ষোলো আনা
আত্মহত্যার পথ থেকে স্বাভাবিক জীবনে
সুইসাইড নোট লেখার পর যা যা করেছিলেন দিয়া
পিয়াস সরকার
১৪ মে ২০২২, শনিবারএকটা সময় মনে হলো এ জীবনের প্রয়োজন কি? আমি চলে গেলেই পরিবার সুখে থাকবে। আত্মহত্যা করবো, সিদ্ধান্ত ঠিক করে ফেলি। সুইসাইড নোট লিখে ফেলি। এই নোট আমি লিখি বিকাল ৪টায়। ছিঁড়ে ফেলি রাত ১টায়। এই ৯ ঘণ্টাসহ পূর্বের কিছুদিনের বর্ণনা দিয়েছেন এক শিক্ষক। বর্তমানে স্বামী, সংসার নিয়ে সুখেই আছেন তিনি।
নিজের আসল পরিচয় দিতে নারাজ দিয়া (ছদ্মনাম)। দিয়া রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন। বর্তমানে তিনি রংপুরের একটি কিন্টারগার্ডেনে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। দিয়া একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে।
ফ্রেন্ডস অনলি করা পোস্টটি ছিল মাত্র তিন থেকে চার মিনিট। দিয়া বলেন, এই স্ট্যাটাস আমি দেই রাত ১টায়। এই স্ট্যাটাস না দিলে হয়তো, আমি আর থাকতাম না। তিনি বলেন, তখন আমি তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে আমার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু প্রায়শই ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকতো। মনে শান্তি ছিল না। এরপর আমাদের বিচ্ছেদ হয়। আব্বু, আম্মুকে বিয়ের কথা বলেছিলাম তারাও মেনে নেয়নি। সেমিস্টার বিরতিতে সবাই বাসায় চলে গেলে ফ্ল্যাট পুরো ফাঁকা হয়ে যায়। আরও একা হয়ে পড়ি। নয়নের (ছদ্মনাম) সঙ্গে কথা হয়নি দুই থেকে তিনদিন। সিদ্ধান্ত নেই জীবন রাখবো না। তিনি বলেন, আত্মহত্যার সিদ্ধান্তের পর অদ্ভুত সব চিন্তা মাথায় আসা শুরু হলো। ফাঁকা বাসায় থাকায় কথা বলার মানুষ পর্যন্ত ছিল না। খেতে পারতাম না। একটা সময় নিচের দোকান থেকে সিগারেটও নিয়ে আসি। প্রথমে কাশি হয় কিন্তু এরপর অভ্যস্ত হয়ে যাই। এরকম ভাবে দু’দিন যাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলি। কয়েক লাইনের একটা সুইসাইড নোট লিখতে লেগে যায় প্রায় এক ঘণ্টা। সুইসাইড নোট লেখার সময় বারবার আমার আপনজনদের কথা মনে হতে থাকে, আর আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। আব্বু, আম্মুকে শত্রু মনে হতো; তাদের জন্যও খারাপ লাগা শুরু হলো। ছোট ভাইটার কথা মনে পড়ে। ঠিক পরক্ষণেই মনে হয়, তারা আমার ভালোটা বুঝলো না। আমি কেন বুঝবো?
কাঁপা কাঁপা হাতে সুইসাইড নোট লিখে ফেলেন দিয়া। তিনি বলেন, আমাদের দেয়ালে একটা ঘড়ি ছিল। যাতে টিক টিক শব্দ হতো। আমার মনে হচ্ছিল আমার মৃত্যুর সময় গুনছে ঘড়িটা। এভাবে কেটে যায় অনেক সময়। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি আজ রাতই আমার শেষ রাত। কিছু সময় পর মাগরিবের আজান দেয়। আজানের সুরটা খুব ভালো লাগে। আমার ল্যাপটপে তখনও বাজছিল স্যাড মিউজিক। নামাজ পড়ার সিদ্ধান্ত নেই। গোসল করতে যাই। কিন্তু মাগরিবের নামাজ পড়া হয়নি। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা ছিল। ক্ষুধা থাকলেও অল্প কটা ভাত খেয়েছিলাম। পছন্দের মানুষের সঙ্গে বিচ্ছেদ মেনে নিতে পারছিলাম না। অনবরত কান্না করছিলাম। এশার আজান দিলো। অনেক দিন পর নামাজ পড়লাম। মনটা একটু শান্ত হলো। কিন্তু বারবারই মনে হচ্ছিল আত্মহত্যা মহা পাপ। এরপর রাত ১০টার দিকে এক আপু ফ্ল্যাটে আসেন। কেন জানি খুব বিরক্তি লাগছিল। ইচ্ছা না থাকলেও তার সঙ্গে ফের ভাত খেতে বসি। আপু বারবার বলছিল- দিয়া কি হয়েছে তোর?
১১টার দিকে শুয়ে পড়ি। আর প্রস্তুতি নিতে থাকি। একটা মোটা কাপড় ঠিক করলাম আর দেখে নিলাম ফ্যানের উচ্চতা। সুইসাইড নোটটা বালিশের নিচে ছিল। যার প্রথম লাইন ছিল- আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। শেষে ছিল- আর পারলাম না। আম্মু, আব্বু মাপ করে দিও আমাকে।
আব্বু, আম্মুর কথা খুব মনে পড়ছিল। ফের কান্না জুড়ে দেই। তবে এবার নয়নের জন্য না। আম্মু অনেক বার কল দিয়েছে ধরিনি। নিজে থেকেই কল দিলাম। অল্প কথা হলো। আম্মু বারবার ধৈর্য ধরার কথা বলছিল। নয়নের দেয়া একটা টেডি বিয়ার ছিল। ওটা জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলাম। এরপর রাত ১টার দিকে ফ্যানে কাপড় ঝুলাই। ঠাণ্ডা ছিল বেশ, তবুও শরীর ঘামছিল। হঠাৎ ফোনটা হাতে নিই। কি মনে করে একটা স্ট্যাটাস দেই সুইসাইড নোটের শেষ লাইনটা। বুক কাঁপছিল আমার। অল্প ক’মিনিটেই অনেক কমেন্ট আসে। নয়ন আমাকে ব্লক দিয়েছিল। হয়তো ব্লক খুলে কমেন্ট করে- আমাদের ভালোর জন্যই দূরে সরে গেছি। কথা দিলাম তুমি আত্মহত্যা করলে এটাই আমারও শেষ রাত। কমেন্টটা পড়ার পরই দেখি আপু দরজায় নক করছে জোরে জোরে। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। দরজা খুলে দেই কিছু সময় পর। আপু এসেই ফ্যানে দড়ি ঝুলানো দেখে চড় মারেন। স্ট্যাটাসটা ডিলিট করে দেই।
এরপর থেকে কেন জানি হালকা লাগতে শুরু করে। সেদিন আপু সারারাত আমার পাশে শুয়ে ছিলেন। জার্নি করে এলেও এক মিনিটের জন্য ঘুমাননি। এমনকি ওয়াশরুমে গেলেও দরজা খুলে গিয়েছেন, আমি গেলে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। পরদিন সকালেই আব্বু, আম্মু আমাকে নিয়ে যায়। সে রাতেই পুড়িয়ে ফেলি সুইসাইড নোটটা।
দিয়া বলেন, নয়নের সঙ্গে আমার যোগাযোগ এরপর দু’একবার হয়েছিল। কিন্তু আমিও বুঝেছিলাম দুই ধর্মের বিয়ে সমাজ মেনে নেয় না। এরপর আর ওই ফেসবুক আইডিতে ঢুকিনি। নতুন আইডি খুলি। রংপুরেই এক ছেলের সঙ্গে পারিবারিক পছন্দে বিয়ে করি। এখন চাকরি করছি, ভালোই আছি। তিনি বলেন, বীভৎস সেই সময়ের কথা আর মনে করতে চাই না। আর এখনো আমি বলি- আম্মু, আব্বু সেদিনের ঘটনার জন্য তোমরা আমাকে মাফ করে দিও।