আপন আলোয় মানবজমিন
ইনি আবার কিনি
মনিজা রহমান, নিউ ইয়র্ক প্রবাসী লেখক
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বুধবার
মাঠে, প্রেসবক্সে, সংবাদ সম্মেলনে যেখানে যেতাম, সবাই অবাক হয়ে শুধু আমাকে দেখতো। মাঝে মাঝে ভ্রম হতো আমার মাথায় বোধ করি দুটো শিং আছে। বিদেশি ক্রিকেট দল এলে সহকর্মীরা যখন গটগট করে ভিতরে ঢুকে যেতো, ক্রিকেটারদের ফ্যান মনে করে সিকিউরিটি গার্ডরা আমাকে আটকে দিতো! আমি বলতাম, ‘আমাকে যেতে দাও। আমিও রিপোর্টার’। ওদের ভাবখানা থাকতো- ইনি আবার কিনি!
তখনো মানুষ অভ্যস্ত হতে পারেনি কোনো নারীকে ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে মাঠে-ঘাটে দেখার জন্য। সময়ের চেয়ে অগ্রসর ছিল বলেই দৈনিক মানবজমিন ভেবেছিল, ক্রীড়া বিভাগে নারীদের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে! বাংলাদেশের বহু তথাকথিত প্রগতিশীল দৈনিক এখনো যেটা করতে পারেনি, মানবজমিন সেটা করেছিল আজ থেকে প্রায় চব্বিশ বছর আগে!
ছাত্র থেকে চাকরিজীবী, জীবনের যে একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট, সেই সুযোগ করে দিয়েছিল মানবজমিন। ১৯৯৭ সাল থেকে পাক্ষিক ক্রীড়ালোকে লিখতাম। তারপর এক সময়ে পাক্ষিক ক্রীড়াজগত ও দৈনিক সংবাদের জলসা পাতাতেও লেখা শুরু করি। তখনো ভাবিনি ক্রীড়া সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেবো। প্রথমত পেশাটি নারীদের জন্য অপ্রচলিত, দ্বিতীয়ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করার পরে সাধারণত কেউ সাংবাদিকতা করে না।
নিয়তির লিখন বলে কথা! নয়তো একদিন কীভাবে কানে এলো, দৈনিক মানবজমিন নতুন রিপোর্টারের জন্য ইন্টারভিউ আহ্বান করেছে।
আমার ক্রীড়া সাংবাদিক হওয়াটা একদম আকস্মিক ঘটনা ছিল না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রে অংশ নিতাম, মনের মধ্যে একটা সুপ্ত বাসনা খেলা করতো আমিও একদিন লেখক হবো। মতি নন্দী ও রূপক সাহার ক্রীড়া সাহিত্য খুব স্পর্শ করতো। সাংবাদিকতার অন্য বিভাগ থেকে ক্রীড়া বিভাগের পার্থক্য ছিল, এখানে টক-ঝাল-মিষ্টি করে লেখা যায়। যে কারণে এখানে কাজ শুরুর পরে বুঝতে পারলাম, আমি আমার জায়গা খুঁজে পেয়েছি!
১৯৯৯ সালের ১লা জানুয়ারি মানবজমিনের কাজে যোগ দেই। ওই সময় ছিল পত্রিকাটির স্বর্ণযুগ। বাংলাদেশের সেরা সব রিপোর্টাররা তখন ওখানে কাজ করতো। আমি তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হইনি। এতবড় একটা জায়গায় কাজ করতে এসে সব সময় টেনশনে থাকতাম। আর আমাকেসহ ক্রীড়া বিভাগের সবাইকে সারাক্ষণ টেনশনে রাখতেন ক্রীড়া সম্পাদক শহীদুল আজম ভাই।
আজম ভাই সব সময় ‘এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট’ চাইতেন। বাংলামোটরে বাস থেকে নেমে হয়তো অফিসে ঢুকেছি, সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দিতেন মিরপুর ক্রীড়াপল্লীতে। নয়তো ধানমণ্ডি মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে। ‘যান সবার সঙ্গে কথা বলেন। বন্ধুত্ব করেন। দেখেন কোনো এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট পান কিনা!’
স্বভাবে লাজুক আর অন্তর্মুখী হওয়াতে এভাবে গোপন খবর বের করে আনতে পারতাম না। আজম ভাইয়ের চেষ্টায় তবু খামতি ছিল না। উনি অনবরত শিখিয়ে যেতেন। আজ এতকাল পরে পিছনে ফিরে তাকালে মনে হয়, আমি আসলে সাংবাদিকতার পাঠ যতটুকু শিখেছি ওনার কাছে শিখেছি। আর অবাক হয়ে দেখতাম, দৈনিক মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে। ওনার মধ্যে সম্পাদকসুলভ কোন গরিমা ছিল না। নরম গলায় সামান্য কিছু কথা বলে উনি চলে যেতেন।
প্রথমত মানুষের ‘ইনি আবার কিনি’ মনোভাব, তদুপুরি এক্সক্লুসিভ রিপোর্টের ধান্দা, মানবজমিনের আমার এক বছরের সময়কাল চ্যালেঞ্জিং ছিল বলতে হবে। হ্যাঁ, এই পত্রিকাটিতে আমি মাত্র এক বছর চাকরি করেছি। তবু এখনো যেন স্বপ্নে দেখি, হালকা পাতলা একটা শ্যামলা মেয়ে চুড়িদার পায়জামার সঙ্গে লম্বা কামিজ পরে বাংলামোটর থেকে হেঁটে আসছে, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে, কখনো নামছে!
প্রথম বলে কিনা জানি না, আজো এতকাল পরেও বহু মানুষ জিজ্ঞাসা করে, ‘ও আপনি মানবজমিনের রিপোর্টার ছিলেন না!’