বিশ্বকাপ ম্যাগাজিন
ম্যারাডোনাই আমাকে বিশ্বকাপে টেনেছিলেন
মতিউর রহমান চৌধুরী, প্রধান সম্পাদক
(২ বছর আগে) ১৪ নভেম্বর ২০২২, সোমবার, ৮:০৯ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১:১৭ অপরাহ্ন

বলতে দ্বিধা নেই, ম্যারাডোনাই আমাকে বিশ্বকাপে টেনেছিলেন। টিভির পর্দায় তার জাদু দেখে কখন যে মজেছিলাম তা কিন্তু বলতে পারবো না। শুধু আমি কেন? তামাম ফুটবল দুনিয়াই মেতেছিল। ’৮৬-র বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার অস্বাভাবিক ফুটবলশৈলী আর জাদু দেখে কে না মজেছিলেন বলুন।
ফুটবলের রাজপুত্রকে সরাসরি দেখার আগ্রহ তখন থেকেই। স্বপ্ন আর কল্পনায় ভাসছিলাম। এভাবে কতো রাত যে কাটিয়েছি তা এখন আর ইয়াদ নেই। ’৮৬ থেকে ’৯০। চার বছর শেষে যখন ইতালি বিশ্বকাপের আওয়াজ চারদিকে তখন মনের ভেতর এক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। কীভাবে ইতালি যাওয়া যায়? আমি কিন্তু তখন বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ইত্তেফাকের কূটনৈতিক রিপোর্টার। ফুটবল নয়, কূটনীতির মারপ্যাঁচ দেখা আর রিপোর্ট করাই আমার কাজ। যদিও বিশ্বকাপ ক্রিকেট কভার করে নাম লিখিয়েছি স্পোর্টস রিপোর্টারের খাতায়। কীভাবে যাবো ইতালি? বললেই তো প্লেনে ওঠা যায় না। ভিসা, টিকিট, অর্থ ছাড়া চিন্তাই করা যায় না। সর্বোপরি অ্যাক্রিডিটেশন। কোনোটাই নেই আমার কাছে। আছে শুধু অদম্য ইচ্ছা আর প্রাণশক্তি। খোঁজ নিয়ে জানলাম ফুটবল ফেডারেশনে কোনো অ্যাক্রিডিটেশন আসে কিনা? জবাব এলো, কেউ যাবার আগ্রহ ব্যক্ত করে না তাই ফিফা বাংলাদেশকে কোনো অ্যাক্রিডিটেশন পাঠায় না। তাছাড়া বাংলাদেশ তো ফুটবলে কোনো শক্তি নয়।
বিশ্ব কেন, দক্ষিণ এশিয়াতেও নেই বাংলাদেশ। ধাক্কা খেলাম প্রচণ্ডভাবে। স্বপ্ন কি তাহলে মরে যাবে? একদিন সাহস করে ঢুকে পড়লাম সচিবালয়ে। আজ মঞ্জু ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমার স্বপ্নের কথা বলবো। বলছি- আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর কথা। দৈনিক ইত্তেফাকের অন্যতম কর্ণধার। সম্পাদক থেকে এরশাদের মন্ত্রী। সম্পর্ক ছিল চমৎকার। আজও অটুট। ভালো-মন্দ আর সুখ-দুঃখের নিত্যদিনের সঙ্গী। একসঙ্গে এখনো অফিস করি। আড্ডা দেই। নানা বিষয়ে মতের অমিল থাকলেও সম্পর্কে কোনো ছেদ পড়ে নি। যাই হোক, সাহস করে মঞ্জু ভাইকে আমার ইচ্ছার কথা বললাম। অবাক হলেন না। শুধু বললেন, কী করতে হবে বলো। জানেন তো অনেক টাকা লাগবে? ভিসাও নেই। অ্যাক্রিডিটেশন হয়তো পাওয়া যাবে। সঙ্গে সঙ্গে তার এক ব্যবসায়ী বন্ধুকে ফোন করলেন। বললেন, আপনি তো ইতালির সঙ্গে ব্যবসা করেন। স্থানীয় দূতাবাসের সঙ্গে আপনার খাতির। আমার একটা ভিসা দরকার। অপরপ্রান্ত থেকে জবাব এলো ঠিক আছে পাঠিয়ে দেন।

টিকিট, ডলার দুটোই হবে। আগে ভিসা নিয়ে এসো। ভিসা পেয়ে গেলাম। আবেগ চেপে ধরে রাখতে পারলাম না। বার্তা সম্পাদক সারওয়ার ভাইকে বললাম, আমি ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করছি। খেলাপাগল গোলাম সারওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার পরিকল্পনার কথা বললেন। ইত্তেফাকে তখন খেলা ভেতরের পাতায় গুরুত্বহীনভাবে ছাপা হতো। বাসায় যখন স্ত্রী মাহবুবাকে বললাম আমি ইতালি যাচ্ছি। তখন সে হতবাক। একমাস কী করে ছোট বাচ্চাকে নিয়ে থাকবো? এটাই তার চিন্তা। ইতালি না হয় গেলাম। মাঠে ঢুকবো কি করে? অ্যাক্রিডিটেশন তো নেই। মঞ্জু ভাই ইতালিতে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমানকে ফোন করলেন। বললেন, আমার রিপোর্টার মতি ইতালি যাচ্ছে। ফিফা’র মিডিয়া কমিটিকে একটা চিঠি লিখে দিলে উপকার হবে। রাষ্ট্রদূত আমাকে আগে থেকেই চিনতেন। হ্যাঁ-সূচক জবাব এলো তার কাছ থেকে। এরপরও দুশ্চিন্তা। অ্যাক্রিডিটেশন হবে তো? ৮ই জুন থেকে বিশ্বকাপের পর্দা উঠবে। সম্ভবত ৪ঠা জুন রওয়ানা দিলাম অন্তহীন অনিশ্চয়তা নিয়ে।
রোম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেখা পেলাম কলকাতার চার সাংবাদিকের। তারা অ্যাক্রিডিটেশন নিয়েই যাচ্ছেন। ভারতীয় সাংবাদিকরা ’৮২ বিশ্বকাপ থেকেই খেলা কভার করছেন মাঠে হাজির থেকে। আবার কিছুটা শঙ্কিত হলাম। ফিফা’র ছাড়পত্র যদি না পাই! এই ভাবনার মধ্যেই জয়ন্ত চক্রবর্তীকে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। আমরা একসঙ্গে কলকাতার যুগান্তরে কাজ করতাম। আমি ঢাকা প্রতিনিধি, জয়ন্ত প্রিন্সিপাল করেসপনডেন্ট। তখন থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব। হোটেলও ঠিক করিনি। একসঙ্গে থাকবো- এমনটাই চিন্তা করলাম। তখন হোটেল নিয়ে এতটা চিন্তা করতে হতো না। হোটেল পেয়ে গেলাম। প্রিসিলিয়া হোটেলটি মন্দ ছিল না। পরে অবশ্য হোটেল বদল করেছিলাম। রাত কাটিয়ে সকাল হতেই আমি গেলাম দূতাবাসে। ওরা গেল ফিফা’র মিডিয়া সেন্টারে। রাষ্ট্রদূত চিঠি লিখেই রেখেছিলেন। আমার হাতে চিঠি ধরিয়ে দিয়ে কাকে যেন ফোন করলেন। বললেন, আপনি মিডিয়া সেন্টারে যান। আশা করি, সমস্যা হবে না। মিডিয়া সেন্টারে প্রবেশ করতেই এক মহিলা এসে বললেন, ফিফা’র ক্লিয়ারেন্স লেটার নিয়ে এসেছেন? আমি তাকে রাষ্ট্রদূতের চিঠি দিয়ে বললাম, এটাই আমার ক্লিয়ারেন্স। অবাক হলেন মহিলা। বললেন এখানে অপেক্ষা করুন, আমি আসছি। কোথায় যেন গেলেন? পনের মিনিট পর ফিরে এসে বললেন, ক্লিয়ারেন্স পেয়েছি। আপনার অ্যাক্রিডিটেশন হয়ে গেছে। আমার খুশি দেখে কে? মহিলা বোধকরি বুঝতে পারলেন আমার মনের কথা। হেসে দিয়ে বললেন, এই নিন আমার কার্ড। যেকোনো প্রয়োজনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। মিডিয়া সেন্টারে তখন আমার রুমমেট জয়ন্ত অপেক্ষা করছিল। বুকে ব্যাজ দেখে সে খুশি হলো। যাক- তোমার স্বপ্ন সফল হচ্ছে। এভাবেই ইতালি বিশ্বকাপে আমার যাত্রা শুরু হলো।

বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে গর্বিত মনে হলো। রিপোর্ট পাঠাতে শুরু করলাম। ফ্যাক্সে রিপোর্ট পাঠানো যে কি হাঙ্গামা ছিল তা আর বলার নেই। রিপোর্ট অর্ধেক যাওয়ার পর লাইন কেটে যায়। ফোনে বলতে হতো। ফোন সংযোগও ভালো ছিল না। রীতিমতো চিৎকার করতে হতো। বিদেশি সাংবাদিকদের কৌতূহল ছিল আমরা কেন হাতে লিখি? ল্যাপটপ নেই কেন? বলতাম আমাদের দেশে এখনো কম্পিউটার চালু হয়নি। ল্যাপটপ পাবো কোথায়? যে স্বপ্ন নিয়ে ইতালি গেলাম প্রথম দিনেই কি তার মৃত্যু ঘটবে, সেটা কি করে হয়? বলুন তো, ’৮৬ বিশ্বকাপের নায়ক ফুটবলের রাজপুত্র ম্যারাডোনা কি আফ্রিকার এক অখ্যাত ফুটবল শক্তির কাছে হেরে যাবেন? ভাবনার মধ্যেই নেই। ক্রিকেট যেমন এক অনিশ্চয়তার খেলা ফুটবলও কিন্তু সে রকমই একটা খেলা। ৮ই জুন। রোমের অলিম্পিক স্টেডিয়াম। উদ্বোধনী ম্যাচ। আর্জেন্টিনা লড়বে ক্যামেরুনের সঙ্গে। ফুটবল বিশ্বের কেউই তখন ভাবেননি কোন অঘটন ঘটতে চলছে বা ঘটবে। তা কি সব সময় হয়? বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার জালে যখন বল প্রবেশ করলো তখন ফুটবল দুনিয়া হতবাক। রজার মিলার সে গোল আজও চোখে জ্বল জ্বল করে ভাসে। ম্যারাডোনার চোখে তখন পানি। গ্যালারিভর্তি দর্শক অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন। অনেক চেষ্টা করেও আর্জেন্টিনা খেলায় ফিরতে পারলো না।
খেলা শেষে ম্যারাডোনা মাঠ ছাড়তে চাইছিলেন না। এটা কি করে হয়? কান্নাভেজা কণ্ঠে মিডিয়াকে বলেছিলেন, বিশ্বকাপ শেষ হয়নি। সামনে অনেক চমক আছে। চমক ছিল ঠিকই। কিন্তু পশ্চিম জার্মানির কাছে ফাইনালে আর্জেন্টিনা হেরে যায়। পশ্চিম জার্মানি তকমা পায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের। লুথার ম্যাথিউস ও ক্লিনসম্যানের আনন্দ দেখে কে? যদিও পশ্চিম জার্মানি গোড়া থেকেই হট ফেভারিট ছিল। তাই বলে ম্যারাডোনার আকর্ষণ কি কমেছিল? একদম নয়। বাংলাদেশে তো ম্যারাডোনাই ছিলেন এক নম্বরে। তাকে ঘিরেই বাংলাদেশ বিশ্বকাপের সময় আর্জেন্টিনা হয়ে যায়। ইদানীং অবশ্য ব্রাজিলের পতাকাও কম নয়। তবে দেশটা যে আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র মতো আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলে বিভক্ত হয়ে যায়- এতে কোনো সন্দেহ নেই। ইতালি বিশ্বকাপে যে স্বপ্ন নিয়ে গিয়েছিলাম তা কিন্তু পুরোপুরি অসফল হয়নি। আমার কাছে মূল আকর্ষণ ছিলেন ম্যারাডোনা। তার মুখোমুখি হয়েছিলাম। নিয়েছিলাম তার সাক্ষাৎকার। এটা কি কম পাওনা? এ নিয়ে বিভিন্ন সময় লিখেছি। ফুটবলের এই ঈশ্বরের দেখা পেলেও মন ভরেনি। স্প্যানিশ ভাষা জানলে হয়তো আরও অনেক কিছুই জানা যেতো। দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে কোচ হিসেবে তাকে দেখেছি। ১৯৯৪ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপেও তার চোখে পানি দেখে গোটা বাংলাদেশ কেঁদেছে।
তাকে নিয়ে একাধিক সাক্ষাৎকার দিয়েছি টিভিতে। বিদেশি সাংবাদিকদের একটাই প্রশ্ন- তোমাদের দেশ তো বিশ্বকাপে খেলে না। তারপরও তোমরা এতটা ফুটবল ভালোবাসো কেন? ম্যারাডোনাকে নিয়ে এই মাতমই বা কেন? কি বলবো বলুন? ম্যারাডোনার ক্রেজ এত বেশি যে, তাকে নিয়ে বউ তালাকের ঘটনাও ঘটেছে এই দেশে। শুধু কি তাই? নফল নামাজ আর সড়ক অবরোধের ঘটনাও ঘটেছিল।
বিশ্বকাপের অনেক স্মৃতি। এই ক্ষুদ্র পরিসরে লেখা সম্ভব নয়। বই লেখার ইচ্ছা আছে। এবারও যাচ্ছি কাতারে। এটা হবে আমার ষষ্ঠ বিশ্বকাপ।