কাতার থেকে
মেসির রাতে মার্টিনেজ হিরো
মতিউর রহমান চৌধুরী, কাতার
(২ বছর আগে) ১০ ডিসেম্বর ২০২২, শনিবার, ২:৪৬ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:১১ পূর্বাহ্ন

লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়াম। ৮৮ হাজার ২৩৫ জন দর্শকে ঠাসা। কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা আর নেদারল্যান্ডস লড়ছে। শুরুটা খুব ঢিমেতালে। কোনো নাটকীয়তা নেই। মনে হচ্ছিল যেন মেসি চাচ্ছেন নিষ্ঠুর পেনাল্টি শুট আউটে নিয়ে যেতে। কিছুটা বিরক্তিও ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই দৃশ্যপট বদলে যায়। ৩৫ মিনিটে সবকিছু যেন ওলটপালট হয়ে গেল। মেসির অসাধারণ এক পাস থেকে গোল করেন মলিনা। তখন এই সর্বাধুনিক স্টেডিয়ামটি যেন নাচছিল। আর্জেন্টাইন সমর্থকদের উল্লাসে কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। মেসির আনন্দ দেখে কে! মলিনাকে জড়িয়ে ধরা ছবিটা নিশ্চয় আপনারা দেখেছেন। নেইমারের চোখে তখনও পানি। তিনি কাঁদছেন। পেনাল্টি শুট আউট তার সব আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। চলতি বিশ্বকাপে তিনি এখন অতীত। আর্জেন্টাইনরা যেন জ্বলে উঠলেন। তারা পেনাল্টি পেয়ে গেলেন। পেনাল্টিতেই মেসির পা থেকে গোল আসলো। যদিও আশঙ্কা ছিল- মেসি হয়তো পেনাল্টি মিস করার পথেই হাঁটবেন। সব ধারণা অমূলক, ভুল। মেসি গোল করলেন। গোল করালেন। গোটা স্টেডিয়াম তখন আনন্দে ভাসছে। তখন কমলা রঙটা বিবর্ণ হয়ে যায়। কে জানতো এই খেলার ফলাফল পেনাল্টি শুট আউটে যাবে! নেদারল্যান্ডস দু’ গোলে পিছিয়ে থেকেও যেভাবে লড়াই করেছে- এটা ঐতিহাসিক, স্মরণীয়। খেলার শেষ মুহূর্তে ফ্রি-কিক থেকে যেভাবে নেদারল্যান্ডস বলটা আর্জেন্টিনার জালে পাঠায় তা আসলেই অবাক করে দেয়ার মতো। এখানে বলে রাখি, দর্শকদের ৮০ ভাগই ছিলেন আর্জেন্টিনার সমর্থক। খেলার ফলাফল দেখে সবাই তাজ্জব, হতবাক। এর আগেই উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছিল। হাজার হাজার আর্জেন্টাইন ভক্ত মেসি মেসি বলে চিৎকার করছিলেন। নেদারল্যান্ডস যখন অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে খেলায় ফিরে আসে তখন মেসির অবস্থা কী ছিল? মাঠের অবস্থাটাই বা কেমন? অবস্থা এমনই, মার্কিন সাংবাদিক গ্রান্ট ওয়াহল টানটান উত্তেজনার মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। প্রেসবক্স থেকে দেখছিলাম, হতাশার কালো ছায়া মেসিকে ঘিরে ফেলেছে। মেসির হয়তো আশঙ্কা ছিল-পেনাল্টি শুট আউটে খেলাটা যদি গড়ায় তখন হয়তো তার ভাগ্য বিপর্যয় ঘটবে। বিশ্বকাপ অধরাই থেকে যাবে। নেদারল্যান্ডসের ফ্রি-কিকটা ছিল অনন্য, ভিন্ন কৌশল। আর্জেন্টিনা ভাবতেই পারেনি ডাচরা চিরাচরিত নিয়ম পাল্টে বলটা থ্রো করবে। ডাচদের খেলায় ফিরে আসার জন্য দায়ী আর্জেন্টাইন কোচ স্কালোনি। কারণ তিনি দুই গোলের পর খেলাটি স্লো করতে বলেছিলেন। সুযোগটা নেয় নেদারল্যান্ডস। কিছু বাজে ঘটনাও ঘটে মাঠে। রূপ নেয় ধাক্কাধাক্কি-হাতাহাতিতে। হলুদ কার্ডের দেখা পান মেসি নিজেও। এগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত নয়। তবে বিরক্তিকর। রেকর্ডসংখ্যক ফাউল হয়েছে এই খেলায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মনে হয়েছে রেফারি অসহায়। দু’দলই মারমুখো।
যাই হোক, ১২০ মিনিট খেলাটির ভাগ্য অনির্ধারিতই থেকে গেল। যদিও বাড়তি ৩০ মিনিট বল আর্জেন্টিনার নিয়ন্ত্রণেই ছিল, কিন্তু কোনো গোল আসেনি। ৩৫ বছর বয়স্ক লিওনেল মেসির এটাই শেষ বিশ্বকাপ। কী হয়, কী হবে খেলার ভাগ্য- তা নিয়েই যত জল্পনা, হিসেব-নিকেশ। পেনাল্টি শুট আউট। এটা তো এক অনিশ্চিত লড়াই। যে কেউ জিততে পারেন। স্নায়ুর খেলা, গোলকিপারের পারদর্শিতা। এই শুট আউটই অনেকগুলো খেলার ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। ক্রোয়েশিয়া নতুন করে জেগে উঠেছে।বিশ্বকাপজয়ী স্পেন আগেই বিদায় নিয়েছে। জাপানিরা তো কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছেড়েছেন।
মেসি অগণিত দর্শক, ভক্তদের হতাশ করেননি। আর্জেন্টাইন গোলকিপার মার্টিনেজ দুটো শট আটকে দিয়ে মেসির স্বপ্ন জিইয়ে রাখেন। এর পরের ইতিহাস তো সবার জানা। মার্টিনেজ হলেন দিনের হিরো।রেফারি যখন বিজয়ের বার্তা দিলেন তখন মার্টিনেজকে নিয়ে যেন ফুটবল খেলা হচ্ছে। মেসি এর বাইরে নন। তিনিও জড়িয়ে ধরছেন। তাকে নিয়েও আর্জেন্টাইনরা আনন্দে মেতে উঠলেন। উল্লাস চারদিকে।নেদারল্যান্ডসের প্লেয়াররা তখন ঘাসের উপরে গড়াগড়ি করছেন। মেসি তখন এগিয়ে গেলেন সান্ত্বনা দিতে। হাত বাড়ালেন কোচ লুইস ভ্যান গালের দিকেও।
মিক্সডজোনে উত্তেজক পরিস্থিতি। একজন সাংবাদিকের প্রশ্ন শুনে মেসি অনেকটা রেগে যান। ডাচদের সঙ্গে লড়াইয়ে তিনি তখন ক্লান্ত। পরিস্থিতি অবশ্য বেশিদূর গড়ায়নি। স্টেডিয়াম থেকে বের হয়ে দেখা গেল আরেক দৃশ্য। সামনে এগোবার সব পথই বন্ধ। অগণিত আর্জেন্টাইন সমর্থক তখন মাঠের বাইরে আনন্দে ফেটে পড়েছেন। অনেকেই টিকিট পেয়েছিলেন। অনেকেই পাননি। যারা পাননি তাদের আনন্দই ছিল সবচাইতে বেশি। গোলের শব্দে তারা সারাক্ষণই নেচেছেন। এর যেন শেষ হয় না। মিডিয়া বাসে উঠতে পাঁচ মিনিটের পথ। সেটা পার হলাম কুড়ি মিনিটে। পথেও ট্রাফিক জ্যাম ছিল। যা সাধারণত হয় না। মেসিকে ঘিরেই আর্জেন্টাইনরা স্বপ্ন দেখছেন। ম্যারাডোনার হাতে ট্রফি যেমন ছিল মেসির হাতে তা কেমন দেখাবে। কাতার বিশ্বকাপ অনেক অঘটনের জন্ম দিয়েছে। তবে ভালো কিছু খেলা অনেকদিন বাদে দর্শক উপভোগ করেছেন। এটা বলতেই হবে, ব্রাজিল আউট হয়ে যাওয়ায় বিশ্বকাপ যেন অনেকটা ম্লান হয়ে গেছে। নেইমার তো ইতিমধ্যেই ইঙ্গিত করেছেন- তিনি আর দলের হয়ে খেলতে চান না। যদিও এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। এরকম ঘটেই থাকে।
সেমিফাইনালে কী হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়। '৮৬ বিশ্বকাপের হিরো দিয়েগো ম্যারাডোনা কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডকে বিদায় করে রীতিমতো চাঞ্চল্য তৈরি করেছিলেন। তার দেয়া দ্বিতীয় গোল ইতিহাস হয়ে রয়েছে। ববি রবসন বলেছিলেন, এটা ছিল সত্যিকার অর্থেই অলৌকিক এক গোল। মাত্র ১২ সেকেন্ডে ৬০ গজ দৌড়ে যে গোলটি করেন তা নিয়ে গবেষণা হয়েছে বহুবছর। শেষ কথা, মেসির রাতে মার্টিনেজই হিরো।