দেশ বিদেশ
পুঁজিবাজার দেখভালের দায়িত্ব এবার আমলাদের
প্রণব মজুমদার
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, মঙ্গলবারযেকোনো দেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধির অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলো পুঁজিবাজার। এরপর ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। বিনিয়োগে জাপান বহু বছর ধরে এ দুটি খাতকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বের একটি সমৃদ্ধিশালী দেশ হিসেবে পরিচিত। দ্বিতীয় খাতটিতে অনেকটা উন্নতি হলেও দেশের পুঁজিবাজারে কোনো সুবাতাস নেই বহু বছর ধরে।
পুঁজিবাজারের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে ৩রা ফেব্রুয়ারি ১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে এ কমিটি গঠিত। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। তাতে স্বাক্ষর করেন উপসচিব ফরিদা ইয়াসমিন। বিভাগের সচিব কমিটির সভাপতি হয়েছেন। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্মসচিব (শেয়ারবাজার) গঠিত কমিটির সদস্য সচিব।
কমিটিতে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে- জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রতিনিধি (ন্যূনতম কমিশনার), বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি (ন্যূনতম পরিচালক), বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙচেঞ্জ কমিশনের প্রতিনিধি (ন্যূনতম নির্বাহী পরিচালক), বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি (ন্যূনতম নির্বাহী পরিচালক), মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির প্রতিনিধি (ন্যূনতম নির্বাহী পরিচালক), ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের প্রতিনিধি (ন্যূনতম নির্বাহী পরিচালক), ঢাকা স্টক এঙচেঞ্জের চেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রাম স্টক এঙচেঞ্জের চেয়ারম্যান। এরা দেশের পুঁজিবাজারের দেখভাল করবেন। সদস্য বেশির ভাগই আমলা।
১৯৯৬ সালে প্রথিতযশা কূটনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদ অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া সরকারের ক্ষমতায় থাকাকালে দেশের পুঁজিবাজারে পরামর্শক কমিটি ছিল। পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান সিকিউরিটিজ এঙচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) গঠিত পরামর্শক কমিটি নিয়মিত সভা করে বাজার পরিচালনা করতো। তখন বাজার নিয়ে তেমন একটা সংকট দেখা যায়নি।
একেবারেই ভগ্নদশা দেশের পুঁজি বাজারের! অতীতে বিভিন্ন সময়ে এ বাজারে দুষ্টচক্রের কারসাজিতে যেসব ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল তা কিছুতেই নিরাময় হচ্ছে না! মন্দাভাব এখনো বিদ্যমান। বিভিন্ন দেশের পুঁজিবাজার নিয়ে ক’দিন আগে প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশের পুঁজিবাজারের অবস্থান খুবই নাজুক। পরিসংখ্যান বলছে, বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে ৫ ধাপ নেমে দেশের পুঁজিবাজার অবস্থান করছে ৪২তম স্থানে। র্যাংকিংয়ে বাজার মূলধনের দিক থেকে বিশ্বে প্রথম নিউ ইয়র্ক স্টক এঙচেঞ্জ। ৬ষ্ঠ স্থানে থাকা ভারতের ন্যাশনাল স্টক এঙচেঞ্জের বাজার মূলধন ৫ দশমিক ৬২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। ঢাকা স্টক এঙচেঞ্জের বর্তমান বাজার মূলধন সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকার ঘরে। দেশের পুঁজিবাজার এখন বাজার মূলধন ও জিডিপি’র অনুপাত ৮ শতাংশের নিচে। পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস্তানে প্রায় ১০ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ১৫, ভিয়েতনামে ৪১, ইন্দোনেশিয়ায় ৪৪, থাইল্যান্ডে ৯১ ও ভারতে ১২০ শতাংশ। বৈশ্বিক সূচকে পিছিয়ে যাচ্ছে আমাদের পুঁজিবাজার।
পুঁজিবাজারের অবনতি বা মন্দাভাব আমাদের দীর্ঘকালের। বহুদিন ধরে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি, অনিয়ম, অদক্ষতা ও বিচারহীনতা বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে ভীষণভাবে সংকুচিত ও পঙ্গু করে রেখেছে। তিন দশক ধরে দেখছি নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙচেঞ্জ কমিশন বা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বাজার কেলেঙ্কারি অভিযুক্তদের শাস্তি না দিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের সহযোগী হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক নিজেই দুষ্কৃতিকারী বনে গেছে। সুশাসনের পরিবর্তে দিনের পর দিন পুঁজিবাজারকে প্রভাবশালীদের মূলধন লুণ্ঠনের বাজারে পরিণত করা হয়েছে।
দেশের পুঁজিবাজারে আস্থার সংকট আজ থেকে নয়। বাজারে আস্থা সৃষ্টিতে বিগত সরকার কেউই আন্তরিক ছিল না। ৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমীরুল ইসলাম চৌধুরী কমিটির প্রকাশ করা সেই তদন্ত প্রতিবেদনের বিচার আজও হয়নি। অভিযুক্তরা পুনর্বাসিত হয়েছেন। বিচারের বদলে ‘ক্ষমা’ পেয়ে পুঁজিবাজারের এই লুটপাটকারীরা বরং বীর বাঙালির মতো অস্ত্র ধরে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের হত্যা করেছিলেন। কলঙ্কজনক সেই ঘটনার অভিযুক্ত একজন ছিলেন ঢাকার শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এঙচেঞ্জ লিমিটেড (ডিএসই)’র সভাপতি যিনি এখন পৃথিবীতে নেই। রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীতে সাম্প্রতিককালে নৌকায় ধৃত দেশের পুঁজিবাজারের হোতা ও বড় লুণ্ঠনকারী এখন কারাগারে। শেয়ার কেলেঙ্কারির সে ঘটনার অভিযুক্ত ছিলেন ৪৫ জন। পুঁজি লুণ্ঠনকারীরা দেশের শেয়ার বাজারকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে গেছেন।
২০১০ সালের দেশের শেয়ার বাজারে পুনরায় কেলেঙ্কারি সংঘটিত হয়। কেলেঙ্কারির সঙ্গে উল্লেখিতরাও জড়িত ছিলেন। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করা নিয়ে তখন সরকারের ‘মেলোড্রামা’ মঞ্চস্থ হয়! কমিটির প্রধান সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে অপ্রত্যাশিত এবং বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়? প্রবীণ ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বেঁচে নেই!
দেশের ভঙ্গুর ব্যাংকিং খাতকে টেনে তোলার জন্য সংস্কারমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু পুঁজিবাজারের ক্ষত নিরাময় করতে কার্যকর বড় চিকিৎসা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।
পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের নতুন কমিশন গঠিত হয়েছে এরইমধ্যে। ঢাকা স্টক এঙচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এঙচেঞ্জের (সিএসই) বোর্ড পুনর্গঠিত হয়েছে। পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণে যারা কাজ করছেন তাদের অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা, দক্ষতা ও জবাবদিহিতা তৈরিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন ও বাজার নজরদারির সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে।
পুঁজিবাজার দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের উৎস হলেও নানা সীমাবদ্ধতায় তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বার বার। পুঁজিবাজার অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করলেও নানা অনিয়ম-অদক্ষতায় সংকুচিত হয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সুসংগঠিত পুঁজিবাজার অপরিহার্য হলেও তা এখনো গড়ে ওঠেনি। চরম তারল্য সংকটে গত ১৫ বছরে দেশের পুঁজিবাজারে সূচক ও বাজার মূলধনেও ব্যাপক পতন হয়েছে। সময় অনেক অতিবাহিত হয়েছে। কালক্ষেপণ আর নয়। আমীরুল ও খালেদ কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে অপরাধীদের যোগ্য বিচারসহ কমিটির সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করার জোর পরামর্শ দেই সরকারকে। কেননা, পুঁজিবাজার দেশের তৃণমূলে এখন বিস্তৃত। পুঁজিবাজারে সক্রিয় লাখ লাখ বিনিয়োগকারী তাদের পুঁজি হারিয়ে হয়েছেন সর্বস্বান্ত্ত। কয়েকজন বিনিয়োগকারী এ জন্য আত্মহননের পথও বেছে নিয়েছিলেন।
দেশের পুঁজিবাজারের ভগ্নদশা উত্তরণকল্পে দুটি পদক্ষেপ বেশ পরিলক্ষিত। এদের মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে শেয়ার মূল্যের পরিবর্তনের উচ্চসীমা ও নিম্নসীমা বেঁধে দেয়া। শেয়ার বাজারে মূল্য পরিবর্তনের সীমা বেঁধে দেয়ার প্রচলন বিশ্বের অনেক দেশেই রয়েছে এবং এটি প্রচলিত কয়েক ধরনের সার্কিট ব্রেকারের মধ্যে একটি। শেয়ার বাজারে যদি হঠাৎ ব্যাপক মূল্য পরিবর্তনের আশঙ্কা তৈরি হয়, তাহলে স্বল্প সময়ের জন্য সার্কিট ব্রেকার ব্যবহার করে শেয়ার বাজারকে স্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে।
বাজার অর্থনীতির বেসরকারিকরণের যুগে দেশে অর্থনীতি উন্নয়নে সমৃদ্ধ পুঁজিবাজারের বিকল্প নেই। মানবসম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে সুবিশাল বেকার সমস্যার সমাধানের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করা জরুরি। পুঁজিবাজার সে ক্ষেত্র হতে পারে। আস্থার সংকটে সত্যিকারের লাভজনক কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত পুঁজির জন্য বাজারে আসতে পারছে না। সেসব পদক্ষেপ দেশের পুঁজিবাজারে আস্থা পুনরুদ্ধার হতে পারে তা হলো- ১. দেশের পুঁজিবাজারে কার্যক্রমরত সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো যেমন আর্থিক খাতের সকল নিয়ন্ত্রক, সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) শেয়ার বাজার দুটিতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি, ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এঙচেঞ্জ, যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর, বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধিদের নিয়ে সমন্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে ২. সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ক্রেডিট রেটিং, সিএ (চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস) ফার্মকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। ৩. অবিলম্বে প্রতিবেদন অনুসারে ’৯৬, ২০২০ সালসহ সকল শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনায় চিহ্নিতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে এবং ৪. দেশের পুঁজিবাজারকে সরকারি রাজনৈতিক দল এবং প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপমুক্ত রাখতে হবে। ৫. কোম্পানিগুলোতে নিরপেক্ষ পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে নিজেদের লোক বসানোর অনুশীলন পরিহার করে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের পছন্দের অভিজ্ঞ পরিচালককে নিয়োগ দিতে হবে। ৬. বাজারকে আস্থার জায়গা পৌঁছাতে হলে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এ অর্থ ও বাণিজ্য বিষয়ক পেশাজীবী যেমন অধ্যাপক, সাংবাদিক, অর্থনীতিবিদ, পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ, সাবেক ব্যাংক, বীমাবিদ ও হিসাববিদ ইত্যাদির সমন্বয়ে গঠিত পরামর্শক কমিটি গঠন করে মাসে একবার সভা করে তাদের মতামত নিয়ে কাজ করা অত্যাবশ্যক। এ ধরনের কমিটি যা এসইসিতে আগেও ছিল। ৭. দেশের পুঁজিবাজারের পরিধি বাড়াতে দুর্বল পোর্টফোলিও কোম্পানির আইপিওর (ইনিশিয়াল পাবলিক অফার) অনুমোদন না দিয়ে দেশে ব্যবসরত বহুজাতিক এবং লাভজনক স্বনামখ্যাত দেশি কোম্পানিগুলোকে প্রাইমারি মার্কেটে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। ৮. সকলকে কোনো অনুপাতে শেয়ার বণ্টন নয় বরং আইপিওতে আগের মতো লটারিতে ফিরিয়ে আনতে হবে। ৯. কোম্পানি আইন জানা এ বিষয়ক মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য অর্থ ও বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ বা অভিজ্ঞ বিচারকদের সমন্বয়ে আলাদা আদালত গঠন করতে হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপরাধীদের উপযুক্ত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
তাই আমলাদের নিয়ে গঠিত দেশের পুঁজিবাজার উন্নয়ন কখনোই সম্ভব হবে না। তাছাড়া, পুুঁজিবাজারে যে আস্থাহীনতা এখনো বিদ্যমান তা পুনরুদ্ধার করতে হলে বাজার থেকে চাটুকার ও সরকারের সব সময়ের সুবিধাবাদী ‘দরবেশ’ হটিয়ে বাজার জনমুখী করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক কথাসাহিত্যিক, কবি ও অর্থকাগজ সম্পাদক
[email protected]
পাঠকের মতামত
জনাব, দরবেশের নাম উল্লেখ করতে লজ্জা লেগেছে বুঝি ?