বিশ্বকাপ ম্যাগাজিন
যেখানে আলাদা রাশিয়া বিশ্বকাপ
মো. সামন হোসেন, স্পোর্টস ইনচার্জ, মানবজমিন
(১০ মাস আগে) ১৪ নভেম্বর ২০২২, সোমবার, ৭:৩২ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৩:৫৯ অপরাহ্ন

উত্তরটা অনেকের কাছ থেকেই শুনতে পারেন। তবে কখনো ফিফা সভাপতির কাছ থেকে শুনতে যাবেন না। আয়োজক হিসেবে যেকোনো আয়োজনকে সফল বলার একটি দায়বদ্ধতা থাকে। সেই দায়বদ্ধতা মেনে প্রতিটি বিশ্বকাপের শেষের দিকে ফিফা সভাপতি বলে দেন, আমরা সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপটা দেখলাম এবার। অথবা এ রকমই কিছু একটা। এবারো যেমন সেই ধারাবাহিকতা রেখে মস্কোর লুজনেকি স্টেডিয়ামে ফ্রান্স ক্রোয়েশিয়ার ফাইনালের আগেরদিন এক সংবাদ সম্মেলনে জিয়ান্নি ইনফান্তিনো বলেছিলেন, রাশিয়া বিশ্বকাপই সর্বকালের সেরা। সাংবাদিক হিসেবে সেই সংবাদ সম্মেলন কভার করেছিলাম আমি। কেন রাশিয়া বিশ্বকাপ এযাবৎ কালের সেরা বিশ্বকাপ এর ব্যাখ্যা তিনি মাঠে ও মাঠের বাইরের বেশকিছু বিষয় তুলে ধরেছিলেন।
আসলেই কি সেরা? কিংবা যদি সেরা না-ও হয়, ইতিহাস কীভাবে মনে রাখবে রাশিয়া বিশ্বকাপকে? যেকোনো বিশ্বকাপকে সেরা হতে হলে সবার আগে দারুণ সব ম্যাচ উপহার দেয়ার শর্তটা পূরণ করতে হয়। সেটা অবশ্য রাশিয়া বিশ্বকাপ ভালোভাবেই পেরেছে। দুর্দান্ত কিছু ম্যাচ হয়েছে, দুর্দান্ত কিছু গোলও।
দক্ষিণ কোরিয়ার জার্মানিকে হারানোটাকে যদি অঘটন বলেনও মেক্সিকো কিন্তু দারুণ খেলেই হারিয়েছে গতবারের চ্যাম্পিয়নদের। আর্জেন্টিনার আইসল্যান্ডের সঙ্গে ড্র করা, ক্রোয়েশিয়ার কাছে হারা, ওদিকে জাপানের কলম্বিয়াকে হারানো, বেলজিয়ামের সঙ্গে দুই গোলে এগিয়ে যাওয়া, ইরানের পর্তুগালের সঙ্গে ড্র করা, স্পেনের সঙ্গে মরক্কোর ড্র! এই ম্যাচগুলো বুঝিয়ে দিয়েছে, বড় দল হলেই জয় ধরে নিয়ে মাঠে নামার দিন শেষ। নইলে বিশ্বকাপের আগে কে ভেবেছিল ক্রোয়েশিয়া ফাইনালে উঠবে, সুইডেন খেলবে কোয়ার্টার ফাইনালে!

শেষ মুহূর্তের নাটকীয়তাও এই বিশ্বকাপটা আলাদা করে রাখবে আগেরগুলোর চেয়ে। শেষ মুহূর্তের গোল তো যেন নিয়মই হয়ে গেছে এই বিশ্বকাপের। এবার ১৯টি গোল হয়েছে যোগ হওয়া সময়ে। শেষ ৫ মিনিটে হয়েছে ২৯টি গোল। ১৭টি ম্যাচের ফল বদলে গেছে শেষ ৫ মিনিটের এই নাটকীয়তা! সবচেয়ে বড় উদাহরণ তো সুইডেনের বিপক্ষে শেষ বাঁশি বাজার মুহূর্তকাল আগে টনি ক্রুসের সেই ফ্রি-কিক থেকে গোল। ফুটবল আকাশের বড় তারারা বিশ্বকাপে জ্বলে উঠবেন-বিশ্বজোড়া ফুটবল-ভক্তদের এটাই থাকে প্রত্যাশা। এই জায়গায় রাশিয়া বিশ্বকাপ অবশ্য কিছুটা হতাশ করেছে। লিওনেল মেসি, নেইমার, টমাস মুলাররা আহামরি কিছু করতে পারেননি। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর শুরুটা দুর্দান্ত হলেও শেষটা খুব একটা ভালো হয়নি। তবে নতুন তারা উপহার দেয়ার ধারাটা টিকে থাকলো এই বিশ্বকাপেও। ব্রাজিল বিশ্বকাপ যেমন হামেস রদ্রিগেজকে নতুন করে চিনিয়েছিল ফুটবল বিশ্বের কাছে এই বিশ্বকাপ চেনাল কিলিয়ান এমবাপ্পেকে।
আর ভিএআরের কথা তো না বললেই নয়। এই প্রযুক্তির সঙ্গে বিশ্বকাপ কতোটা খাপ খাওয়াতে পারবে, সেই সন্দেহ ছিল টুর্নামেন্ট শুরুর একেবারে আগমুহূর্তেও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দু’একটি ব্যতিক্রম বাদে রাশিয়া বিশ্বকাপে ভিএআর খুব সফলভাবেই ব্যবহৃত হয়েছে। মানবীয় ভুল যে অনেক কমে এসেছে, এটা স্বীকার করবেন সম্ভবত সবাই। সেরা হোক বা না হোক, নতুন প্রযুক্তি দিয়ে বিশ্বকাপকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দেয়ার জন্য হলেও রাশিয়ার এই টুর্নামেন্টকে আলাদা করে মনে রাখবে সবাই। এর বাইরে রাশিয়া বিশ্বকাপ দর্শকদের মন কেড়েছে। ১৯৮০ সালের মস্কো অলিম্পিক বর্জন করেছিল প্রায় অর্ধেক বিশ্ব। সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায়। সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই; তবে পশ্চিমের সঙ্গে রাশিয়ার বিরোধটা ছিল আগের মতো। ভøালাদিমির পুতিনের বড় সাফল্য এখানেই। সিরিয়া ইস্যুতে মার্কিনিদের নেতৃত্বে পশ্চিমাদের সঙ্গে বিরোধ, ইউক্রেন নিয়েও একমত ছিল না। এত কিছু সত্ত্বেও ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ বয়কটের ডাক আসেনি কোনো তরফ থেকে। দারুণ কূটনৈতিক সাফল্যে ওই শঙ্কাটা দানা বেঁধে উঠতে দেয়নি কখনো রাশিয়া। আর এ কারণেই ২০১৮ সালে সফল এক বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় রাশিয়ায়।
২০১৮ বিশ্বকাপের স্বাগতিক হিসেবে রাশিয়াকে নির্বাচন করা হয় ৮ বছর আগে। সিদ্ধান্তটি বিতর্কিত ছিল তখনো। পুতিনের তাতে কি-ই বা যায়-আসে! বিশ্বকাপ আয়োজনের আগের ৮ বছরে দেশের ভেতরে তার জনপ্রিয়তায়ও ফাটল ধরেনি। রাশিয়া বিশ্বকাপ আয়োজনে ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করে রাশিয়া। ১১ শহরের ১২ স্টেডিয়ামে হয় বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো। বিশ্বকাপের সময় রাশিয়ায় আসে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ। এত্ত এত্ত লোক একসঙ্গে নিকট ভবিষ্যতে রাশিয়ায় আর কোনোদিন আসেনি, ভবিষ্যতে হয়তো আসবেও না। এসব মাথায় না রেখে বিশ্বকাপ দেখতে আসা মানুষের জন্য নতুন নতুন স্থাপনা তৈরি করে রাশিয়া সরকার। সমর্থকদের কাছে এই বিশ্বকাপ ছিল বিশালত্ব। শহর থেকে শহরের দূরত্ব। নিজ নিজ দলকে অনুসরণ করে এক শহর থেকে আরেক শহরে ছুটেছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-জার্মানির সমর্থকরা। কিন্তু কাজটি তো মোটেও সহজ ছিল না। স্বাগতিক শহরগুলো কতো ছড়ানো, তা বোঝার জন্য দু’টি তথ্যই যথেষ্ট। এক, এই ১১ শহরের অবস্থান চারটি ভিন্ন টাইম জোনে। দুই, সবচেয়ে পশ্চিমের কালিনিংগ্রাদ স্টেডিয়াম থেকে সবচেয়ে পূর্বের ইয়েকাতেরিংবার্গ স্টেডিয়ামের দূরত্ব আড়াই হাজার কিলোমিটার; যা মস্কো থেকে লন্ডনের দূরত্বের সমান।

এক শহর থেকে আরেক শহরে ছোটা তাই কম হ্যাপার হবে না! এসব দূরত্বকে সমর্থকদের জন্য হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছিল আয়োজকরা। ফ্রি করে দেয়া হয়েছিল যানবাহন। বিনা টিকেটে এক শহর থেকে দর্শকরা ছুটে গেছেন আরেক শহরে।
ফ্রান্স আর ক্রোয়েশিয়ার ফাইনাল ম্যাচটি বিশ্বজুড়ে উপভোগ করেছে ১.১২ বিলিয়ন দর্শক। বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা জানিয়েছিল ফাইনালের আগ পর্যন্ত বিশ্বকাপ দেখেছে ৩.৫৭২ বিলিয়ন দর্শক। যা মোট জনগোষ্ঠির প্রায় অর্ধেক। ৪ বছর থেকে তদূর্ধ্ব বয়সের এ দর্শকরা অন্তত এক মিনিট বা তার বেশি সময় ধরে এ খেলা উপভোগ করেছে বলে জানায় বিশ্ব ফুটবলের পরিচালনা পরিষদ। যা ২০১৪ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত আসরের তুলনায় বেড়েছে ১০.৯ শতাংশ। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে যার সংখ্যা ছিল ১.৯৫ বিলিয়ন। ফিফা জানায়, ৮৮৪.৩৭ মিলিয়ন দর্শক ঘরে বসে টেলিভিশনের পর্দায় খেলা দেখেছে। আর ২৩১.৮২ মিলিয়ন খেলা দেখেছে ঘরের বাইরে কোনো জায়গায় অথবা ডিজিটাল মাধ্যমের সাহায্যে।
শুধু দর্শক কেন সাংবাদিকদের কাছেও বিরাট কঠিন হয়ে উঠতো রাশিয়া বিশ্বকাপ। একদিকে খরুচে, আরেক দিকে দূরত্ব। দু’টিই দূর করে দিয়েছিলেন আয়োজকরা। রাশিয়ার ১১টি শহরের ১২টি স্টেডিয়ামে সর্বমোট ৬৪টি ম্যাচ আয়োজন করা হয়। একটি শহর থেকে আরেকটি শহরের দূরত্ব ছিল কমপক্ষে ৫শ’ থেকে সর্বোচ্চ ৩ হাজার কিলোমিটার। যা আয়োজকদের আন্তরিকতায় হাতের মুঠোয় এসেছিল সাংবাদিকদের। দারুণ এবং বিলাসবহুল ট্রেনে বিনা পয়সায় ভ্রমণ করেছেন সাংবাদিকরা। বিমানের টিকিটও ছিল হাতের নাগালে। যার ফলে বাধাবিঘœভাবেই রাশিয়া বিশ্বকাপ কাভার করেছেন সাংবাদিকরা।
মন্তব্য করুন
বিশ্বকাপ ম্যাগাজিন থেকে আরও পড়ুন
বিশ্বকাপ ম্যাগাজিন সর্বাধিক পঠিত

জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]