ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

আপন আলোয় মানবজমিন

গর্বের সঙ্গে বলি, আমি মানবজমিনে কাজ করেছি

নিজামুল হক বিপুল, ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রতিবেদক, ঢাকা প্রকাশ
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বুধবার
mzamin

মানবজমিন। না, উপন্যাস নয়,  দৈনিক মানবজমিন-এর কথা বলছি। বাংলাদেশের প্রথম ট্যাবলয়েড পত্রিকা। কাগজটির সঙ্গে আমার একটা আত্মিক সম্পর্ক আছে। সম্পর্কটা একেবারে মফস্বল থেকে। জন্মের শুরু থেকেই কাগজটি  দেখা ও পড়া হতো মনোযোগের সঙ্গে। তখন  থেকেই একটা ভালোলাগা, ভালোবাসার জন্ম। তারপর  সেই কাগজের একজন কর্মী হিসেবে যুক্ত হয়ে সম্পর্কের সুঁতোটা আরও গভীর হয়েছিল। এখনো মানবজমিনের ঘোরের মধ্যেই কাটে মাঝেমধ্যে।

দেশের প্রথম ট্যাবলয়েডের রজতজয়ন্তী। ১৫ই  ফেব্রুয়ারি মানবজমিন ২৫ বছর অতিক্রম করবে।

বিজ্ঞাপন
খবরটা শুনেই ভীষণ আনন্দ লাগছে।
পত্রিকাটির বার্তা সম্পাদক কাজল ঘোষ গত ২৫শে জানুয়ারি ফেসবুক মেসেঞ্জারে একটা খুদে বার্তা পাঠিয়েছেন। তাতে তিনি লিখেছেন মানবজমিন-এর ২৫ বছর অতিক্রম উপলক্ষে সাবেক সহকর্মীদের স্মৃতিচারণমূলক  লেখা প্রকাশ করা হবে। আমার একটা লেখা তিনি চেয়েছেন। ধন্যবাদ মানবজমিনকে এই ক্ষুদ্র সংবাদকর্মীকে মনে রাখার জন্য।

ঢাকায় আমার প্রথম ঠিকানা মানবজমিন। আমার গভীর সখ্য গড়ে উঠে ২০০৪ সাল থেকে। স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগ  দেয়ার পর থেকে মানবজমিন-ই ছিল আমার ধ্যান-জ্ঞান। প্রায় তিন বছর ছিলাম কাগজটিতে। জড়িয়ে আছে নানা স্মৃতি। আছে নানান অভিজ্ঞতাও।
শুরু থেকেই পত্রিকাটির অপরাধ বিভাগে কাজ করতাম। অপরাধ বিভাগে যোগ দিয়ে পেয়েছিলাম মাসুদুল আলম তুষার, আজহার মাহমুদের মতো অপরাধ বিষয়ক রিপোর্টারকে। আমার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন জামিউল আহসান সিপু। কিন্তু দিন কয়েকের মধ্যেই দেখলাম মাসুদুল আলম তুষার কাগজ  ছেড়ে দিলেন। থাকলাম বাকি তিন জন। বিভাগীয় প্রধান আজহার মাহমুদের নেতৃত্বে আমরা কাজ করছি। প্রধান প্রতিবেদক জাঁদরেল রিপোর্টার সারোয়ার হোসেন ভাই। বার্তা সম্পাদক বিখ্যাত স্পোর্টস রিপোর্টার শহিদুল আজম ভাই।

রিপোর্ট দিচ্ছি। ছাপা হচ্ছে। নিজের নামে রিপোর্ট যাচ্ছে। আনন্দে উড়ছি। মাঝেমধ্যে প্রধান প্রতিবেদক রিপোর্ট দেখে  রেগেছেন। ঘোড়ার ডিম কিছুই হয়নি। রেগে গিয়ে রিপোর্ট ছুড়ে  ফেলে দিয়েছেন। কোনো  কোনোটির জায়গা হয়েছে ময়লার ঝুড়িতে। এ নিয়ে নিজের মধ্যে ভীষণ রাগ চাপলেও সেটিকে নিবৃত করে আবারো কাজে মনোযোগ দিয়েছি। তবে যতবারই প্রধান প্রতিবেদক রাগ করেছেন ততবারই দেখেছি পরদিনের কাগজে সেই রিপোর্ট দারুণ ট্রিটমেন্ট পেয়েছে। প্রধান প্রতিবেদকের হাতের ছোঁয়ায় রিপোর্টের খোলনলচে পাল্টে  গেছে।
২০০৫ সালের ঘটনা। মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরজমিন রিপোর্ট করার জন্য একসঙ্গে আট-দশ জন রিপোর্টারকে ঢাকার বাইরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলো। কে  কোন জেলায় যাবেন সেটাও  মোটামুটি চূড়ান্ত হয়ে গেল। আমার নাম নেই দেখে মনে মনে বেশ কষ্ট পেলাম।
কিন্তু এক বিকালে হঠাৎ করেই সারোয়ার ভাই বললেন, বিপুল আসেন। তার পিছু পিছু গেলাম অফিসের ক্যান্টিনে। চা খেতে  খেতে বললেন, আপনাকে তো  নোয়াখালী পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। পারবেন? বললাম,  কোনো সমস্যা নেই।
সারোয়ার ভাই বললেন, সমস্যা আছে। নোয়াখালী খুব ক্রিটিক্যাল জায়গা। পারবেন কিছু করতে। বললাম, বাংলা ভাষাভাষি যেকোনো জয়গায় পাঠান কোনো সমস্যা নেই। রিপোর্ট করে সেটা প্রমাণ করবো।

পরদিন শুক্রবারই রওনা হলাম নোয়াখালীর পথে। সারোয়ার ভাই মনজু নামে স্থানীয় এক সাংবাদিকের নাম ও মোবাইল নাম্বার দিয়ে বললেন, তার সঙ্গে  যোগাযোগ করবেন। আমার কথা বলবেন। সে আপনাকে সব রকম সাহায্য করবে।   যথারীতি মনজুর সঙ্গে  যোগাযোগ করে কাজ শুরু করলাম। মনজু নানাভাবে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করলেন। দুই দিন পর থেকে পত্রিকায় রিপোর্ট আসতে শুরু করলো। নোয়াখালী চষে  বেড়াচ্ছি আর রিপোর্ট করছি। সারোয়ার ভাই বলছেন, রিপোর্ট ভালো হচ্ছে। দ্রুত পাঠাবেন।

প্রতিদিন সকালে হোটেল থেকে  বের হয়ে পত্রিকা হাতে নিয়ে ছুটে যেতাম- কখনো  কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাট, বসুর হাট। কখনো বা চর জব্বার,  চৌমুহনী, সেনবাগ কিংবা অন্য  কোথাও। যেদিন নোয়াখালী শহরের বহুল আলোচিত প্রত্যাশা মার্কেট নিয়ে রিপোর্ট করলাম সেদিন পুরো  নোয়াখালী জুড়ে হুলুস্থুল অবস্থা।

এখানেই শেষ নয়, নোয়াখালী সদরের বিএনপিদলীয় তৎকালীন এমপি মোহাম্মদ শাহজাহানকে নিয়ে রিপোর্ট করার পর তার লোকজন হন্যে হয়ে আমাকে খুঁজেছে মাইজদিকোর্টে। মজার বিষয় ছিল আমি যখন গাড়িতে উঠছিলাম তখন আমার সামনেই কয়েকজন আমাকে খুঁজছিল। কিন্তু তারা চিনতে না পারায় ওই যাত্রায় রক্ষা পাওয়া। তবে আমি রক্ষা  পেলেও মানবজমিন-এর নোয়াখালী প্রতিনিধি মো. হানিফ সেই যাত্রায় নানাভাবে ঝক্কি-ঝামেলার মধ্যে পড়েছিলেন। 

আরেকটি ঘটনার কথা বলতেই হয়। এটি খুব সম্ভব ২০০৬ সালের শেষে বা ২০০৭ সালের শুরুর দিকের ঘটনা। প্রিয় প্রধান সম্পাদক মতি ভাই তখন  দেশে নেই। এরমধ্যেই প্রধান প্রতিবেদক দেলোয়ার হোসেন ভাই আমাকে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে পাঠালেন কুমিল্লা।  সেখানে চলছিল পৌরসভার  মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর রাজত্ব। কুমিল্লায় ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিয়মিতই সংঘাত হচ্ছে বিভিন্ন গ্রুপ-উপ-গ্রুপে। একাধিক মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
সরজমিন অনুসন্ধান করতে গিয়ে নানান কাহিনী পাওয়া  গেল। এরমধ্যে মেয়র ও তার আত্মীয়স্বজন এবং ঘনিষ্ঠ  লোকজনের বিরুদ্ধে আধিপত্য বিস্তার, বালুমহাল দখলসহ বিস্তর অভিযোগ। ভয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। এসব নিয়ে ধারাবাহিক রিপোর্ট প্রকাশ হতে থাকলো মানবজমিনে। সেই রিপোর্ট সহ্য হচ্ছিল না মেয়রের  লোকজনের। তারা পত্রিকা স্টল  থেকে মানবজমিন কিনে নিয়ে  সেগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু বিধিবাম ধারাবাহিক প্রতিবেদন তিন বা চার পর্ব প্রকাশিত হওয়ার পর আর প্রকাশ করা যায়নি।

এরকম আরও অনেক ঘটনা আছে মানবজমিনকে জড়িয়ে। যতদিন সাংবাদিকতায় থাকবো, ততদিন মানবজমিন থাকবে আমার অস্থিমজ্জাজুড়ে।
শেষ করতে চাই প্রধান সম্পাদক শ্রদ্ধেয় মতিউর রহমান চৌধুরী প্রিয় মতি ভাইয়ের একটা কথা দিয়ে। অনেকটা অভিমান করে মানবজমিন ছেড়েছিলাম। ছেড়ে আসার সময় মতি ভাই আমাকে বলেছিলেন, আপনার বিরুদ্ধে  কোনো অভিযোগ নেই। আপনি ভালো রিপোর্টার। কখনো  কোনো রিপোর্ট নিয়ে কোনো অভিযোগ পাইনি। আপনার সততা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
মতি ভাইয়ের এই কথাটাকে মনেপ্রাণে ধারণ করে আজও পথ চলছি। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত এভাবেই চলতে চাই।
পরিশেষে বলি, মানবজমিন ছিল আমার পরিবার। আমি ছিলাম  সেই পরিবারের একজন ক্ষুদ্র সদস্য। আজও আমি গর্বের সঙ্গে বলি, আমি মানবজমিনে কাজ করেছি। সুযোগ এলে আবার কাজ করবো।
রজতজয়ন্তীতে অনেক অনেক শুভ কামনা। শতবর্ষ অতিক্রম করুক দেশের প্রথম ট্যাবলয়েড  দৈনিক।
জয়তু মানবজমিন।

লেখক: ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রতিবেদক, ঢাকা প্রকাশ।

আপন আলোয় মানবজমিন থেকে আরও পড়ুন

   

আপন আলোয় মানবজমিন সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status