দেশ বিদেশ
চায়ের দেশের রূপ মাধুর্যের ‘বৃষ্টি বন’
স্টাফ রিপোর্টার, মৌলভীবাজার থেকে
১৬ জুন ২০২৪, রবিবার
গহীন বনে বন্য প্রাণীর হাঁকডাক আর অবাধ বিচরণ। প্রবেশদ্বার থেকেই স্বাগত জানায় সারি সারি রকমারি গাছ। আর ওই গাছের মগডালে লাফঝাঁপ করে বানর, ভাল্লুক, কাঠবিড়ালি আর কতো কী প্রাণী! দূর থেকে কানে বাজে ওদের নিজেদের মধ্যে হট্টগোলের উচ্চ আওয়াজ। দেখা মিলে তাদের দৌড়ঝাঁপ আর খাবার-দাবার নিয়ে ঝগড়াঝাটির। সবুজ বন আর অনন্য প্রকৃতি। এ যেন মনোমুগ্ধতার এক অন্য আবেশ। দু’চোখ জুড়ে সবুজ বন আর নানা প্রজাতির জীববৈচিত্র্য। এমন নজরকাড়া অপরূপ প্রকৃতির আধার মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার জাতীয় উদ্যান। বর্ষা আর শুষ্ক দুই মৌসুমে তার ভিন্নরূপ সৌন্দর্য। এই বৃষ্টি বন বা রেইন ফরেস্টটির নাম ‘লাউয়াছড়া’। যুগ যুগ থেকে আপন রূপমাধুর্যে দৃষ্টি কাড়ছে প্রকৃতিপ্রেমীদের। জাতীয় উদ্যান হিসেবে খ্যাতি অর্জনের পর আপন বৈশিষ্ট্যে হয়ে উঠেছে অনন্য। দেশের অন্যতম ও জেলার একমাত্র এই জাতীয় উদ্যানটি দেশি-বিদেশি প্রকৃতিপ্রেমীদের হৃদয়ে ঠাঁই পেয়েছে। নানা সমস্যা ও সংকটে থেকেও এখনো ঐতিহ্য আর সম্ভাবনা ধরে রাখার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। ওখানকার প্রকৃতির সঙ্গে মানবের দানবীয় আচরণ। তারপরও লড়াই করে কোনোরকম টিকে আছে উদার প্রকৃতির এই রাজ্য। উদ্যানের প্রবেশ পথে সারিবদ্ধ গাছ আর আঁকাবাঁকা রেলপথ আকৃষ্ট করে যে কাউকে। সবুজ গাছগাছালি, বনজঙ্গল আর লতাগুল্মের মধ্যেই নানা জাতের বন্য প্রাণীর আপন নিবাস।
সূর্যোদয় কিংবা গোধূলীলগ্নে ওখানকার বাসিন্দারা জানান দেয় এটাই তাদের আপন ভুবন। তাদের হাঁকডাক আর হৈ-হুল্লুড়ে মিলে ওখানেই বাসস্থান গড়েছে বন্য প্রাণীরা। নানা রঙ আর আকার আকৃতির পোকা-মাকড়ের ঝিঁ ঝিঁ শব্দ, বিচিত্র সব পশুপাখির কিচিরমিচির, দলবদ্ধ বানরের ভেংচি আর লাফঝাঁপ। এক গাছ থেকে অন্য গাছে বিলুপ্ত প্রজাতির উল্লুক আর কাঠবিড়ালীর দৌড়ঝাঁপ। সাপ, হরিণ, বানর, শিয়াল আর নানা জাতের বন্য প্রাণীর অবাধ বিচরণ। এমন দৃশ্য লাউয়াছড়ায় হরদম। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশে অবশিষ্ট চিরহরিৎ বনের একটি উল্লেখযোগ্য নমুনা। বাংলাদেশের ৭টি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য ও ১০টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে লাউয়াছড়া অন্যতম। সৌন্দর্যের দিক দিয়ে সুন্দরবনের পরেই লাউয়াছড়া বনের অবস্থান। বিলুপ্ত প্রজাতির প্রাণী, ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছগাছালি আর লতাগুল্ম। নানা জাতের পাখি আর সবুজ প্রকৃতির হাতছানিতে ভরপুর ‘ট্রপিক্যাল রেইন ফরেস্ট’ হিসেবে খ্যাত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। এই উপভোগ্য নৈসর্গিক সৌন্দর্যের টানে পর্যটকরা ওখানে আসেন। গহীন অরণ্যের নিস্তবদ্ধতা ভেঙে ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা ডাক শোনে পর্যটকরা হারিয়ে যান আনন্দ আবেগে। ওখানকার বনেই খুঁজে পান ব্যতিক্রমী আনন্দ। চায়ের দেশ হিসেবে খ্যাত সিলেট বিভাগের যতগুলো দর্শনীয় স্থান আছে তার মধ্যে লাউয়াছড়া রেইন ফরেস্ট অন্যতম। এ জেলার ৯২টি চা বাগান, অর্ধশতাধিক রাবার বাগান, আগর বাগান, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, হামহাম জলপ্রপাত, মাধবপুর লেক, আলী আমজদের নবাববাড়ি, কমলা ও লেবুর বাগান, খাসিয়া পুঞ্জির পানচাষ, হাকালুকি হাওর, বাক্কাবিলসহ নানা আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান দেখার পরও পর্যটকরা ছুটে আসেন লাউছড়ায়। উদ্যানটি এখন শুধু পর্যটকদের বিনোদনেরই স্থান নয়।
জীবন্ত জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক গবেষণাগারও বটে। ওখানে দেশি-বিদেশি পশুপাখি ও বন্য প্রাণী গবেষকরা গবেষণার জন্য স্থানটিতে আসছেন। শিক্ষা, গবেষণা, ইকো-ট্যুরিজমসহ ভ্রমণবিলাসীদের কাছে চিত্তবিনোদনের অন্যতম আকর্ষণীয় স্পট হয়ে উঠেছে এ উদ্যান। জানা যায়, ১৯২৫ খিস্টাব্দে বৃটিশ সরকারের উদ্যোগে লাগানো নানা জাতের গাছগাছালি বেড়ে আজকে তা ঐতিহ্যবাহী বনে পরিণত হয়েছে। মৌলভীবাজার ফরেস্ট রেঞ্জের আওতাধীন ২,৭৪০ হেক্টর আয়তনের পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বন ছিল এলাকাটি, সেই সুবাদে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পূর্ববর্তী নাম পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বন। বনের অস্তিত্ব ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি প্রকৃতি-ভ্রমণ ও জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পশ্চিম ভানুগাছ বনের ১,২৫০ হেক্টর এলাকাকে ১৯৭৪ সালের বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও সংশোধন) আইন অনুযায়ী ১৯৯৬ খিস্টাব্দে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। লাউয়াছড়া আসার পথে রাস্তার দু’পাশে চোখে পড়ে চা-বাগান। উঁচু-নিচু পাহাড়ি টিলায় চা-লেবু ও আনারসের বাগান দেখে মনে হবে যেন সবুজ সমুদ্র ঢেউ খেলছে। আর ওখানে ঘন সবুজের গহীনে দেখা মিলে বিচিত্র সব পশুপাখির। জানা যায়, এ বনে বিলুপ্ত প্রজাতির প্রাণী উল্লুকের বসবাস। মিশ্র চিরহরিৎ এই উদ্যানে রয়েছে ৪৬০ প্রজাতির জীববৈচিত্র্য। যার মধ্যে রয়েছে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ। তন্মধ্যে সেগুন, গর্জন, চাপালিশ, মেনজিয়াম, ডুমুর প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া রয়েছে ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২০ প্রজাতির স্থন্যপায়ী প্রাণী, ১৭ প্রজাতির দুর্লভ পোকা-মাকড় ও ২৪৬ প্রজাতির পাখি রয়েছে। এদের মধ্যে মুখপোড়া হনুমান, কুলু বানর, শজারু, উল্লুক, হনুমান, লজ্জাবতী বানর, কালো ধনেশ, সাত ভায়ালা, লাল মাথা ট্রোগন, শ্যামা, অজগর, মেছোবাঘ, মায়া হরিণ, উদবিড়াল ও পাহাড়ি ময়নাসহ বিরল প্রজাতির পাখির নিরাপদ অভয়াশ্রম লাউয়াছড়া। এ ছাড়াও এ উদ্যানে ৮৫০ হেক্টর জায়গা জুড়ে দীর্ঘমেয়াদি বনায়ন, ১৭০ হেক্টর জায়গায় স্বল্পমেয়াদি বনায়ন, ২১ হেক্টরে বাঁশ ও বেত এবং ১৩০ হেক্টর জুড়ে কৃষিজমি, বন গবেষণা এলাকা ও অন্যান্য অবকাঠামো। জানা যায়, বিশ^ খ্যাত ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটটি ডেজ’ ছবির একটি অংশের শুটিং হয়েছিল এই লাউয়াছড়া বনে। ১৩টি দেশের ১১৪টি লোকেশনে চিত্রায়িত হয় ছবিটি। এখানে আসার জন্য ঢাকা থেকে বাস ও ট্রেনে যাতায়াত সহজ। উদ্যানটির অবস্থান শ্রীমঙ্গল শহর থেকে উত্তর দিকে। তাছাড়া থাকা খাওয়ার জন্য জেলায় দু’টি পাঁচতারকা হোটেলসহ শতাধিক হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে।