ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

আপন আলোয় মানবজমিন

বাংলাবাজার থেকে মানবজমিন

পরিতোষ পাল, সিনিয়র সাংবাদিক, কলকাতা
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বুধবার
mzamin

বাংলাদেশের অন্যতম প্রথিতযশা সাংবাদিক ও সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর নব্বুইয়ের দশকে। আমি তখন কলকাতার একটি পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশের পালাবদলের নানা ঘটনার রিপোর্ট করতে বাংলাদেশে যেতাম। একবার হোটেল ইন্টারকনে বিদেশি সংবাদিকদের জন্য তৈরি মিডিয়া রুমে মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। তখন তিনি ইত্তেফাক পত্রিকার কূটনৈতিক রিপোর্টার হিসেবে বেশ সুপরিচিত। সেই আলাপ থেকে পরিচয় ঘনিষ্ঠতর হয়েছিল।  তবে বেশ কিছুদিন যোগাযোগ ছিল না নানা কারণে। 
১৯৯৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ সফরে গিয়ে দেখা করেছিলাম মতি ভাইয়ের সঙ্গে। তখন তিনি বাংলাবাজার পত্রিকার সম্পাদক। তারই উদ্যোগে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল। দেখা হতেই মতি ভাইয়ের প্রথম প্রশ্ন ছিল, কি করছেন? আমি তখন বেকার। সেকথা জানাতেই তিনি আমাকে বাংলাবাজার পত্রিকার ভারত প্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু করতে বলেন।

বিজ্ঞাপন
আমিও আহ্লাদিত হয়ে কাজ শুরু করে দিই। এই ভাবেই চলছিল কিছুদিন। এই সময়ই মাদার টেরিজার মৃত্যুসংবাদ  কভার করার সুবাদে সিলেটীয় তরুণ বাংলাবাজার পত্রিকার রিপোর্টার কামাল হোসেনের সঙ্গে আলাপ। বেশ কয়েকদিন আমরা দু’জনে মিলে মাদার টেরিজার প্রয়াণ সংক্রান্ত খবর কভার করেছিলাম।

১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে কলকাতায় আমার কসবার ফ্ল্যাটে আকস্মিকভাবে হাজির কামাল হাসান। হাতে একটি খাম। জানালেন, মতি ভাই পাঠিয়েছেন তাকে এটি আমার হাতে তুলে দেবার জন্য। আমি খুলে দেখি, নতুন ট্যাবলয়েড পত্রিকা মানবজমিনের কলকাতা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার নিযোগ পত্র। আমি আপ্লুত। তিনি লিখেছেন, “বাংলাবাজার পত্রিকায় আপনাকে উপযুক্ত সম্মান দিতে পারিনি। কিন্তু মানবজমিনে আপনি সম্মানের সঙ্গে কাজ করবেন।” 

সেই যে শুরু তারপর দীর্ঘ ২২ বছর পত্রিকাটির কলকাতা প্রতিনিধি হিসেবে সবরকম দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। একটা কথা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি যে, বাংলাদেশের গণমাধ্যমের প্রতিনিধি হিসেবে কলকাতায় আমিই প্রথম নিয়োগ পেয়ে কাজ করার  গৌরব অর্জন করেছিলাম। আসলে মতি ভাই চেয়েছিলেন, দুই বাংলার মধ্যে খবরের মাধ্যমে যোগসূত্র তৈরি হোক। এমনকি মানবজমিন যখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে তখন তিনি কলকাতা থেকে মানবজমিনের সংস্করণ প্রকাশের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। ততদিনে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ও রাজনীতিবিদদের কাছেও মানবজমিনের পরিচিতি ঘটেছে নানা খবরের সুবাদে।  আমাকে তিনি আইনগত দিক খতিয়ে দেখতে সরকারি স্তরে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে খোঁজখবর করতেও বলেছিলেন। আমি বিস্তারিতভাবে খোঁজ করে নানা জটিলতার কথা জানানোর পর অবশ্য তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। 

তবে প্রথম যেদিন তিনি ট্যাবলয়েড দৈনিক প্রকাশের কথা বলেন, সেদিন অনেকের মতো আমিও দ্বিধার মধ্যে ছিলাম। ট্যাবলয়েডের যে চরিত্র তা বাংলাদেশের মতো সংরক্ষণশীল সমাজ গ্রহণ করবে কি-না সেটাই ছিল বড় প্রশ্ন। তাছাড়া কলকাতার মতো শহরে একাধিকবার ট্যাবলয়েড দৈনিক প্রকাশ হলেও শেষপর্যন্তÍ সেগুলো টিকে থাকতে পারেনি।  অবশ্য বিচক্ষণতা ও অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ মতি ভাই ট্যাবয়েডের চরিত্রটিকে বাংলাদেশের সমাজের পক্ষে উপযোগী করে তুলে ধরেছিলেন। আর তাই অল্প সময়েই মানবজমিন জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছে। সাফল্যের সঙ্গে পেরিয়ে গিয়েছে ২৫টি গৌরবময় বছর। মানবজমিনের কলকাতা প্রতিনিধি হিসেবে অনেক এক্সক্লুসিভ খবর করেছি। বিরোধী নেত্রী হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেয়া সাক্ষাৎকার প্রথম মানবজমিনে প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে প্রকাশিত হয়েছিল। 

মানবজমিনের ঈদ সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকরা লেখা দিয়েছেন পত্রিকাটির জনপ্রিয়তার কথা ভেবেই। পবিত্র সরকার, মৃণাল সেন, আবুল বাসার, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীসহ তরুণ লেখকদের কাছে লেখার জন্য যখন অনুরোধ করেছি তখন কেউই ফেরাননি। 
মানবজমিনে সাংবাদিকতা করার সুবাদে যে সম্মান পেয়েছি তা ভুলবার নয়। আর মানবজমিনের ঢাকা অফিসে যতবার গিয়েছি ততবারই পরিবারের সদস্য হিসেবেই প্রত্যেকে আমাকে আন্তরিক আতিথেয়তায় মুগ্ধ করেছেন। শামীমুল হক, কাফি কামাল, আবুল হোসেন, মিজানুর রহমান, লুৎফর রহমান, শাহীন কায়সার, কাজল ঘোষ, সাজেদুল হক, নিজাম, মুনীরসহ অনেকের সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল। শেষ দিকে সান্ধ্য টিফিনের আড্ডায় নিয়মিত অংশগ্রহণের মজাই ছিল আলাদা। তেমনি সকলের সঙ্গে ঈদের ইফতারে অংশগ্রহণের আনন্দও চিরদিন মনে থাকবে।  
মানবজমিনে শহীদুল আজম, ফারুক আহমদ ফারুখ, মিলান ফারাবী, কাজল ঘোষ, সাজেদুল হকের মতো বার্তা সম্পাদকদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাকে পেশাগতভাবে সমৃদ্ধ করেছে।  কিছু যে অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেনি তা নয়; তবে সেসব সত্ত্বেও সকলের সঙ্গে টিকে রয়েছে মধুর সম্পর্ক। অবশ্য সাজ্জাদ কাদিরের মতো একজন বিদগ্ধ গুণী মানুষের সান্নিধ্যে আমি গর্বিত হয়েছি।

মানবজমিনে প্রধান সম্পাদকের ঘরে যখনই গিয়ে বসেছি তখনই মতি ভাই জানতে চেয়েছেন কাজের নানা অভিজ্ঞতার কথা। পত্রিকাকে খবরে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য নানা পরামর্শ দিয়েছেন। বারে বারে জানতে চেয়েছেন পত্রিকার সংবাদের ক্ষেত্রে ঘাটতির কথা। মতি ভাই একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবেই পত্রিকা পরিচালনা করেছেন। আর তাই প্রতিদিন সন্ধ্যায় সকলের টেবিলে গিয়ে জেনে নেন খবরের কথা। নিজে শীর্ষ শিরোনাম ঠিক করে দেন। সেটা দূর দেশে বসেও করেন । কয়েকদিনের সফরে কলকাতায় এসে সন্ধ্যার পর তিনি কোনো কাজে ব্যস্ত রাখতেন না সেটা নিজেই দেখেছি। ওই সময় তিনি অপেক্ষা করতেন মানবজমিন থেকে আসা ফোনের জন্য। তারপর খুটিয়ে খুটিয়ে সব জিগ্যেস করতেন খবরের বিষয়ে। এমনকি লিড নিউজ কী হওয়া উচিত সেই পরামর্শও দিতেন। সম্পাদক মাহবুবা চৌধুরীকে দেখেছি পত্রিকা পরিবারের সকলকে স্নেহ ও ভালোবাসা  দিয়ে আগলে রাখতে। 
আজ রজতজয়ন্তীর এসো মিলি প্রাণের উৎসবের প্রাক মুহূর্তে মনে পড়ছে একটি দিনের কথা। মানবজমিনের সঙ্গে দীর্ঘ সম্পর্কে ইতি টেনে দেয়ার কথা জানিয়ে প্রধান সম্পাদক যেদিন চিঠি দিয়েছিলেন। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আগের দিনও যার কাছে প্রশংসা পেয়েছি তার কাছ থেকে এমন চিঠি পেয়ে  সেদিন চোখে পানি এসেছিল। তবে আজও চোখের সামনে ভেসে উঠে প্রধান সম্পাদকের ঘরে টাঙানো মানবজমিনের প্রথম পাতার বাঁধানো ছবিটি।

আপন আলোয় মানবজমিন থেকে আরও পড়ুন

   

আপন আলোয় মানবজমিন সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status