ষোলো আনা
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একদিন
আইরিন আঁচল
২১ মে ২০২২, শনিবার
ঘুরতে যাওয়া সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে। এরই মাঝে একদিন ঢুঁ মারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। ১৭ই মে, মঙ্গলবার। কক্সবাজার থেকে সোজা উখিয়ার কুতুপালংয়ে। সকাল ১১টা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের গেটে ঢুকছি। পরিচয়ের জন্য আটকানো হলো। আনুমানিক ১০ মিনিট পর অনুমতি পাওয়া গেল ক্যাম্পে প্রবেশের।
ছোট্ট রাস্তায় হাজারো মানুষের ভিড়। কেউ ছুটছেন বাজারের ব্যাগ হাতে, কেউ লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন চিকিৎসা সেবার জন্য, কেউবা ছুটছেন রিলিফের বস্তা কাঁধে নিয়ে। অটোরিকশা, হ্যালোবাইক, সাইকেল সবই চলছে ক্যাম্পের ভেতরে।
হঠাৎ চোখে পড়ল ৪-৫ জন শিশু। হাতে ফোন দেখে ঘিরে ধরলো। তাদের ভাষা চট্টগ্রামের ভাষার সঙ্গে মিললেও আমি বুঝছিলাম না। পরে বুঝলাম তারা ফোনে ছবি তুলতে চায়। ক্যামেরা ধরা মাত্র ছবি তোলার জন্য ওরা প্রস্তুত। কিছুদূর এগোলাম। ২০-২৫ জন মহিলা কলস, হাঁড়ি, জগ, বালতি নিয়ে পানির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। একজন বললেন, আমাদের পানির খুবই সমস্যা। পানি আনতে হয় অনেক দূর থেকে। এই ট্যাপে সারাদিনে পানি আসে দুই বার। এই পানি দিয়েই চলতে হয়।

তার নাম জেসমিন। বয়স আনুমানিক ৪০ বছর। ৬ সন্তানের মা জেসমিন আরও বলেন, আমার পরিবারে লোকসংখ্যা ৯ জন। এতদূর থেকে পানি টেনে এনে চাহিদা ঠিকমতো পূরণ হয় না।
সময় তখন বেলা ১২টা। সূর্য ঠিক মাথার ওপরে। সরু চিকন রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। চারপাশে ছোট ছোট ঘর। রাস্তায় পাশ দিয়ে নিচে নেমে গেছে সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে দেখা যায় সেখানে রয়েছে আরও অসংখ্য ঘর। রাস্তার ধারে রয়েছে ছোট ছোট কয়েকটা দোকান। বিদ্যুৎ নেই। তবে রয়েছে সৌর বিদ্যুৎ। সৌর বিদ্যুতেই চলছে মাথার ওপরের ফ্যানটা।
হাঁটতে হাঁটতে কথা হয় এক বৃদ্ধার সঙ্গে। দরজার ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছিলেন। এগিয়ে গিয়ে কথা বললাম। জানতে চাইলাম- ছোট্ট এই ঘরে কয়জন থাকেন? তিনি বললেন, তারা স্বামী-স্ত্রী দু’জন আর ছেলের সংসারে ছেলে, তিন বাচ্চা ও বউ। মোট ৭ জন। ঘড়িতে তখন দুপুর ১টা ১৭ মিনিট। অসহনীয় গরমে অস্থির। বসলাম রাস্তার পাশের এক দোকানে। ঠাণ্ডা পানি নেয়ার চেষ্টা করলেও সেখানে ফ্রিজের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। পাশে দেখলাম একটা ছেলে বই হাতে পড়ছে। দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সে। স্কুল থেকে পড়া দিয়েছে। গল্প হলো বেশ কিছু সময়। এরপর স্কুলে নিয়ে গেল ওবায়দুল ইসলাম। পরে জানলাম এগুলো মূলত লার্নিং সেন্টার। সেন্টারে এক সারিতে পাঁচটি ক্লাসরুম। নাম আশার আলো লার্নিং সেন্টার। এর অর্থায়ন আসে ইউনিসেফ থেকে। প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস চলে। স্কুলে ৫ জন শিক্ষক রয়েছে। দু’জন আছেন রোহিঙ্গা শিক্ষক। এখানে গণিত, ইংরেজি ও বার্মিজ ভাষা শেখানো হয়। তাদের ওখানে বাংলা পড়ানো হয় না।

গণিত শিক্ষক অসীম খন্দকার বলেন, তাদের পড়াশোনার ফাঁকে হাত ধোয়া, টয়লেট ব্যবহারের পর পরিষ্কার হওয়া ইত্যাদি শেখানো হয়। ক্লাসের ফাঁকে তাদেরকে বিস্কুট দেয়া হয়।
লার্নিং সেন্টারটির প্রধান বাঙালি শিক্ষক ঊর্মি রানী দেব তখন ইংরেজি ক্লাস নিচ্ছিলেন তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের। তীব্র গরমে একটি মাত্র টেবিলফ্যান ঘুরছিল। তিনি বলেন, তাদের লেখাপড়ার আগ্রহ প্রবল। ক্লাসে উপস্থিতি সব সময় সন্তোষজনক। বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া শিক্ষার্থীরা ক্লাস ফাঁকি দেয় না। এছাড়াও তারা প্রায় সকলেই সকালে মক্তবে যায়। সেখান থেকে এখানে আসে।
ততক্ষণে দুপুর ২টা। ঘুরতে গেলাম রোহিঙ্গা বাজারে। কুতুপালং ক্যাম্প থেকে ১৫ টাকা অটোরিকশা ভাড়া। বালুখালীতে গড়ে উঠেছে বিশাল বাজার। এসব বাজারে মেলে সাহায্য পাওয়া বিভিন্ন পণ্য। যেমন বিস্কুট, সাবান, শ্যাম্পু, সেরেলাক, ছাতা, জুতা, সেনিটারি ন্যাপকিনসহ প্রায়ই সবই মেলে। কিছু পণ্য কিনলাম বাজারের থেকে প্রায় অর্ধেক দামে।

বউ আর ছেলের লাশ মাটিও দিতে পারেননি কাশেম
দুপুর আড়াইটার দিকে ফের আরেক দোকানে বিশ্রামের জন্য বসা। কথা হলো দোকানদান আবুল কাশেমের সঙ্গে। তিনি বললেন, আমার দেশে (মিয়ানমারে) ১০ কানি জমি আছে। কৃষি কাজ করে ভালোই চলতো। কিন্তু আর্মিদের অত্যাচারে টিকতে পারিনি। ২০১৮ সালে অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে আসেন। আমি কিন্তু দেশ ছাড়তে চাইনি। একদিন বাইরে থেকে এসে দেখি বাড়ির উঠানে বউ আর ছেলের গুলি করা লাশ পড়ে আছে। তাদের লাশ ফেলে রেখেই বাকি সদস্যদের নিয়ে এখানে চলে আসি। বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। এখনো রাতে ঘুমাতে পারি না। মনে হয় ফিরে গিয়ে বউ আর বাচ্চাটারে মাটি দিয়ে আসি।

সবাই ফিরতে চায় দেশে
ক্যাম্পে বিভিন্ন বয়সের প্রায় ২০ জনকে প্রশ্ন করি দেশে ফিরতে চান কিনা? প্রত্যেকেই বলেছেন- ফিরতে চান দেশে। তবে নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পর। রফিক আলীর কথা, এখন যদি বলেন এখনি যাবো। তবে জানের নিরাপত্তা চাই আগে। আমেনা বেগম বলেন, আমার বিশাল বাড়ি। বাড়িতে কাজের লোকই ছিল চারজন। আর ফসল ওঠার সময় দুপুরে ভাত রান্না হতো ২০ জনের। বাড়িতে ঘর ছিল চারটা। এখন ছেলে মেয়ে নিয়া আটজন থাকি এক ঘরে। আমার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। দূর থেকে দেখেছি। কিছুই করতে পারিনি। এক কাপড়ে চলে এসেছি। এখন যদি বাড়ি, জমি আর জানের নিরাপত্তা পাই অবশ্যই যাবো।
‘রক্তে লাল হয়েছিল আমার পায়জামা’
ক্যাম্পে হাঁটছিলাম। আনুমানিক ২৫ বছর বয়সী এক নারী দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। ক্যাম্পে গাছ খুবই কম। কিন্তু এই নারীর বাসার সামনে একটা গাছ ছায়া দিচ্ছিল বেশ। দাঁড়িয়ে থাকা দেখে চেয়ার নিয়ে এগিয়ে এলেন তিনি। বসতে দিয়ে নিয়ে এলেন পানি। আতিথেয়তায় মুগ্ধ। এরপর অনেক বিষয়ে কথা হয়। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে আলাদা ডেকে নিয়ে বলেন, এই যে গরমে টিকতে পারছেন না। এই গরম আমার কাছে কিছুই না। আমি কলেজে পড়তাম। যখন আর্মি আর ভান্তেরা নির্যাতন শুরু করে আমরা বাড়িতে থাকতে পারতাম না। ওরা গাড়ি করে আসতো দূর থেকে শব্দ শোনা যেত। যেদিন আমাকে ধরে নিয়ে যায় তার আগের দুই রাত ঘুমাতেই পারিনি। হঠাৎ দেখি পাশের বাড়ি থেকে পোড়া গন্ধ আসছে। পালিয়ে যাব এমন সময় ধরে ফেলে আর্মিরা। মুখে কাপড় বেঁধে গাড়িতে তোলে। এর পরের রাতে....। বলেতে গিয়ে থেমে যান তিনি। জানান, ছয়জন আর্মি সারারাত নির্যাতন করে তাকে। তিনি বলেন, পরের রাতে পরিবারের সবাই চলে আসি বাংলাদেশে। আমার পরনে ছিল ছাই কালারের পায়জামা। তিনদিন লাগে বাংলাদেশে আসতে। আমার পায়জামা পুরো রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। ক’দিন পর জানলাম আমি গর্ভবতী। এই অবস্থায় আমার বিয়ে হয়। এখন আমি দুই সন্তানের মা।

তিনটা বেজে গেছে। এবার ফেরার পালা। অটোরিকশার জন্য অপেক্ষা করলাম বেশ কিছুক্ষণ। এরপর হ্যালোবাইকে করে একদম ক্যাম্পের গেটে। গার্ডের সঙ্গে কথা বলে বেরিয়ে পড়লাম। এই রোহিঙ্গা ক্যাম্প দর্শন আমার জন্য ছিল এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। তীব্র তাপদাহ, মানুষের কষ্ট, রিলিফের জন্য দৌড়াদৌড়ি যেন নিয়মিত ঘটনা। বুকে রয়েছে প্রিয়জন হারানোর বেদনা।
পাঠকের মতামত
I'm from Cox's Bazar. I worked with Rohingya community and know about the camp situation. I see this is a very realistic and fact based writing after a long period. Most probably this is the best and true writing I ever found on Rohingya people and Camp situation.