপনাকে ডিস্টার্ব করা ঠিক হবে না। তাই আপনাকে ফোন করিনি। প্রথম দিকে এনিয়ে অবাক হলেও পরে সেটা স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেই। মতি ভাইয়ের সঙ্গে এমন কত শত ঘটনা আছে তার হিসাব নেই। তবে প্রধান সম্পাদক মতি ভাইয়ের নেতৃত্বে রিপোর্টিং মিটিং খুব উপভোগ করতাম। মিটিংয়ের ডেট হওয়ার পর রিপোর্টারদের মধ্যে এনিয়ে আলোচনা হতো মতি ভাই কী নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। তবে মিটিং শুরুর পর মতি ভাইয়ের মুড বুঝে অনেককে কথা বলতে দেখেছি। কেউ কেউ তোপের মুখে পড়তেন (অবশ্যই রিপোর্ট নিয়ে)। মতি ভাই সব সময় একটি কথা বলতেন, ভাই, রিপোর্ট করেন। পত্রিকাটি আওয়ামী লীগ বা বিএনপি’র কারও না। ঘটনা যা আছে তাই লিখে দেন। এরপর আমি দেখবো (সাহস করে নিজের সহকর্মীদের এমন নির্দেশনা দেয়া সত্যি বিরল)। সত্যি মতি ভাইয়ের এ নির্দেশনা কাজের ক্ষেত্রেও অক্ষরে অক্ষরে দেখেছি।        

মানবজমিনে আমার রিপোর্টিং জীবন ছিল নাটকীয়তায় ভরপুর। পত্রিকাটিতে যোগদানের প্রথমদিনেই আমাকে এসাইনমেন্টে এফডিসি’র গেটে পাঠান বিনোদন বিভাগের সাবেক প্রধান মোশাররফ রুমী (প্রয়াত)। এসাইনমেন্টের বিষয়- কেউ নায়ক হতে এফডিসি’র গেটে এসেছে কি-না তার খোঁজ করা। কিন্তু গেটে সিনেমার নায়ক হতে আগ্রহী খোঁজার সময় দেখতে পাই, কর্মরত আনসার সদস্যরা টাকার বিনিময়ে লোক ঢুকাচ্ছেন। কিন্তু পেলাম না নায়ক বা নায়িকা হতে আগ্রহী কাউকেই। দু’দিন পর আমার লেখা রিপোর্ট প্রকাশ হলো ‘এফডিসি’র গেট: টাকা দিলেই ভেতরে ঢোকার সুযোগ’। এ রিপোর্ট প্রকাশের পর এফডিসিতে হইচই পড়ে যায়। তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। আমাকে ডাকা হয় সেই তদন্ত কমিটির সামনে (যদিও যাইনি)। এরপর থেকে পথচলা শুরু। ৩ বছর বিনোদন  রিপোর্ট করার সময় কতো ঘটনা। সংগীত শিল্পী ডলি সায়ন্তনী (নতুন বিয়ে নিয়ে রিপোর্ট), আসিফ আকবর (প্রীতম হাসানের একটি রিপোর্টের কমেন্ট নিয়ে), আর্কের হাসান (ডিভোর্স সংক্রান্ত রিপোর্ট)সহ অনেক রিপোর্ট নিয়েই ঝামেলার মুখে পড়েছি। আসিফের সঙ্গে ঝামেলা মিটিয়েছেন আমাদের সবার প্রিয় মতি ভাই (মতিউর রহমান চৌধুরী)। তবে কালচারাল সাংবাদিকদের সংগঠন সিজেএফবিতে একটিভ হওয়ার পর এক বড় ভাই সাংবাদিকের রোষানলে পড়ে যাই। এরপর অনেকটা অকস্মাৎ আমাকে বিনোদন বিভাগ থেকে রিপোর্টিং বিভাগে বদলি করা হয়। ওই সময় মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান আশরাফুল নওশাদ একটি চিঠি ধরিয়ে দেন (চিঠিটি আমার কাছে যত্নের সঙ্গে আছে)। চিঠিতে বদলির কথা লেখা ছিল। আমি বলবো, মানবজমিন কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্তের কারণে আমার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। মন্ত্রী, এমপি, সচিব বা যে কারও বিরুদ্ধে ভয়-ডরহীনভাবে লিখে গিয়েছি (২০১৪ সালের পর খুব একটা পারিনি। সেলফ সেন্সরশিপ করেছি)। এজন্য সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট আব্দুল মান্নান খান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মূখ্য সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরীসহ অনেক দুর্নীতিবাজের রক্তচক্ষুকে হজম করতে হয়েছে।  চোখের সামনে দৈনিক সমকাল পত্রিকার ডিক্লারেশন ফয়সালা এবং সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও সাম্যবাদী দলের নেতা দিলীপ বড়ুয়ার ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার দৃশ্য এবং পরবর্তী ঘটনা মেলাতে পারি না। দৈনিক মানবজমিনের এডিটর্স রুমে ঘটে যাওয়া এমন শতাধিক ঘটনা আজীবন মেলাতেও পারবো না। অনেক ঘটনা সেজন্য লিখছিও না।    

এখন প্রবাসে বসেও টের পাই মানবজমিন কতটা গ্রহণযোগ্য পত্রিকা। ৯০ ভাগ প্রবাসী বাংলাদেশি অনলাইনে ‘দৈনিক মানবজমিন’ পড়েন। এটা কানাডার টরেন্টোর অবস্থা বললাম। মানবজমিন পত্রিকার বিদেশে বসবাসরত সাবেক সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপেও সেটা বুঝি। ইউকে, ইউএসএসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানবজমিন পত্রিকার সমাদর ব্যাপক। বিদেশে বসেও মানবজমিন’র প্রতি দরদ এতটুকুও কমেনি। কমবে না আজীবন। মতি ভাই (মতিউর রহমান চৌধুরী)-এর মতো অকুতোভয় সাংবাদিক এই মুহূর্তে বাংলাদেশে বিরল। তিনি জনগণের ঝাণ্ডা উড়িয়ে এগিয়ে চলেছেন। এগিয়ে যাক মানবজমিন, এগিয়ে যান মতি ভাই। আমি ব্যক্তিগতভাবে দৈনিক মানবজমিন’র সঙ্গে নেই। কিন্তু আটলান্টিকের পাড়ে বসে মানবজমিন ও মতি ভাইয়ের জয়গান করেই যাবো। জয় হোক মানবজমিন’র বর্তমান সাংবাদিকতার। সরকারের রক্তচক্ষুকে ভয় না করে লেখা অব্যাহত রাখুক।     
লেখক: সাবেক বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক মানবজমিন

আপন আলোয় মানবজমিন থেকে আরও পড়ুন

আপন আলোয় মানবজমিন সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status