দেশ বিদেশ
বিচারহীনতার বৃত্তে ঘুরছে নিষ্ঠুরতার গল্প
মরিয়ম মীম
১৬ মার্চ ২০২৫, রবিবার
মাগুরার সেই শিশুটির মুখটা কি ভুলতে পারছেন? না, পারছেন না। পারছেন না কারণ এই নিষ্পাপ শিশুটিকে যে পাশবিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে, তা কোনো সুস্থ মানুষের কল্পনারও বাইরে। এই নির্মমতার পরিণতি- অকাল মৃত্যু।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই মৃত্যু কি শুধুই ওই নিষ্ঠুর নরপশুদের হাতে হয়েছে? নাকি পুরো সমাজের নীরবতা, বিচার ব্যবস্থার ঢিলেমি, রাষ্ট্রের ব্যর্থতাই এই মৃত্যু আরও নিশ্চিত করেছে?
প্রতিবারই আমরা চমকে উঠি, কয়েকদিন আলোচনা করি, তারপর ভুলে যাই। ঠিক যেমন ভুলে গেছি তনু হত্যা (২০১৬- কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এখনো এই মামলার বিচার হয়নি)। নুসরাত জাহান রাফি হত্যা (২০১৯- ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে তার মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার পর আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়)। তেমনই একদিন ভুলে যাবো এই শিশুর কথাও। কিন্তু এর মাঝেই আমাদের আশপাশের কোনো এক বাড়িতে হয়তো আরেকটি আছিয়া জন্ম নিচ্ছে, যে হয়তো তার পরিবারেরই কোনো সদস্যের হাতে প্রথম হেনস্তার শিকার হবে।
নারী নির্যাতনের শিকার হওয়া মানেই কি ভুল তার?
যখন কোনো নারী বা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, তখন সমাজের একটা বড় অংশ প্রথমেই প্রশ্ন তোলে- সে গায়ে কী পরেছিল? সে রাতে কেন বের হয়েছিল? তার চরিত্র কেমন ছিল?
কিন্তু এই শিশু? সে তো সেই রাতে ঘর থেকে বাহিরেও যায়নি, সে তো কোনো “ভুল” করেনি, তাহলে কেন তাকে এমন নির্মম পরিণতি ভোগ করতে হলো? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় লুকিয়ে আছে। নারী এবং শিশুকে কখনোই এই সমাজ কোনোদিন স্বাধীন ও আত্মমর্যাদাশীল মানুষ হিসেবে ভাবতে শেখায়নি। তাই তার ওপর অত্যাচার হলেও দোষ তাকেই দিতে শিখেছি আমরা।
সংখ্যা যে ভয়ানক বাস্তবতা দেখায়
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের ২০২৪ সালের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশের ৭০% নারী তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে নির্যাতনের শিকার হন। কিন্তু এই ঘটনার কয়টি আমাদের সামনে আসে?
সমীক্ষা বলছে, মাত্র ৫% নারী নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ্যে আনতে পারেন। বাকিরা চুপ করে থাকেন। কেন? কারণ সমাজ নির্যাতিতাকেই দোষী বানায়, কারণ বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা তাদের আরও ভীত করে তোলে, কারণ রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা অপরাধীদের আরও নির্লজ্জ করে তোলে।
কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ না আসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই সংখ্যা শুধু বাড়তেই থাকবে।
পারিবারিক শিক্ষা- যেখানে প্রথম হেনস্তার শুরু হয়
আমরা প্রায়ই বলি, “নারীদের বাইরে যেতে সাবধান হতে হবে”, “বাচ্চাদের অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে দূরে রাখতে হবে।” কিন্তু আমরা কি জানি, বেশির ভাগ নির্যাতনের ঘটনা পরিবারের মধ্যেই ঘটে?
আমাদের পরিবারগুলোতে শিশুদের কণ্ঠরোধ করাই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। “বড়দের কথা মানতে হয়”, “এটা বাড়ির ব্যাপার”, “এ নিয়ে কথা বললে সম্মান যাবে”- এসব মানসিকতা শিশুদের কণ্ঠরোধ করে।
তাই, শিশুদের নিরাপত্তার জন্য পরিবারের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি।
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি- সমস্যার গভীরে লুকিয়ে থাকা পুরুষতন্ত্র
আমাদের সমাজে এখনো “নারী মানেই দুর্বল”, “নারীর কাজ সংসার সামলানো”, “নারী বেশি কথা বললে সমস্যা বাড়ে”-এই ধরনের চিন্তা-ভাবনা বয়ে বেড়ানো হয়।
এর ফলাফল?
নারীর প্রতি সহিংসতাকে গা সওয়া মনে করা হয়।
শিশুর প্রতি নির্যাতনকে পারিবারিক বিষয় বলে এড়িয়ে যাওয়া হয়।
ধর্ষক বা নির্যাতকের বিচার চাইতে গেলে সমাজের লোকরাই উল্টো ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করে।
যদি এই মানসিকতা না বদলায়, তাহলে আইন যতই কঠোর হোক, নারীরা নিরাপদ থাকবেন না।
রাষ্ট্রের ব্যর্থতা-বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ও অপরাধীর ক্ষমতা
দেশে ধর্ষণের মামলাগুলোর কতো শতাংশ শেষ পর্যন্ত দোষীদের সাজা দিতে পারে জানেন? মাত্র ৩-৪%।
বাকি ৯৬% মামলাগুলো হয় বছরের পর বছর ঝুলে থাকে, নয়তো প্রভাবশালীদের চাপে পড়ে উঠে যায়। ফলে অপরাধীরা জানে, তারা যা খুশি করতে পারবে- তাদের কিছুই হবে না।
বিচার ব্যবস্থা ধীরগতির হওয়ায় নির্যাতিতার পরিবার একসময় হাল ছেড়ে দেয়। কারণ বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় ঘুরে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
তাই, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। ধর্ষণের মামলার রায় সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে দিতে হবে। অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
বাধাহীন কথা বলার অধিকার দরকার
* যতক্ষণ পর্যন্ত নারীরা ও শিশুরা তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের ঘটনা বলতে ভয় পাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে।
* পরিবার থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র- সব জায়গায় তাদের কথা বলার অধিকার দিতে হবে।
* রাষ্ট্রকে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, ভুক্তভোগীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে।
* নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতাকে দমনের জন্য একটি বিশেষ আইন প্রয়োগকারী বাহিনী গঠন করতে হবে।
অতীতের ভয়াবহ কিছু ঘটনা- যেগুলো আমরা ভুলে গেছি
১. তনু হত্যা (২০১৬): কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এখনো এই মামলার বিচার হয়নি।
২. নুসরাত জাহান রাফি (২০১৯): ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে তার মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার পর আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
৩. রিশা হত্যা (২০১৬): স্কুলছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়, কারণ সে উত্ত্যক্তকারীকে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
৪. মেধাবী ছাত্রী আফসানা কবীর শুভ্রা (২০০১): ঢাকার নটরডেম কলেজের ছাত্রী শুভ্রাকে ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
৫. ফাতেমা তুজ জিনিয়া (২০১৪): রাজধানীতে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জিনিয়াকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়।
৬. গারো তরুণী ধর্ষণ (২০১৫): ঢাকার মহাখালীতে বাস থেকে নামার পর এক গারো তরুণীকে অপহরণ করে ধর্ষণ করা হয়, যা তীব্র প্রতিবাদের জন্ম দেয়।
৭. সাভার গণধর্ষণ (২০১৩): পোশাক শ্রমিক এক নারীকে সাভারের আশুলিয়ায় ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়।
৮. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণ (২০২০): এক শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাসের কাছেই তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়, যা দেশ জুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
৯. সিলেট এমসি কলেজ গণধর্ষণ (২০২০): কলেজ হোস্টেলে স্বামীকে আটকে রেখে এক তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়।
১০. গণধর্ষণের শিকার এক তরুণী, নোয়াখালী (২০২০): কোম্পানীগঞ্জে এক নারীকে বর্বরভাবে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হয়, যা দেশ জুড়ে বিক্ষোভের জন্ম দেয়।
এ ছাড়া আরও বহু ঘটনা আছে, যা বিচারহীনতার কারণে বারবার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। এই ঘটনাগুলো শুধু নির্যাতিত নারীদের জীবনে ভয়াবহ ট্র্যাজেডি তৈরি করেনি, বরং এ দেশের বিচার ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাও তুলে ধরেছে।
তনু হত্যা থেকে শুরু করে সিলেট এমসি কলেজ গণধর্ষণ আমরা ভুলে গেলেও, এই ঘটনাগুলোর যন্ত্রণা সেই পরিবারগুলোর জন্য এখনো প্রতিদিনের দুঃস্বপ্ন হয়ে আছে।
প্রতিরোধের উপায়- আরও দেরি করার সময় নেই
১. পরিবারকে সচেতন হতে হবে: সন্তানদের শেখাতে হবে, “যদি কেউ তোমাকে অস্বস্তিকর কিছু বলে বা স্পর্শ করে, সঙ্গে সঙ্গে জানাবে।”
২. স্কুল ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে: যৌন হয়রানি প্রতিরোধে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হটলাইন ও মনিটরিং টিম থাকতে হবে।
৩. কঠোর আইন ও দ্রুত বিচার: ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে এবং দোষীদের দ্রুত সাজা দিতে হবে।
৪. সামাজিক সচেতনতা: নারীদের দোষী বানানোর মানসিকতা দূর করতে হবে।
মাগুরার শিশুটির মৃত্যু আমাদের কাঁদিয়েছে। কিন্তু আমরা কি এর বিচার নিশ্চিত করতে পারবো? নাকি আরও কিছুদিন পর নতুন কোনো ঘটনার জন্য আমাদের মনোযোগ সরে যাবে?
যদি আমরা এখনই ব্যবস্থা না নিই, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও এমন নির্মমতার শিকার হতে হবে।
তাই, রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার- সবার একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। নারী ও শিশুর জন্য নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার সময় এখনই। আরও দেরি করার সুযোগ নেই।
প্রতি বছর অসংখ্য নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়, কিন্তু আমরা কেবল ক্ষোভ প্রকাশ করেই থেমে যাই।
২০২৪ সালে দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের পর ভারত জেগে উঠেছিল। বাংলাদেশ কি সেই পথ নেবে?
আমরা কি এমন একটি সমাজ গড়তে পারি, যেখানে মা-বাবা তাদের কন্যা সন্তানকে রাতে বের হতে দিতে ভয় পাবেন না? যেখানে কোনো শিশুর সঙ্গে পাশবিক আচরণ করার সাহস কেউ দেখাবে না?
এই পরিবর্তন এখনই আনতে হবে। সমাজের প্রতিটি মানুষকে সচেতন হতে হবে, রাষ্ট্রকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে এবং পরিবারকে নৈতিক শিক্ষার মূল কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
তবেই হয়তো আগামী দিনে আর কোনো মাগুরার শিশুকে আমাদের হারাতে হবে না, আর কোনো আছিয়াকে নিজের পরিচিতজনের লালসার শিকার হতে হবে না।
মরিয়ম মীম, শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]