আপন আলোয় মানবজমিন
সাংবাদিক জীবনে মানবজমিন
ইলিয়াস হোসেন, সাবেক স্টাফ রিপোর্টার, মানবজমিন
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বুধবার
একহাঁটু ধুলা-কাদা আর গ্রামীণ সাংবাদিকতার তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে উঠতি যৌবনে হাজির হয়েছিলাম রাজধানীর ওয়ালসো টাওয়ারের ‘মানবজমিন’ অফিসে। ভয়ে ভয়ে তারকা রিপোর্টার ও স্মার্ট সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সামনে যাই। গ্রাম থেকে এলেও কথাবার্তা শুনে উনি আমাকে গেঁয়ো বা গ্রাম্য ভাবলেন না। আন্তরিক আলোচনায় ভয়কে জয় করে কাজে নেমে পড়ি। নারী ও শিশু বিট দিয়ে শুরু করি। একপর্যায়ে, রাজনীতি ও সংসদ মূল বিট হয়ে যায়। দৈনিক এসাইনমেন্টের চাপে মাঝে মাঝে অপরাধ, আইন, সংস্কৃতি-বিনোদন বিটেও কাজ করেছি। এমনকি জঙ্গি নিয়ে সরজমিন ও ধারাবাহিক রিপোর্ট লিখেছি। অফিসের আস্থা আর নিজের নিষ্ঠায় দ্রুতই ‘মানবজমিনের ইলিয়াস’ পরিচয় প্রতিষ্ঠা পায়। শুরুর দিককার একেকটা দিন ছিল ভিন্ন ভিন্ন রোমাঞ্চে ভরা। এসাইনমেন্ট ছোট হলেও আমার নজর ছিল বড়। খড়-কুটো ঘেঁটে বা ছাই উড়িয়ে মণি-মুক্তা খুঁজতাম। এই আগ্রহকে আরও উস্কে দেন সে সময়ের প্রধান প্রতিবেদক সারোয়ার হোসেন। সততা ও নিষ্ঠায় তিনি শ্রদ্ধেয় হলেও, তাকে অত্যাচারী শিক্ষক মনে হতো মাঝে মাঝে। বিশেষ করে কাজ শেষে, বিজ্ঞাপন রুমের আড্ডা থেকে উনি যখন তুলে নিতেন। অপরাধ, আমাকে ঘিরে আড্ডা বসে। আমার একটু-আধটু গল্প-কবিতা লেখার বদঅভ্যাস ছিল। সে কারণে, মানবজমিনের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক, জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া কবি সাযযাদ কাদির স্যারের সঙ্গে এদিক-সেদিক যেতাম। এই কাব্যচর্চা ভালোভাবে নেননি সারোয়ার ভাই। তিনি বলতেন, এতে করে রাজনৈতিক প্রতিবেদনের ভাষা নরম হয়ে যায়। দিনে দিনে আমার মেন্টর হয়ে উঠেন তিনি। প্রায় দিনই কাজ শেষে আটকে রেখে অন্যদের কপি দেখতে দিতেন। অফিসের কাছেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভাড়া বাড়ির ছাদের ঘরে থাকতাম। উনি কাঁঠাল বাগানের ঢালে। অফিস শেষে ওইটুকু রাস্তা একসঙ্গে হেঁটে যেতাম। বিদায়বেলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা চলতো কিছুক্ষণ। এদিকে অফিসের কাছে বাসা হওয়ায় প্রায়ই সকালে ডাক পড়তো। মতি ভাই কখনো কখনো গাড়ি পাঠাতেন তার সোর্সদের কাছে যেতে। ডে-অফের দিনও অনেক সময় লিড রিপোর্ট দিতে ডেকে পাঠাতেন চিফ রিপোর্টার। কম বেতনের ব্যস্ততম রিপোর্টার। মাঝে মাঝে মন খারাপ হতো। কিন্তু এখন বুঝি। সেই সব দিনগুলি ছিল আমার সাংবাদিকতা জীবনের প্রস্তুতিপর্ব। মানবজমিন গড়েপিটে আমার মতো অনেককে সাংবাদিক বানিয়েছে। তারা এই যাদুর শহরে করে-কেটে খাচ্ছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে চিড়েচ্যাপ্টা গণমাধ্যমে এখনো স্বকীয়তা নিয়ে চলার চেষ্টা করে মানবজমিন স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থীরা। সাংবাদিকদের যেকোনো অনুষ্ঠানে দেখা হয়ে যায় পত্রিকাটির একাধিক সাবেক সহকর্মীদের সঙ্গে। একে অপরকে মানবজমিন বলে সম্বোধন করি, সেলফি তুলি। একপর্যায়ে বেতন ও পরিচিতি বাড়াতে বেসরকারি টেলিভিশন জনপ্রিয় ‘চ্যানেল ওয়ানে’ যোগ দেই। তারপর থেকেই ‘বায়স্কোপ সাংবাদিকতা’র নামে টেলিভিশনে চাকরি করি। ইতিমধ্যে ৪টি টেলিভিশনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিন্তু মধুর অভিজ্ঞতার ক্রমাবণতি ঘটছে। চোখের সামনে নিজ সম্প্রদায়ের স্খলনের প্রতিযোগিতা দেখে বেদনাবিধূর অনুভূতি তেরি হয়। এরমধ্যেও দেখি ‘কারও তাঁবেদারি করে না’ সেøাগান দিয়ে নিয়মিত বেরুচ্ছে ট্যাবলয়েড আকারে মিসাইল ‘দৈনিক মানবজমিন’। সেখানে শুরু থেকে এখনো কাজ করছেন আমার এক সময়ের ওস্তাদ, ডাকসাইটে রিপোর্টার শামীমুল হক। বন্ধুবর কাজল ঘোষ। তাদের প্রতি এক ধরনের চোরা ঈর্ষাবোধ করি। মনে হয়, আমিও হয়তো একটা কাগজের ‘রজতজয়ন্তি’র ইতিহাসের অংশ হতে পারতাম। মানবজমিনের উন্নতি তথা মুক্ত গণমাধ্যমের প্রত্যাশা এবং সবার মঙ্গল কামনা করছি। ইলিয়াস হোসেন, বার্তা সম্পাদক, এসএটিভি।
লেখক: সাবেক স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক মানবজমিন, সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)।