ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

বিশ্বকাপ ম্যাগাজিন

ম্যারাডোনাকে সবার সেরা বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই

জয়ন্ত চক্রবর্তী, কলকাতা

(১ বছর আগে) ১৪ নভেম্বর ২০২২, সোমবার, ৬:৪৯ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৪:০০ অপরাহ্ন

mzamin

সালটা উনিশ শ’ আটানব্বই। ফ্রান্সে সেবার বিশ্বকাপের আসর বসেছিল। প্যারিস এই স্টাদে দা ফ্রাসে আন্তর্জাতিক মিডিয়া সেন্টার। এক দুপুরে ফিফা ঘোষণা করলো বিশ্বকাপে সর্বকালের সেরা ফুটবলারকে বেছে নেয়া হবে। ভোট দিতে পারবেন বিশ্বকাপ কভার করতে আসা সাংবাদিককুল। এই মর্মে ফরমও বিতরণ করা হলো। দুজনের নামের পাশে যে টিক বেশি পড়বে এ তো জানা কথা। ব্রাজিলের পেলে এবং আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা। পেলে খেলা ছেড়েছেন বেশ কয়েকবছর। চুরানব্বই আমেরিকা বিশ্বকাপ থেকে ম্যারাডোনা নির্বাসিত হয়েছেন মাত্র চার বছর আগে ডোপিং-এর দায়ে।

বিজ্ঞাপন
দুজনেই হাজির ফ্রান্স বিশ্বকাপে। পেলে ব্রাজিলের বিখ্যাত ও গ্লোবো পত্রিকার জন্য কলম ধরেছেন। তাছাড়া ফিফা’র তিনি ব্র্যান্ড আম্বাসেডর. ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনার বিখ্যাত রেডিও স্টেশন রেডিও- থ্রি’র ভাষাকার. ভোট গণনা বিশ্বকাপ ফুটবল ফাইনালের আগের দুপুরে। 

স্টাদে দা ফ্রাসের মিডিয়া সেন্টারে দুরু দুরু বক্ষে উপস্থিত আমরা ভোটদাতা সাংবাদিকরা। আমাদের দেশ বিশ্বকাপ খেলে না, তবু আমাদের ভোটাধিকার আছে। একটু আত্মগ্লানি  অনুভব করেছিলাম সেদিন? হতে পারে আবার নাও হতে পারে। ভোট গণনা শুরু হলো। প্রথম থেকেই ম্যারাডোনা এগিয়ে। গণনা কেন্দ্রে উপস্থিত ম্যারাডোনার মুখ উজ্জ্বল হচ্ছে। আমরা ম্যারাডোনার ভক্তরাও উচ্ছ্বসিত। গণনা এগোচ্ছে। হঠাৎ যেন পেলের দিকের ভোট বাড়তে লাগলো। পেছন থেকে এসে পেলে ধরে ফেললেন ম্যারাডোনাকে। তারপর একসময় টপকেও গেলেন। প্যারিসে স্টাদে দা ফ্রান্সের আন্তর্জাতিক হল থেকে হঠাৎই ক্ষুব্ধ ম্যারাডোনা সদলবলে বেরিয়ে গেলেন। আমরা সাংবাদিকরা ছুটতে লাগলাম ম্যারাডোনার পেছনে। মিডিয়া সেন্টারের সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে ম্যারাডোনা তার স্ট্যান্ডিং প্রেস কনফারেন্স সারলেন। স্প্যানিশ ভাষায়  বললেন- আমি এই ভোটের ফল মানি না। পেলে ফিফা’র ব্র্যান্ড আম্বাসেডর বলে জোচ্চুরি করা হয়েছে। আই অ্যাম দা গ্রেটেস্ট। আমিই বিশ্বসেরা।

 আমি এই ভোটের ফল মানি না। হাতের এক গোছা কাগজ ছিঁড়ে ম্যারাডোনা চলে গেলেন মিডিয়া সেন্টার ছেড়ে। আমরা সাংবাদিকরা দৌড় লাগালাম নিজেদের কম্পিউটার আর ল্যাপটপের উদ্দেশ্যে। পেলে বনাম ম্যারাডোনারের থেকে ভালো খবর আর কী হতে পারে  এই বিশ্বকাপের বাজারে? স্বীকার করছি আমি চূড়ান্ত ফর্মে পেলের খেলা দেখিনি। পেলেকে প্রথম দেখি ইডেনে কসমস ম্যাচে পেলের পড়ন্ত বেলায় উনিশশো সাতাত্তর সালে। তারপর আটানব্বই ইউরো কাপে জার্মানিতে, নব্বইয়ে ইতালি বিশ্বকাপে, আটা নব্বইয়ের ফ্রান্স বিশ্বকাপ কিংবা দু’হাজার দুইতে জাপান কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ায় আমি পেলেকে দেখেছি, কিন্তু অন্য ভূমিকায়। কোথাও তিনি পেশাদার কলাম লিখিয়ে, কোথাও তিনি অ্যাডিডাস কোম্পানির মডেল আবার কোথাও ফিফা’র ব্র্যান্ড আম্বাসেডর। রোমে একই লিফটে স্টেডিয়ামে পেলের সহসঙ্গী যে ক’বার হয়েছি তা গুনে শেষ করা যাবে না। ফর্মে পেলের সঙ্গে আমার পরিচয় জায়ান্টস অফ ব্রাজিল ফিল্মে অথবা ভিডিওর পর্দায়। এ তুলনায়, আমি ম্যারাডোনাকে মাঠে বিধ্বংসী ভূমিকায় দেখেছি। 

 

 


নব্বই বিশ্বকাপে ইতালির বিরুদ্ধে একটি ম্যাচে নাপোলি স্টেডিয়ামে ম্যারাডোনার অফ দ্যা বল একটি সোলো দৌড়ের কথা কোনো দিন কি ভুলতে পারবো? ইতালির দুই ডিফেন্ডার ম্যারাডোনাকে আটকাতে ছিটকে গেল। আর সেই সুযোগে ক্যানিজিয়ার সেই ফ্লিকে গোল। সেদিন মিডিয়া গ্যালারিতে আমার পাশে ছিলেন আমাদের মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। নাপোলি থেকে সেই রাতেই আমরা ট্রেনে রোম ফিরেছিলাম। ম্যারাডোনার সোলো রানটি আমার এবং আমি নিশ্চিত ভাবেই জানি মতি ভাইকেও তন্ময় করে রেখেছিলো। অফ  দ্যা বল ও যে ফুটবল খেলা যায় তাতো আমাদের দেখিয়েছিলেন ম্যারাডোনাই। স্বীকার করতে দোষ নেই যে, আমি ম্যারাডোনার ফ্যান। পেলের মধ্যে সৃষ্টিধর্মিতা ছিল ঠিকই, গোল করেছেন, গোল করিয়েছেন, কিন্তু ম্যারাডোনার মতো বুনো সৌন্দর্য তার খেলায় আমি অন্তত পাইনি। ছিয়াশির বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের সাত জনকে ড্রিবলে পর্যুদস্ত করে ম্যারাডোনার সেই গোলটি তো আজও বিশ্বসেরা। হতে পারে ম্যারাডোনাকে আমি তার ফুল ফর্মে মাঠে দেখেছি বলে, হতে পারে ম্যারাডোনাকে ম্যাচ উইনিং পারফরম্যান্স দেখেছি বলে আমি ম্যারাডোনার ফ্যান, কিন্তু পরবর্তী পর্বে লিওনেল মেসি কিংবা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকেও তো আমি দেখেছি। পেলে, মেসি, রোনাল্ডোরা আমার কাছে ক্লাসিক ফুটবলার আর ম্যারাডোনা ক্লাস আপার্ট। 

একটি দলে ম্যারাডোনা থাকা মানেই দলটির হ্যান্ডিকাপ পেয়ে এগিয়ে থাকা। পেলে, মেসি, রোনাল্ডোকে দেখে কেন তা মনে হয় না? ফ্রান্স ফেরত আমি আর মতি ব্যাংককের হোটেলে বসে একদিন তুলনা করেছিলাম এই চার জনকে। মতি ভাই হয়তো ভুলে গেছেন, কিন্তু আমার মনে এখনো অক্ষয় অম্লান অনির্বাণ তার বলা কথাগুলো- পেলে যদি হয় আগুন তাহলে সেই আগুনের শিখা হলো ম্যারাডোনা। শিখাই তো জ্বালিয়ে দেয়, পুড়িয়ে দেয় তাই নয়কি?


কুড়ি বছর আগে ব্যাংককের হোটেলে বসে মতি ভাই আমাকে যখন এই কথা বলেছিলেন তখনও ফুটবলে মেসি কিংবা রোনাল্ডো যুগ শুরু হয়নি। তারপর মেসি এলেন, রোনাল্ডো এলেন। মেসি’র মধ্যে ম্যারাডোনার উত্তরসূরিকে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, রোনাল্ডোর মধ্যে আদিম বন্য সৌন্দর্য আমরা উপলব্ধি করলাম। কিন্তু সেই আর্জেন্টাইন টিউলিপের মন-মাতানো সৌরভ পেলাম কি? ম্যারাডোনা যথার্থ লিডার ছিলেন, একাই একটা দলকে টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখতেন। বাকিরা ব্যক্তিগত ক্যারিশমায় উজ্জ্বল। আর তাই আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি ম্যারাডোনাই হলেন সর্বকালের সেরা। পেলের পাশে ছিলেন গাড়িঞ্চা, ভাভা, ডিডিরা। মেসি ও রোনাল্ডোরা যখন খেলেছেন তখন ফুটবল তো টিম গেমে পর্যবসিত হয়েই গেছে। মধ্যবর্তী সময়টিতে ছিলেন  ম্যারাডোনা। যিনি একাই একটা ইনস্টিটিউশন হয়ে নিজেকে ফুলের পাপড়ির মতো মেলে ধরেছেন। ম্যারাডোনা সত্যিই ক্লাস আপার্ট। তার তুলনা তিনি নিজেই।

 

বিশ্বকাপ ম্যাগাজিন থেকে আরও পড়ুন

   

বিশ্বকাপ ম্যাগাজিন সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status