দেশ বিদেশ
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান: এক ক্ষণজন্মা পুরুষ ও সফল রাষ্ট্রনায়ক
ব্যারিস্টার নাজির আহমদ
৩০ মে ২০২৫, শুক্রবার
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিদের একজন। তিনি ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রাক্তন সফল প্রেসিডেন্ট এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান। তবে, তার প্রথম এবং প্রধান পরিচয় হলো তিনি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার ও স্বাধীনতার ঘোষক। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। যদি বাংলাদেশ স্বাধীন না হতো, তাহলে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার করা হতো এবং পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বা ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করতো। পরিস্থিতির প্রয়োজনে একজন পেশাদার সৈনিক থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা প্রেসিডেন্ট জিয়া নিজেকে একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। জনপ্রিয়তার একেবারে যখন শীর্ষে অবস্থান করছিলেন ঠিক তখন তাকে হত্যা করা হয়, এমন তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে এই ধরা ত্যাগ ইতিহাসে খুব কম নেতার ভাগ্যে জুটেছে।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার বর্ণাঢ্য জীবনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: প্রেসিডেন্ট জিয়া ১৯শে জানুয়ারি ১৯৩৬ সালে বগুড়া জেলার বাগবাড়ী নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তার প্রয়াত পিতামাতা মনসুর রহমান এবং জাহানারা খাতুনের দ্বিতীয় পুত্র ছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া তৎকালীন কলকাতার অন্যতম প্রধান বালক বিদ্যালয় ‘হেয়ার স্কুল’-এ পড়াশোনা করেন। তিনি করাচির ‘একাডেমি স্কুল’ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫১ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়া করাচির ডি. জে. কলেজে ভর্তি হন। ডি. জে. কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে (পিএমএ) ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। পিএমএ থেকে ১২তম পিএমএ দীর্ঘ কোর্সে স্নাতক সম্পন্নের পর তিনি ১৯৫৫ সালে কমিশন লাভ করেন। সেনাবাহিনীতে তিনি কমান্ডো প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন, প্যারাট্রুপার হন এবং একটি বিশেষ গোয়েন্দা কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তিনি ‘খেমকরণ সেক্টর’-এ কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। এ যুদ্ধে বীরত্বের জন্য পাকিস্তান সরকার জিয়াউর রহমানকে “হিলাল-ই-জুরাত” খেতাবে ভূষিত করেন। এ ছাড়াও তার ইউনিট এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য দুটি “সিতারা-ই-জুরাত” এবং নয়টি তামাঘা-ই-জুরাত” পদক লাভ করে। ১৯৬৬ সালে তাকে কাকুলে পিএমএ প্রশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। একই বছর তিনি কোয়েটার স্টাফ কলেজে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালের শেষের দিকে তাকে প্রশিক্ষণের জন্য পশ্চিম জার্মানিতে পাঠানো হয় এবং পরে কয়েক মাস তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কাটিয়েছিলেন।
১৯৭০ সালের অক্টোবরে জিয়াকে মেজর পদে চট্টগ্রামে নবগঠিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল (ইবি) রেজিমেন্টে বদলি করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালো রাতে নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গণহত্যা চালালে, তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন এবং পরে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ঐতিহাসিক ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ দেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট জিয়া মুক্তিবাহিনীর সেক্টর কমান্ডার হন এবং প্রথম, দ্বিতীয় এবং অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ানদের সহায়তায় রৌমারীতে (কুড়িগ্রাম জেলার) বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্রিগেড গঠন করেন। ব্রিগেডটি পরে (তার নামের আদ্যাক্ষর অনুসারে) ‘জেড’ ফোর্স নামে পরিচিতি পায়। একই মাসে প্রেসিডেন্ট জিয়া লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন। মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়াকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়, (এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান তবে জীবিত অফিসারদের অসামান্য অবদানের জন্য এটি সর্বোচ্চ খেতাব)।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট জিয়া কর্নেল পদে উন্নীত হন এবং কুমিল্লায় একটি ব্রিগেডের নেতৃত্ব দেন। ১৯৭২ সালের জুন মাসে, তিনি সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালে তিনি ব্রিগেডিয়ার হন এবং একই বছরের ১০ অক্টোবর তিনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। ১৯৭৫ সালের ২৫শে আগস্ট, প্রেসিডেন্ট জিয়া, বি.ইউ., পিএসসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত হন এবং তিনি সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তবে, ৩রা নভেম্বর ১৯৭৫ তারিখে এক অকাল অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে তার কমান্ড থেকে অপসারণ করে গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর ‘সিপাহি-জনতা বিপ্লব’ গঠিত হয়, যার ফলে জিয়া মুক্তি পান এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানের পদে পুনর্বহাল হন। তিনি উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (সিএমএলএ)দের একজন হন এবং ১৯৭৬ সালের ২৯শে নভেম্বর তিনি সামরিক আইন প্রশাসক (সিএমএলএ) হন। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি সৈয়দ এ. বি. মাহমুদ হোসেন, ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানকে প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ পড়ান।
প্রেসিডেন্ট জিয়া ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ (বিএনপি) নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং তিনি এর চেয়ারম্যান হন। ১৯৭৯ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ অনুষ্ঠিত হয় এবং বিএনপি ৩০০ আসনের মধ্যে ২০৭টি আসন লাভ করে। ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত সংসদের প্রথম অধিবেশনে (৬ই এপ্রিল ১৯৭৯) পঞ্চম সংশোধনী বিল পাসের পর সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয়। তিনি সংবাদ ও মতামত মুদ্রণ ও প্রকাশনার ওপর থেকে সকল নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়া ১৯৬০ সালে বেগম খালেদা জিয়াকে বিয়ে করেন। বেগম জিয়া বিএনপি’র বর্তমান চেয়ারপারসন। তিনি অতীতে তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
তাদের দুই পুত্র সন্তান: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং মরহুম আরাফাত রহমান কোকো। তাদের উভয়কেই অতীতের সামরিক-সমর্থিত অসাংবিধানিক ১/১১ সরকার বেআইনিভাবে অমানবিক নির্যাতন করেছিল।
১৯৮১ সালের ৩০শে মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে এক সেনা অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যা করা হয়।
অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট জিয়ার অবদান: রাজনীতি, গণতন্ত্র, অর্থনীতি এবং নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট জিয়া অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। তিনি বহুদলীয় ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করেছিলেন। তার মাধ্যমেই বাংলাদেশে মূলত সহনশীলতা ও উৎপাদনের রাজনীতির গোড়াপত্তন হয়।। প্রেসিডেন্ট জিয়া অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য ‘১৯-দফা কর্মসূচি’ ঘোষণা করেছিলেন যা আত্মনির্ভরতা, গ্রামীণ উন্নয়ন, বিকেন্দ্রীকরণ এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিয়েছিল। তিনি উদ্যমী হয়ে বিরামহীনভাবে কাজ করেছিলেন এবং সারা দেশের আনাচে কানাচে সফর করে তার বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেছিলেন, ‘আশার রাজনীতি’ প্রচার করে সমস্ত বাংলাদেশিকে আরও কঠোর পরিশ্রম করতে এবং আরও বেশি উৎপাদন করতে ক্রমাগত আহ্বান জানিয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়া কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর বিশেষ মনোনিবেশ দিয়েছিলেন। বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়নকে দিয়েছিলেন যথাযথ গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার। তিনি ১৯৭৭ সালে একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচি চালু করেছিলেন, যার মধ্যে একটি অত্যন্ত দৃশ্যমান এবং তুমুল জনপ্রিয় ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য’ কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি বেসরকারি খাতের উন্নয়ন, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং খামারের সমষ্টিগতকরণকে বিপরীতমুখী করার ওপর বিশেষ ড্রাইভ দিয়েছিলেন। তার সরকার কৃষি ও শিল্প কর্মকাণ্ডের উপর কোটা এবং বিধিনিষেধ কমিয়ে দেয়। প্রেসিডেন্ট জিয়া সেচ, খাল খনন, বিদ্যুৎকেন্দ্র, বাঁধ, রাস্তা এবং অন্যান্য গণপূর্ত নির্মাণের জন্য বড় বড় প্রকল্প চালু করেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে ১৯৭৬ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনীতে নারীদের নিয়োগ শুরু হয়। ১৯৭৭ সালের নভেম্বরে জিয়া কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে খাল খননের কর্মসূচি শুরু করেন। তিনি ১৯৭৭ সালের ১১ ডিসেম্বর মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ১৫ থেকে ৩০ এ উন্নীত করেন এবং সরকারি চাকরিতে মহিলাদের জন্য কোটা বৃদ্ধি করেন। ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারিতে, শহীদ জিয়া গ্রামবাসীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে গ্রাম পর্যায়ে "গ্রাম সরকার" নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি স্থানীয় নিরাপত্তা এবং অপরাধ প্রতিরোধের জন্য "গ্রাম প্রতিরক্ষা দল" ব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাথমিক ও প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার প্রচারের জন্য ব্যাপকভাবে কর্মসূচি শুরু করা হয়েছিল এবং এগুলো মূলত গ্রামাঞ্চলে কেন্দ্রীভূত ছিল। ১৯৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর যৌতুক বিরোধী আইন পাস হয়। তিনি যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ও প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সাথে একীভূত হয়। এই সময়কালে, বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত অর্থনৈতিক ও শিল্প প্রবৃদ্ধি অর্জন করে।
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জীবনকে প্রেসিডেন্ট জিয়া পুনরুজ্জীবিত করেন। ১৯৭৬ সালে, তিনি ভাষা আন্দোলন এবং জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারী খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব, শিল্পী, শিক্ষাবিদ এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের স্বীকৃতি প্রদানের জন্য বার্ষিক "একুশে পদক" প্রবর্তন করেন। ১৯৭৭ সালে “স্বাধীনতা পুরস্কার” - বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যক্তি এবং/অথবা সংস্থার উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ - সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার - প্রবর্তন করা হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়া শিশু একাডেমি এবং শিশু পার্ক প্রতিষ্ঠা করেন।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট জিয়ার অবদান এবং স্বীকৃতি
প্রেসিডেন্ট জিয়া সর্বদা দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতার স্বপ্ন দেখতেন। এই কথা মাথায় রেখেই তিনি দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (SAARC) প্রতিষ্ঠা করেন, যা ১৯৮৫ সালে বাস্তবে রূপ নেয়। প্রেসিডেন্ট জিয়া ১৯৮১ সালে জেরুজালেমের মুক্তি সংক্রান্ত আল কুদস কমিটির অন্যতম সদস্য এবং ১৯৮১ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধের অবসান ঘটাতে শান্তি মিশনের সদস্য হন। দেশে তিনি ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (BIISS) প্রতিষ্ঠা করেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট জিয়ার অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগ্যান বলেন, "“The United States – indeed the world – had come to respect President Zia’s profound and compassionate commitment to a better life for his people and his dedication to the rule of law. His wisdom in international affairs will be sorely missed” (অর্থাৎ “প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রপতি জিয়ার জনগণের জন্য উন্নত জীবনের প্রতি গভীর এবং সহানুভূতিশীল প্রতিশ্রুতি এবং আইনের শাসনের প্রতি তাঁর নিষ্ঠাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই বিশ্ব সম্মান করতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক বিষয়ে তাঁর প্রজ্ঞার অভাব বোধ করা হবে”)।
রাষ্ট্রনায়কোচিত ব্যক্তিত্ব এবং দূরদর্শিতার জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়াকে সার্ক কর্তৃক সম্মানিত করা হয়েছিল। তিনি মিশরের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান “অর্ডার অফ দ্য নাইল”, প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়ার সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান “গ্রেট স্টার” এবং তাঁর নেতৃত্বের জন্য উত্তর কোরিয়া তাঁর জীবদ্দশায় প্রদত্ত “হিরো অফ দ্য রিপাবলিক” খেতাবে ভূষিত হন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুর পর তুরস্ক তাকে সম্মান জানাতে আঙ্কারার একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নামকরণ করে "জিয়াউর রহমান ক্যাডেসি"।
বেশিরভাগ কট্টর ডানপন্থীরা তৎকালীন পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে উদ্বেগে ছিলেন। অপরদিকে কিছু কট্টর বামপন্থী যারা বিশ্বাস করতেন যে বাংলাদেশ ভারতীয় অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। প্রেসিডেন্ট জিয়া এগুলো এড্রেস করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পুনর্নির্মাণ শুরু করেন। তিনি সোভিয়েত ব্লকের সাথে তার পূর্বসূরীর সখ্যতা থেকে সরে আসেন। এর পরিবর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া সৌদি আরব এবং চীনের সাথে সম্পর্ক সুসংহত করার জন্যও পদক্ষেপ নেন, যারা ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিল এবং স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়নি। ভারত থেকে বাংলাদেশকে দূরে সরিয়ে রেখে প্রেসিডেন্ট জিয়া অন্যান্য মুসলিম জাতির সাথে সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টা করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর দিকে অগ্রসর হওয়ার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় হয়।
ইসলাম এবং জাতীয়তাবাদের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট জিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি:
প্রেসিডেন্ট জিয়া জাতিকে একটি নতুন সেন্স অব ডাইরেকশনে নিয়ে যান, যা শেখ মুজিবুর রহমানের ("মুজিব") আদর্শ এবং এজেন্ডা থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন। তিনি বাংলাদেশকে একটি ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যান। তিনি দেখতে পান যে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ এবং জাতীয়তাবাদের ধারণা উভয় দিক থেকেই পরিচয় সংকটে ভুগছে। সার্বভৌমত্বের ধারণা তাদের খুবই সীমিত। তিনি সংবিধান সংশোধন করে একটি ঘোষণা (Proclamation) জারি করেন, যার ভিত্তিতে ধর্ম এবং তাদের জাতি সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করা হবে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় তিনি "বিসমিল্লাহির-রহমানির-রহিম" ("পরম করুণাময়, দয়ালু আল্লাহর নামে") সন্নিবেশ করেন। ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে "সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস" সংবিধানের ৮(১) এবং ৮(১এ) অনুচ্ছেদে যুক্ত করা হয়েছে। সমাজতন্ত্রকে "অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার" হিসাবে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সংবিধানের ২৫(২) অনুচ্ছেদে জিয়া একটি নীতি প্রবর্তন করেন যে, "রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশগুলির মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক সুসংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করার চেষ্টা করবে।"
মুজিবের ভাষাগত ঐতিহ্যের ভিত্তিতে "বাঙালি জাতীয়তাবাদ"-এর বিপরীতে জিয়া জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে "বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ" প্রবর্তন করেছিলেন। জীবনের নীতিমালার নির্দেশিকা হিসেবে প্রেসিডেন্ট জিয়া ইসলামের জাতীয় ভূমিকার উপর জোর দিয়েছিলেন। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক (Inclusive) জাতীয় পরিচয় প্রচারের দাবি করে জিয়া সান্তোস, গারো, মণিপুরী এবং চাকমাদের মতো অ-বাঙালি সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি বিহারি বংশোদ্ভূত উর্দুভাষী জনগণের কাছে পৌঁছান। এমনকি তিনি নাগরিকদের জাতীয়তা বর্ণনা করার জন্য সংবিধান সংশোধন করে “বাঙালি” এর পরিবর্তে “বাংলাদেশী” টার্ম প্রতিস্থাপন করে। এটি নাগরিকদের তাদের সার্বভৌম আনুগত্যের ক্ষেত্রে সংজ্ঞায়িত করে, রাজনৈতিক বিশ্বাস বা দলীয় সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে নয়। সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট জিয়া ১৯৭৬ সালে “পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কমিশন” গঠন করেন। ১৯৭৭ সালের ২রা জুলাই প্রেসিডেন্ট জিয়া সরকার এবং উপজাতি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংলাপে উৎসাহ প্রদানের জন্য একটি উপজাতি সম্মেলনের আয়োজন করেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার সমালোচকদের কিছু সমালোচনা এবং সম্ভাব্য ব্যাখ্যা:
প্রেসিডেন্ট জিয়া ছিলেন আপাদমস্তক একজন সৎ ব্যক্তিত্ব। এমনকি তাঁর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং রাজনৈতিক বিরোধীরাও তাকে অসৎ বা দুর্নীতিগ্রস্ত বলে অভিযুক্ত করতে পারেনি। তাঁর সততা ছিল প্রশ্নাতীত। তাঁর কিছু রাজনৈতিক সমালোচক প্রায়শই জিয়ার "I will make politics difficult for politicians" বলার জন্য সমালোচনা করেন। তাঁর এই বক্তব্যকে তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীরা সম্পূর্ণ ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে। জিয়া তৃণমূল পর্যায়ের রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। তাঁর ভিশন ছিল দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা: এটি করার জন্য তিনি সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে এবং তাদের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে আগ্রহী ছিলেন। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়ে তিনি মাইলের পর মাইল হেঁটে নিজে খাল খনন করেছিলেন। তিনি সেই তথাকথিত রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তুলতে চেয়েছিলেন, যারা কোনও প্রচেষ্টা ছাড়াই উচ্চ পদে থাকতে চায় বা রাজনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে অর্থ উপার্জন করতে চায়।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার বিরুদ্ধে প্রায়শই আরোপিত আরেকটি অভিযোগ হলো তিনি কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে অনেক সেনা কর্মকর্তার মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিলেন। সামরিক বাহিনীর মধ্যে অভ্যুত্থান এবং বিদ্রোহ সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ এবং তাই এগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর এবং কঠোরভাবে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তিনি আর কী করতে পারতেন? সামরিক অভ্যুত্থান এবং বিদ্রোহ মোকাবেলায় ভদ্রভাবে পদক্ষেপ নেওয়া, রাজনৈতিক সমাধান খোঁজা বা আলোচনা পরিচালনা করা ভুল পদ্ধতি। এই ভুল পদ্ধতি অনুসরণ করার ফলে ২০০৯ সালের ২৫ এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় আমরা যা দেখেছি তা হতে পারত। যদি তিনি কঠোর এবং কঠোরভাবে এই অভ্যুত্থান এবং বিদ্রোহ মোকাবেলা না করতেন, তাহলে তিনি অনেক আগেই এর শিকার হতেন।
পরিশেষে-
বাংলাদেশে অতীতে অনেক প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী এসেছেন এবং নিঃসন্দেহে ভবিষ্যতে আরও অনেক আসবেন। দেশের জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়ার মতো একজন রাষ্ট্রনায়কের খুব প্রয়োজন যিনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবেন, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন এবং যার উপর সকল অংশীদার ও অংশীজনদের আস্থা থাকবে। বাংলাদেশের জন্য মালয়েশিয়ার মতো একটি দেশ হওয়া বা এর চেয়েও উন্নত কঠিন হত না যদি তাদের একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক থাকত। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে প্রেসিডেন্ট জিয়া বেঁচে থাকলে, এখন বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার চেয়েও উন্নত হতে পারত। জিয়া জাতিকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন - নিজের আত্মপরিচয় খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে, রাজনীতির মাধ্যমে জাতি গঠনের ক্ষেত্রে, সহনশীলতা এবং ঐক্যের একটি নতুন রাজনীতির বন্দোবস্ত করার ক্ষেত্রে। তাঁর উত্তরাধিকারীরা এবং অসংখ্য রাজনৈতিক অনুসারীরা যদি সেই অনন্য দিকগুলি ধরে রাখতে পারতেন তবে তাদের জন্য আরও ভালো হত। শহীদ জিয়ার প্রবাদসম সততা এবং নিষ্ঠা অনুসরণ করা তাঁর অগণিত অনুসারীদের রাজনীতির মূল ভিত্তি হওয়া উচিত।
কয়েক দশক ধরে, মুজিব পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র এবং অধিকারের জন্য লড়াই করেছিলেন। বাস্তবে, তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাকিস্তানের কারাগারে কাটিয়েছেন। তাকে নানাভাবে হয়রানি ও নির্যাতন করা হয়েছিল। বছরের পর বছর ধরে তাকে তাঁর পরিবার থেকে দূরে রাখা হয়েছিল। পরিহাসের বিষয় হলো, স্বাধীনতার পর ক্ষমতায় আসা এই ব্যক্তিই একদলীয় স্বৈরাচারী ব্যবস্থা চালু করেছিলেন এবং প্রায় সকল গণমাধ্যম বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এর বিপরীতে, শহীদ জিয়া ছিলেন একজন নির্ভীক ব্যক্তি। তিনি তাঁর সামরিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর সাহসিকতা, অঙ্গীকার এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধির স্বাক্ষর রেখেছিলেন। রাজনীতিতে প্রবেশের পর তাঁর অসাধারণ সামরিক কর্মজীবন ত্যাগ করে তিনি গণতন্ত্রে জনজীবনে কীভাবে নিজেকে পরিচালনা করতে হবে তাঁর জন্য একজন আদর্শ (role model) নেতা হয়ে ওঠেন। মুজিবের মতো অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদরা যা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন তা জিয়া দিয়েছিলেন। তিনি বহুদলীয় ব্যবস্থা চালু করেছিলেন এবং সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের উপর থেকে সমস্ত বিধিনিষেধ তুলে নিয়েছিলেন। তিনি এতটাই সহনশীল ছিলেন যে তিনি নিশ্চিত করতেন যে তাঁর আমলে তাঁর বিরোধী শিবিরের সমস্ত দক্ষ রাজনীতিবিদ এবং সংসদ সদস্যরা সংসদে যেন আসেন - কারণ এটি, তাঁর মতে, গণতন্ত্র এবং সংসদীয় ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল, প্রাণবন্ত এবং টেকসই করে তুলবে। আওয়ামী লীগের অনেক সমালোচক দাবি করেন যে শেখ মুজিব যখন বাকশালের নামে একদলীয় ব্যবস্থা চালু করেছিলেন তখন আওয়ামী লীগকে হত্যা করা হয়েছিল। বহুদলীয় ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করে আওয়ামী লীগকে নতুন জীবন দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া।
প্রেসিডেন্ট জিয়া ৩৯ বছর বয়সে সেনাবাহিনীর প্রধান হন। ৪১ বছর বয়সে তিনি প্রেসিডেন্ট হন। ৪৫ বছর বয়সে পৃথিবী ত্যাগ করেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি মাত্র চার বছর জাতির সেবা করতে সক্ষম হন। এই অল্প সময়ের মধ্যে প্রেসিডেন্ট জিয়া বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যান। অল্প সময়ের মধ্যে জাতির জন্য তিনি যে অবদান এবং ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা সমসাময়িক বিশ্বের ইতিহাসে অতুলনীয়। বাংলাদেশ এমন একজন অনন্য, ক্ষণজন্মা, কিংবদন্তি রাষ্ট্রনায়ককে হারিয়েছে, যার স্থলাভিষিক্ত এখনও সম্ভব হয়নি। ২০২৫ সালের ৩০ মে তাঁর ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। আমি তাঁকে পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি এবং দেশের জন্য তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। মহান প্রভু যেন তাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থান দান করুন।
নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, রাষ্ট্রচিন্তক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।
Email: [email protected]