ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

আপন আলোয় মানবজমিন

চোখ বিক্রির প্রতিবেদন ও প্রথম উৎসব ভাতার গল্প

ড. মারুফ মল্লিক, জার্মান প্রবাসী লেখক ও গবেষক
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বুধবার
mzamin

মানবজমিনে প্রকাশিত আমার একটি প্রতিবেদন বেশ আলোড়িত ছিল। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। মাত্র চার শব্দের। কিন্তু এর অর্থ ও গভীরতা ছিল তাৎপর্যময়। দিনটির কথা এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে। ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসের কোনো একদিন। প্রচণ্ড গরমের দিন ছিল। আমি নির্বাচন কমিশন বিট করতাম। সকালে কমিশনে গিয়েছিলাম। হাতে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোনো সংবাদ ছিল না।

বিজ্ঞাপন
তাই একটা নাগাদ অফিসে চলে এসেছিলাম। অফিসে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে চিফ রিপোর্টার সারোয়ার ভাই বললেন, চোখ বিক্রেতা এক মহিলার সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে। ওই মহিলা বিজ্ঞাপন দিয়েছেন ইত্তেফাকে। ঠিকানা তেমন বিস্তারিত নাই। বাড্ডার আদর্শ নগরের একটি ঠিকানা ও একটি ফোন নম্বর দেয়া আছে। এটা সম্বল করেই মহিলাকে খুঁজে বের করতে হবে। 

আমি তখনো দুপুরের খাবার খাইনি। সারায়ার ভাই বললেন এখনই যাও। এটা আজকে প্রধান শিরোনাম হবে। আমি দ্রুতই ছুটলাম বাড্ডার দিকে। ধারণা ছিল দ্রুতই চোখ বিক্রির তথ্য সংগ্রহ করে ফিরে আসতে পারবো। কিন্তু আমি জানতাম না আমার জন্য সাবাদিকতার বিশাল এক প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস অপেক্ষো করছে। বাড্ডায় গিয়ে তো ওই ঠিকানা আর পাওয়া যায় না। বিজ্ঞাপন দেয়া মোবাইল নম্বরও বন্ধ। গরমের দিন। বেশিক্ষণ হাঁটাও যায় না। রিকশা নিয়ে বাড্ডার এ মাথা ও মাথা চষে ফেলি। কিন্তু ওই  ঠিকানা আর পাওয়া যায় না। দুপুর দুইটা থেকে ৫টা পর্যন্ত টানা অনুসন্ধানের পরও ঠিকানা পাওয়া যাচ্ছিল না। কেউই ঠিকানাটা দেখিয়ে দিতে পারছিল না।

পাক্কা সাড়ে তিনঘণ্টা অনুসন্ধানের পর পাওয়া গেল সালমা বেগমকে। মানে যিনি চোখ বিক্রি করবেন। আমি ঠিক সালমা বেগমের ঘরের পাশে দাঁড়িয়েই ওই বস্তির একজনকে জিজ্ঞাসা করছিলাম, এই বাসায় কি সালমা বেগম নামে কেউ থাকেন। আমার কথা শুনে এক মহিলা ঘরের ভেতর থেকে মুখ বের করে বলছে আমি সালমা বেগম। কাকতালীয়ভাবে ওই সময় সালমার একটি চোখই দেখা যাচ্ছিল। চেহারায় কিছুটা শঙ্কা। অনিশ্চয়তা। আমি সালমা বেগমের বস্তির ঘরে বসে আলাপ শুরু করি। আমি যখন ওই ঘরের ভেতরে যাই সালমা তখন ডিম তরকারি দিয়ে ভাত খাচ্ছিল। প্রথমে বলিনি যে আমি সংবাদ প্রতিবেদক। তার সঙ্গে টুকটাক আলাপ শুরু করি। বাড়ি কোথায়। কি করেন। সালমা মনে করেছিল আমি চোখ কিনতে চাই। কিছুক্ষণ আলাপের পর সালমা বলে একটি চোখের বিনিময়ে দুইলাখ টাকা দিতে হবে। কারণ তার স্বামী কোনো খোঁজ রাখে না। এক মেয়েকে নিয়ে সে ওই বস্তিতে থাকে। অভাবের কারণেই চোখ বিক্রি করতে চায়।

আলাপের একপর্যায়ে আমি সালমাকে জানাই আমি আসলে ক্রেতা না। মানবজমিনে কাজ করি। প্রতিবেদন তৈরির জন্য তার সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলতে চাই। পরিচয় শুনে সালমা আমতা আমতা করতে থাকে। বলে আমার আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। এর মধ্যে ফটোজার্নালিস্ট মতিউর রহমান সেন্টু ভাইও চলে এসেছে। আমি সালমাকে বুঝাতে সক্ষম হই প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তার কোনো ক্ষতি হবে না। বরং চোখ বিক্রি করতে হবে না। সঙ্গে এও বললাম, দেশের আইনে অঙ্গ বিক্রি করা নিষিদ্ধ। এরপর সালমা বিস্তারিত সব বলতে শুরু করে। আর ওদিকে চলছে সেন্টু ভাইয়ের ক্যামেরার সাটারের ক্লিক। আমার একটা বদ অভ্যাস আছে। আমি মানুষের সঙ্গে খুব বেশি লম্বা আলাপ করতে পারি না। সালমা বেগমের সঙ্গে ১০-১৫ মিনিটেই আলাপ শেষ হয়ে গেল। আমার ফোন নম্বর দিয়ে সালমার ঘর থেকে বের হই। সেন্টু ভাইয়ের হোন্ডাতে চড়ে ছুটি অফিসের উদ্দেশ্যে। সেন্টু ভাই আমাকে মগবাজার মোড়ে যখন নামিয়ে দেয় তখন সন্ধ্যা হয় হয়। আমি রীতিমতো দৌড়ে মগবাজার থেকে বাংলামোটর হয়ে মানবজমিনের ওয়ালসো টাওয়ারের অফিসে পৌঁছেছিলাম। কারণ হচ্ছে ৮টার মধ্যে প্রতিবেদন লেখা ও সম্পাদনা শেষ করতে হতো আমাদের। 

লেখা শেষ হওয়ার পর সারোয়ার ভাই শিরোনাম দিলেন, যে চোখ বিক্রি হবে। পরদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙে মানবজমিনের জাবি প্রতিনিধি নুরুজ্জমানের ফোনে। আমি তখন নারায়ণগঞ্জের বাসায় ঘুমাচ্ছিলাম। এরপর থেকে একের পর এক ফোন। মনে আছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়া থেকে মহিলা ফোন দিয়েছিলেন সালমাকে সাহায্যের জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খাবার ও অর্থ সহায়তা করেছিলেন ওইদিনই। দেশের নানা প্রান্ত থেকে সালমার জন্য  সাহায্য আসতে থাকে। সব থেকে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সালমাকে ২ লাখ টাকা নগদ সহায়তা ও রাজশাহী কৃষি ব্যাংকে একটি চাকুরি দিয়েছিলেন। একটি প্রতিবেদনে সালমার জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছিল। অন্তত তার অভাব কিছুটা হলেও ঘুচেছিল। আমার সাংবাদিকতা জীবনের অন্যতম তৃপ্তি হচ্ছে এই প্রতিবেদন।

সংবাদ তৈরি অনেক কারুকার্য শিখেছিলাম মানবজমিনে। সাংবাদিক তৈরির কারখানা হচ্ছে মানবজমিন। দেশের অনেক নামকরা সাংবাদিক মানবজমিনে তৈরি হয়েছেন। মানবজমিনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক বলতে হবে। এটা অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া মাসের ১ তারিখে মানবজমিন কর্মীদের বেতন প্রদান করতো আমাদের সময়। বেতন আটকে রাখার বা পিছিয়ে দেয়ার ইতিহাস মানবজমিনের নেই আমার জানা মতে। আমার কর্ম জীবনের প্রথম ঈদের উৎসবভাতাও পেয়েছিলাম মানবজমিনে থাকার সময়। অথচ আমার পাওয়ার কথা ছিল না। কারণ তখনো আমার চাকুরির ৬ মাস হয়নি। কিন্তু আমাকে হিসাব বিভাগ থেকে ডেকে নিয়ে ভাতা দেয়া হয়। আমি কিছুটা অবাকই হয়েছিলাম। কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলাম মতি ভাইকে এক মিটিং-এ। মতি ভাই জানিয়ে ছিলেন, স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরুর পর প্রথম ঈদে তার চাকরির মেয়াদ ৫ মাস ২৯ দিন হয়েছিল। অফিসের সবাই ভাতা পেয়েছিলেন। একজন পায়নি। সেটা হচ্ছেন মতিউর রহমান চৌধুরী। একজনের বোনাস না পাওয়ার কষ্ট মতি ভাই জানেন। তাই তিনি চাননি মানবজমিনেও আমি সেই অভিজ্ঞতার মুখে পড়ি। ওই কথা শুনে আমি থমকে গিয়েছিলাম। আমার মুখে তখন কথা আসেনি। আরেকটি বিষয় হচ্ছে মতি ভাই প্রতিবেদকদের রীতিমতো আগলে রাখতেন। চোখ বিক্রি বিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশের পর গোয়েন্দা সংস্থার  সদস্যরা আমাকে খুঁজতে শুরু করে। এটা শুনে মতি ভাই শামীম ভাইয়ের মাধ্যমে আমাকে জানালেন, কেউ কিছু জানতে চাইলে যেন মতি ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলি। ওই সময় আরেকজন সাহস দিয়েছিলেন। বার্তা সম্পাদক শহীদুল আজম ভাই। 

মতি ভাইকে কখনো এসব বিষয়ের জন্য ধন্যবাদ দেয়া হয়নি। আজ এই সুযোগে মতি ভাইকে ধন্যবাদটা জানাতে চাই। ধন্যবাদ মতি ভাই। আপনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি। একইসঙ্গে সাংবাদিক তৈরির কারখানা হিসেবে মানবজমিন আরও শক্তভাবে টিকে থাকুক। মানবজমিনের ২৫ বছর পূর্তিতে শুভেচ্ছা রইলো নিরন্তর অন্তরের অন্তস্থল থেকে। ভালো থাকুন মতি ভাই। ভালো থাকুক মানবজমিন।

 

আপন আলোয় মানবজমিন থেকে আরও পড়ুন

   

আপন আলোয় মানবজমিন সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status