ঈদ সংখ্যা ২০২৪
শৈলশহর সিমলায়
কামরুল হাসান
১০ এপ্রিল ২০২৪, বুধবারসিমলা নামটি এসেছে শ্যামলা দেবী থেকে। শ্যামলা হলো মা কালীর একটি রূপ! পাহাড়ি এ অঞ্চলে দেবীদেরই জয়জয়কার! আজ থেকে ২০০ বছর আগে এখানে গভীর জঙ্গল ছিল, কেবল পাহাড় চূড়ায় একটি মন্দির মনুষ্য আগমনের সংকেত দেয়। মন্দিরটির নাম জাখু মন্দির, সেখানে হনুমানের লালরঙের অতিকায় মূর্তি দূর থেকেই দেখলাম। যে পাহাড় শ্রেণির উপর সিমলা গড়ে উঠেছে, সেখানে আজো প্রচুর বানর বাস করে। বানরদের রাজা বলা যায় হনুমানকে। সে হিসেবে জাখু মন্দিরের চারপাশে পাহাড়ে পাহাড়ে বাস করা অসংখ্য শাখামৃগের কুলিন ও বলশালী প্রতিনিধি হিসেবেই হনুমানটির উপস্থিতি যথোপযুক্ত। কিন্তু মানবজাতির এ পূর্বপুরুষ সেখানে অর্চনা পান দেবতা হিসেবে। রামায়নে সীতা উদ্ধারে তার নায়কোচিত ভূমিকা হিন্দুরা ভুলতে পারেনি।
ভারতবর্ষে তখন ইংরেজ শাসন। গ্রীষ্মকালে ভারতের সমতলভূমি তেতে ওঠে গরমে, তা থেকে মুক্তি পেতে ইংরেজরা ছুটে যান উত্তরের পাহাড়ে পাহাড়ে, এভাবেই গড়ে ওঠে সিমলা, মুসৌরি, মারী, দেরাদুন, দার্জিলিং প্রভৃতি হিল স্টেশন। সিমলার পত্তন ঘটে ইংরেজদের হাতেই ১৮৩০ সালে। সিমলার আবহাওয়ায় তারা খুঁজে পায় বৃটিশ মেজাজ। পাকিস্তানের মারী থেকে বৃটিশরা তাদের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী সরিয়ে আনে সিমলায়। সেসময়ে ভারতবর্ষের রাজধানী ছিল কলকাতা। সুদূর কলকাতা থেকে সরকারি দপ্তরসমূহ সিমলায় সরিয়ে আনা ছিল বিপুল ঝক্কির, তবু হিমেল হাওয়ার পরশ পেতে, মনোরম আবহাওয়ায় স্বস্তি পেতে এ ঝক্কি তারা পোহাতো।
ইংরেজরা বিপুল লটবহর নিয়ে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে কলকাতা থেকে সিমলা আসতো, আর আমি বাস স্টেশন থেকে সামান্য লাগেজ নিয়ে মলে (গধষষ) উঠতে পারছি না। লাগেজ বলতে চাকালাগানো ছোট সুটকেস আর পিঠে ঝোলানো ব্যাগ। খাড়া পথটির পাশে বেশ কয়েকজন মুটে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা আমার সুটকেস ও ব্যাগ বহন করার আগ্রহও দেখিয়েছিল, কিন্তু আমি চণ্ডিগড়ের রক গার্ডেনে দেখা হওয়া বাঙালি পরিবারটির কথা মেনে তাদের কাউকে নেইনি। তারা বারণ করেছিল কোনো মুটে নিতে, কেন না হোটেলগুলোর সঙ্গে এদের সংযোগ আছে, তারা কমিশন পায়, অর্থাৎ তখন হোটেল ভাড়া আক্রা হবে। কিন্তু খাড়া পাহাড়টি বেয়ে উঠতে আমি হাঁপাচ্ছিলাম, তখন বাধ্য হয়েই একজনকে ডাকি। প্রৌঢ় লোকটি পাহাড়ি, পাহাড় বেয়ে উঠতে সে অভ্যস্ত, আমার চেয়ে বয়সে বড় লোকটি তরতর করে উঠে যায়, আমি দাঁড়িয়ে হাঁপাতে থাকি। তাকে নিয়ে সমস্যা হলো কিছুটা উঠেই সে থেমে পড়ে, টাকা চায়, তখনো মল আসেনি, আমি তখন টাকার অঙ্ক কিছুটা বাড়িয়ে তাকে রাজি করাই মল পর্যন্ত মালামালগুলো পৌঁছে দিতে। সেখানে উঠে সে চুক্তির বাইরে অতিরিক্ত টাকা চায়, আমি তখন তা দিতে অস্বীকার করি। এবার আমি নিজেই লাগেজ বহন করি, সে আমাকে অনুসরণ করে। তখনো মলে উঠিনি, কিছুটা ঢালে রয়েছি, দু’পাশে পাহাড় উদ্ভাসিত হলো প্রভাত আলোয়। একটি টিন আচ্ছাদিত চারপাশ খোলা টঙে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে পাহাড়ের পিঠ দেখি, মনটা এ কলহময় ভালো হয়ে গেল। সবুজে আচ্ছাদিত পাহাড়গুলো সূর্যকিরণে ঝলমল করছিল, কাছ থেকে দূর পর্যন্ত পাহাড়ের গায়ে দালানকোঠা, তাদের বিবিধ বর্ণের ঢালু ছাদ ঝিকমিক করছিল।
টঙ থেকে নেমে দেখি মুটে লোকটি দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশ্বস্ত প্রহরীর মতো। তাকে পুনর্বার টাকা দিতে চাই, সে অতিরিক্ত টাকার দাবি ছাড়বে না। আমিও তার অন্যায় আব্দার শুনবো না। ফলশ্রুতি সে টাকা না নিয়ে আমার পিছু পিছু হাঁটে। আমি মলের দোকানপাট দেখি, তবে মূলত খুঁজে চলি হোটেল। সে দিকটায় কোনো হোটেল চোখে পড়লো না। ওই যে শুনেছিলাম মলে অনেক হোটেল তার কোনো প্রমাণ পেলাম না। হেঁটে হোটেল খুঁজতে খুঁজতে অনুসরণরত লোকটির কথা ভুলে গেলাম। আমি তো অবাক হয়ে চারিপাশটা দেখছি, লোকে জায়গাগুলো ভরে ওঠা দেখছি, তাকিয়ে দেখি মুটে লোকটি নেই। ভাবলাম আছে হয়তো কাছেই কোথাও, দূর থেকে আমার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। যে সড়ক ধরে হাঁটছি সেটাই মল সড়ক, ছোট দোকানপাট এর পাশেই, কিন্তু বড় ও প্রাচীন দালানপাট উপরে। নিচ দিয়ে যাই আর ঘাড় উঁচিয়ে তাদের দেখি। সেগুলো যে বৃটিশ আমলের তা তাদের স্থাপত্যকলা দেখেই বোঝা যায়। অতীতের, তাই মোহনীয়।
পথের একটা অংশে দেখি একটি যাত্রী ছাউনির মতো জায়গা, অনেক মানুষ সেখানে বসে আছে, রোদ পোহাচ্ছে। সবুজ টিনের এক গম্বুজ উঠেছে সবুজ ছাদ থেকে। সেখান থেকে দক্ষিণের পাহাড়পিঠ, সেখানে ছড়ানো সিমলা দারুণ চোখে আসে। অনেক সুদর্শনা নারীকে দেখি। দিনটি ঝলমলে, নারীগণ অধিকতর। বাতাস শীতল, তারা উষ্ণ। তাদের রূপ লাবণ্য রোদের কণা হয়ে নামছে ফরশা গাত্রে আর প্রেমিকদের চোখে। উপত্যকার পাহাড়পিঠের চেয়ে তারা কি বেশি মনোলোভা? কি জানি! আমি তো অনেকক্ষণ পাহাড়ের দিকে পিঠ দিয়ে তাদেরই দেখছিলাম।
মলের পূর্ব দিকটায় হোটেলগুলো খুঁজে পেলাম। প্রথমটি পছন্দ হলো না, দ্বিতীয়টিও নয়, কেন না জানালা দিয়ে পাহাড় দেখা যায় না। দেখা যায় অন্য দালানের পিঠ। তা তো আমি ঢাকাতেই দেখি, এত কষ্ট স্বীকার করে এতদূর আসা কেন? দ্বিতীয় হোটেলটি, অর্কিড এর নাম, প্রবেশপথটি আমার পছন্দ হয়েছিল।
২
১৮১৫ সালের আগে কয়েকটি পর্ণকুটির ব্যতীত সিমলায় কোনো মনুষ্য স্থাপনা ছিল না। সে শতকের গোড়ার দিকে (১৮০৬) বন-জঙ্গলে আচ্ছাদিত অঞ্চলটি দখল করে নিয়েছিল নেপালী রাজা ভীমসেন থাপা। ১৮১৪ থেকে ১৮১৬- দু’বছরের ইঙ্গ-নেপালী যুদ্ধে সিমলা পুনরুদ্ধার করে ইংরেজরা। তাদেরই এক সেনাপতি লেফটেনেন্ট রস ১৮১৯ সালে সিমলায় প্রথম কাঠের বাড়ি নির্মাণ করেন। এর তিনবছর পর প্রথম পাকা বাড়ি নির্মাণ করেন উত্তরসূরি স্কটিশ সিভিল সার্ভেন্ট চার্লস প্রাট কেনেডি। সিমলা এসে এই পাকা দালানে বসবাস করেছেন তৎকালীন বাংলায় নিযুক্ত বৃটিশ গর্ভনর জেনারেল লর্ড এমহার্স্ট। ভারতে বৃটিশ সেনাবাহিনীর প্রধান লর্ড কমবারমেয়ারও আতিথ্য নেন এখানে। কমবারমেয়ার যখন সিমলা আসেন তখন তিন মাইল দীর্ঘ সড়ক ও একটি সেতু নির্মিত হয়। আরামদায়ক তাপমাত্রা ও অনেকটা বৃটেনের মতো আবহাওয়ার জন্য সিমলা বৃটিশদের কাছে প্রিয় হতে থাকে। ১৮৩০ থেকে ১৮৪১ সালের ভিতর গড়ে ওঠে একহাজারের অধিক ঘরবাড়ি। আর এখন? সিমলার পাহাড়কে যদি একটা ঝুড়ির সঙ্গে তুলনা করি, তবে এ ঝুড়ি উপচে পড়ছে ফুলে। তাকে ফুল বলবো নাকি বাজারসদাই বলবো- তা পরে বিবেচনা করা যাবে, তবে ঝুড়িটি অপ্রাকৃতিক।
কিছুটা এগুতে একটি ব্যালকনির মতো জায়গায় তল্পিবাহক লোকটিকে দেখতে পেয়ে আনন্দচিত্তে এগিয়ে যাই। কাছে গিয়ে ভুল ভাঙে আমার। হুবহু দেখতে একপ্রকার লোকটি আমাকে চিনতে পারলো না, তাতে বুঝলাম, এ সেই লোক নয়। কিন্তু সে লোকটি আমাকে একটি হোটেলের কথা বললো। একথাও বললো, সে ওই হোটেলেই চাকরি করে, তল্পিবাহক বা দালাল নয়। সে আমার ব্যগটি কাঁধে তুলে নেয়। সুটকেস টেনে তার পিছু পিছু যাই। মল সড়কের পাশেই হোটেলটি, খাড়া সিঁড়ি উঠে গেছে, উপরে বাম পাশে রিসিপশন কাউন্টার। হোটেলটি আমার পছন্দ হয়, কেন না আমাকে বরাদ্দ করা কক্ষটি ছোট হলেও বেশ পরিচ্ছন্ন আর তার বড় কাচের ভিতর দিয়ে পাহাড় ও উপত্যকা দেখা যায়। রুমের ভাড়া ১৪০০ রুপি, আমি ক্রেডিট কার্ড দিয়ে পরিশোধ করতে চাইলাম, কিন্তু তারা চাইলো ক্যাশ। ডলার ভাঙিয়ে পরিশোধ করবো প্রতিশ্রুতি দিয়ে রুমের চাবি নেই। ব্যাগ রেখে গোসল করে, পোশাক পাল্টে ঝরঝরে হয়ে বেরুই।
ক্ষুধার্ত ছিলাম, খাবার দোকান খুঁজি। মল রোডের পাশে একাধিক হোটেল রয়েছে। এক পাঞ্জাবি রেস্তরাঁয় আরাম করে বসে তন্দুরী চিকেন ও নান রুটি খাই। রেস্তরাঁটি পাহাড়ের ঢাল মেনে উঁচু-নিচু ধাপের। আমি বসেছি ক্যাশ কাউন্টারের কাছে উপরের ধাপে। কাউন্টারে বসে থাকা শুভ্রকেশ শিখ ভদ্রলোকের সঙ্গে টুকটাক কথা বলি আর নিচের ধাপের জানালা দিয়ে উপত্যকা দেখি। শিখ ভদ্রলোককে আমি রেস্তরাঁটির মালিক ভেবেছিলাম, তিনি ম্যানেজার। জানালেন এটি অনেক পুরনো রেস্তরাঁ, প্রায় ষাট বছর আগে এর ঝাঁপি খুলেছিল এক শিখ, যিনি এখন বৃদ্ধ। আমার কাছে ওই দ্বিতীয় ধাপে দুই কিশোরী মেয়েকে নিয়ে খেতে বসেছে এক দম্পতি। দেখে আমার দু’মেয়ের কথা মনে পড়লো। একা একা ঘোরা সহজ ও এর ব্যয়ভার বহন সম্ভব, কিন্তু তা একইসঙ্গে স্বার্থপরতায় আক্রান্ত। ওই মুহূর্তে মন চাইল সিমলায় আমার গোটা পরিবার নিয়ে ঘুরতে, রেস্তরাঁয় বসে খেতে।
আহারের আগে ১০০ ডলার ভাঙিয়ে নেই। দিনটি শনিবার বলে ব্যাংক বন্ধ, সে সুযোগটি পুরোপুরিভাবে নিলো মানি চেঞ্জার দোকানটি, ডলারের ব্যাংক রেট ছিল ৬৩ রুপি, সে আমাকে কিছুতেই ৬০ রুপির বেশি দিবে না। মল রোডে ওই একটিই মানি চেঞ্জার, বাধ্য হয়ে সে রেটই নিতে হলো। তবু স্বস্তি, হোটেল ভাড়া দিতে পারবো। মানি চেঞ্জার দোকানটি থেকে আমি এয়ারটেলের একটি সিম কিনি, ১৫০ রুপির একটি প্যাকেজ, তাতে যত মিনিট কথা বলার সুযোগ তাতে এবারের ভারত ভ্রমণ হয়ে যাবে। সিম কিনতে দোকানি লোকটি নিজের ঘওউ ব্যবহার করলো, আমার ফোনে যত্ন করে সিম ভরে দিলো। ফোনে সিম ভরে আমি প্রথমেই ফোন দেই কবি লিলি স্বরণকে, তাকে জানাই আমি নিরাপদে সিমলায় পৌঁছেছি, ভালো আছি।
আমি মল (গধষষ) রোড থেকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে আসি। নিচ থেকেই একটি গীর্জার অংশবিশেষ দেখতে পাচ্ছিলাম, তার শুভ্র গা ও নিউ গোথিক স্থাপত্য টানছিল। উপরে উঠে আমি থ, যুগপৎ অবাক ও আনন্দিত। জায়গাটির রূপ অনবদ্য, সরু মল রোডের ঠিক উপরেই অমন বিস্তৃত আয়োজন নিচ থেকে কিচ্ছুটি বোঝার উপায় নেই। সিমলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান এটি। এর নাম জরফমব। পাহাড়ের পাজরসম এ সমতল ভূখণ্ডের চারপাশে সিমলার বেশির ভাগ দর্শনীয় স্থাপনা- ক্রাইস্ট চার্চ, পাবলিক লাইব্রেরি, ট্যুরিজম অফিস, ব্যালকনি, দোকান। এর একদিকে গেলে হস্তশিল্পের আড়ত লক্কর বাজার, বিপরীত দিকে গেলে ঝপধহফধষ চড়রহঃ, উপরে খাড়া পাহাড়ে উঠে গেলে জাখু মন্দির। সিমলায় আসা পর্যটকরা এখানেই ভিড় জমায়।
সিমেন্ট বাঁধানো চত্বরটির আরেক শোভা অনেকগুলো বলশালী ও গা-চকচক, সুদর্শন ঘোড়া। অশ্ব এমনিতেই নান্দনিক, রিজে দাঁড়ানো অশ্বদল জগতের ঘোড়াদের প্রতিনিধি হয়ে আনন্দচিত্তে মানুষ টানছে। বসন্তের মেদুর দিনটিতে, যখন উপত্যকা ভরে আছে সোনালি আলোয়, সবকিছু ঝলমল ঝলমল করছে, যখন দলবাঁধা পর্যটকগণ প্রাণঃস্ফূর্তিময়, তখন চারপাশের ঐতিহাসিক ও দৃষ্টিনন্দন সকল স্থাপনা, দু’পাশের লোভনীয় উপত্যকাদৃশ্য নিয়ে রিজ হয়ে আছে গ্রহটির এক অনুপম ক্ষেত্র। মন কেবল প্রসন্ন নয়, হয়ে উঠলো ভুবনসন্দর্শী। পথের বাধা ডিঙ্গিয়ে সিমলা আসা স্বার্থক হলো।
৩
রিজে (জরফমব) দাঁড়িয়ে চারিপাশের প্রকৃতি, স্থাপনা, মানবিক আয়োজন ও চাঞ্চল্য দেখে আমি বিস্ময়বিমুগ্ধ হয়ে রইলাম। দুপুর বিকেলের দিকে যাত্রা শুরু করেছে কেবল, রিজে পর্যটক সমাগম বাড়তে লাগলো। পূর্ব থেকে পশ্চিমে সম্প্রসারিত রিজ একটি পাহাড় পৃষ্ঠের সমতলভূমি, সিমলার দর্শনীয় স্থাপনাগুলো এই রিজকে ঘিরেই। আমি প্রথমে এগিয়ে যাই ক্রাইস্ট চার্চের দিকে, কেন না স্থাপত্য সৌন্দর্যে এই গীর্জাটিই সবচেয়ে আকর্ষণীয়। খুব বড় নয় গীর্জাটি, নিউ গোথিক স্থাপত্যের দৃষ্টিনন্দন প্রার্থনাগৃহটির রঙ হালকা হলুদ, উপরে লালরঙের টিনের ঢালু ছাদ। সম্মুখে, প্রবেশপথের বরাবর একটি চতুষ্কোণ টাওয়ার উঠেছে কীলকের মতো চার স্তম্ভ নিয়ে। টাওয়ারটির ঊর্ধাংশের চার দেয়ালে দু’টি করে মোট আটটি কাঠের জানালা, নিচে চারটি পুরনো আমলের ঘড়ি। পুরনো আমলের হলেও ঘড়িগুলো সচল, সময় নির্দেশ করছে নির্ভুল। প্রবেশপথটি চারপাশে আর্চবিশিষ্ট গেটওয়ে, মাথায় চারটি কীলক, দু’টি ছোট, দু’টি দীর্ঘ। লাল ছাদের সম্মুখভাগে অমনি কীলকের ন্যায় স্তম্ভ আছে আরও দশটি। শনিবার বিধায় গির্জাটি বন্ধ ছিল, ভেতরটা তাই, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও, দেখতে পারিনি।
ক্রাইস্ট চার্চের কাছে, একেবারে লাগোয়া আরেকটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা রয়েছে। এর ছাদেও লাল রঙের টিন। যেসব অঞ্চলে বরফ পড়ে বা প্রবল বৃষ্টিপাত হয়, সেসব অঞ্চলে ঘরবাড়ির ছাদ ঢালু হয়। উপরে, অর্থাৎ ছাদের নিচেই, কাঠের ছোট ছোট ফ্রেমে আটকানো সাদা অংশটিতে বড় বড় জানালা। ত্রিভুজ ছাদের নিচে এরকম জানালা আছে বেশ কয়েকটি, চারদিকে মুখ ফেরানো চারটি, তাদের মিলিত রূপ নান্দনিক। আমি এরকম দালান দেখেছি ইংল্যান্ডে, আর ওই চার্চ, এই লাইব্রেরি ইংরেজদেরই তৈরি। গ্রন্থাগারের নিচের অংশটিতে খয়েরি রঙের পাথুরে দেয়াল। এ ভবনটি হিমাচল প্রদেশের গ্রন্থাগার।
ক্রাইস্ট চার্চ ও রাজ্য গ্রন্থাগারের পেছনেই পাহাড়, যার চূড়ায় জাখু মন্দির, যেখানে অতিকায় হনুমান আমাদের যাবতীয় কার্যকলাপের উপর দৃষ্টি রাখছে। গির্জা ও গ্রন্থাগারের মাঝ দিয়ে চলে গেছে সিমলার সর্বোচ্চ স্পটে যাবার পথ। একবার ইচ্ছে হলো যাই, হনুমান ও মন্দির দেখে আসি, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৫০০ ফুট উপরের ওই উচ্চতা থেকে সিমলার বিস্তৃত পাহাড়শ্রেণি, সমগ্র সিমলা দেখে আসি। ভ্রমণক্লান্ত শরীর নিয়ে এক হাজার ফুট খাড়াপথ ওঠার মনোবল পেলাম না, সময়ও একটি ফ্যাক্টর। তার বদলে রিজেরই প্রান্তদেশে তৈরি উঁচু গ্যালারিতে বসে পাহাড় ও সিমলা দেখি। এর নাম হাওয়া মহল। খোলা চত্বরে এমনিতেই বেশ হাওয়া, ওখানে আরও বেশি। নিচের অংশটি পেছনের পাহাড়ভূমি আবৃতকরা দেয়াল, তার উপরে দোতালা হাওয়া মহলে দু’টি ভিউয়িং গ্যালারি। একেবারে উপরের ছাদটি গ্রন্থাগারের ছাদের আদলে তৈরি, তারও রঙ লাল।
হাওয়া মহলের পাদদেশে মহাত্মা গান্ধীর পূর্ণদেহ স্ট্যাচু খুঁটিয়ে দেখি। ভারতে এমন শহর একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে শহরে গান্ধীজির মূর্তি নেই। সর্বভারতময় তার উপস্থিতি। রিজে অন্য যে রাজনৈতিক নেতার পূর্ণদেহ স্ট্যাচু রয়েছে তিনিও গান্ধী, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। আমরা সকলেই জানি এ দুই গান্ধী পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত নন। ইন্দিরা গান্ধীর স্ট্যাচুটি রয়েছে রিজের একটি ব্যালকনি সদৃশ্য জায়গায়, যেখান থেকে উত্তরের পাহাড়, উপত্যকা, সিমলার উত্তরাংশ চমৎকার দেখা যায়। একটি পিরামিডসদৃশ্য ত্রিভুজের শীর্ষে কিশোরীরা বসে আছে অনিন্দ্য দৃশ্যভোজ হয়ে। এ চত্বরটি রেলিং দিয়ে ঘেরা, তা দিতেই হতো, কেন না এখানে শিশুরা ছোটাছুটি করে। কাছেই ঘোড়াগুলো, তাতে শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষেরাই চড়ে, বিশেষ করে যাদের একটি আজন্মলালিত স্বপ্ন ছিল ঘোড়ার পিঠে চড়ার, তারা সুযোগটি হাতছাড়া করছেন না। এখানে ঘোড়া দৌড়ায় না, হাঁটে। ঘোড়ার মালিকগণ লাগাম ধরে ধীরপায়ে হাঁটেন, আর শিশু সওয়ারি হলে তার দিকে খেয়াল রাখেন। বয়স্ক সওয়ারির নিরাপত্তা নিয়ে তারা মাথা ঘামান না, তারা যদি ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যান, তবে নিজ দায়িত্বেই পড়বেন, ঘোড়ার মালিক বা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি তার দায়িত্ব নেবে না।
এ এমন এক জায়গা যেখানে গোটা দিন কাটানো যায়, কাটানো যায় দিনের পর দিন। আপনি যদি পর্যটক হন, তবে ক্লান্ত হবেন না। ঘোড়াদের রাজকীয় চলাফেরা দেখাটাও আনন্দকর। ঘোড়া ও ঘোড়ার সহিসরা যে পাশটা দখলে নিয়েছে সেই দিকে একটি পথ ঢালুু হয়ে নেমে গেছে নিচে। সড়কচিহ্ন দেখাচ্ছে পথটি গেছে লক্কর বাজারের দিকে।
৪
১৮৬৪ সালে সিমলাকে বৃটিশ ইন্ডিয়ার গ্রীষ্মকালীন রাজধানী ঘোষণার পর থেকে এর গুরুত্ব বেড়ে যায়। ভারত স্বাধীন হবার অব্যবহিত পরে সিমলা ছিল পাঞ্জাবের রাজধানী; কেন না তখন চন্ডিগড় বলে কোনো নগর গড়ে ওঠেনি আর অবিভক্ত পাঞ্জাবের রাজধানী লাহোর রয়ে গেছে পাকিস্তানে। ভারত স্বাধীন হয় ১৯৪৭ সালে, এর পরের বছর হিমালয়ের পাদদেশের হিমবাহী ২৮টি রাজাশাসিত ছোট ছোট রাজ্য একত্রিত করে গঠন করা হয় হিমাচল প্রদেশ, সিমলাকে নতুন প্রদেশটির রাজধানী ঘোষণা করা হয়।
রিজ থেকে ঢালু রাস্তা নেমে গেছে লাক্কার বাজারে। আমি প্রথমে বুঝিনি, লাক্কার মানে লাকড়ি, গিয়ে দেখলাম একেবার লক্কর-ঝক্কর মার্কা সব দোকান। একটু উপরের ওই বৃটিশগান্ধী স্থাপত্যের ঠিক বিপরীত, বনেদী স্থাপনার নিচে এক দরিদ্র বসতি। এ যেন একটানে গুলিস্তান থেকে পুরনো ঢাকায় ঢুকে পড়া। এখন আর এ বাজারে লাকড়ি বিক্রি হয় না, বিক্রি হয় কাঠের তৈরি কুটিরশিল্প, খেলনা, তৈজসপত্র, উপহার সামগ্রী। পর্যটকদের কেনাকাটার প্রিয় এক জায়গা।
একসময় এ অঞ্চলে গভীর জঙ্গল ছিল। পাহাড় আচ্ছাদিত ছিল ঘন গাছপালায়। মানুষ বসতি গড়তে সেসব সাফ করেছে, গাছ থেকে কাঠ ও খুঁটি নিয়েছে। সে খুঁটি দিয়ে ঘর আর কাঠ দিয়ে আসবাব বানিয়েছে, এমনকি গাছকে লাকড়ি বানিয়ে পুড়িয়েছে চুলায়। সিমলায় মানুষ বেড়েছে জ্যামিতিক হারে, গাছ উজাড় হয়েছে তার সমানুপাতিক বা আরও দ্রুত হারে। প্রকৃতির বিপর্যয় রোধে তাই আইন করে বৃক্ষনিধন ঠেকাতে তৎপর সরকার। তাতে দৃষ্টিসীমার ভেতরে গাছগুলো রক্ষা পেয়েছে, দূর নির্জন বনে বা পাহাড়ে মনুষ্য দস্যুবৃত্তি ঠেকাবে কে? তবে বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে আইনের প্রয়োগ অধিকতর। আইন যেহেতু কড়া, প্রকৃতির বৃক্ষগুলো, অকালনিধন থেকে সাময়িক রক্ষা পেয়েছে। এখন আর চুলায় পোড়ানো নয়, এখন শিল্প বানিয়ে ঘর সাজানো। তবে বৃক্ষদেরও প্রকারভেদ আছে, যে কাঠ পুড়িয়ে রান্না হয়, সে কাঠ দিয়ে হস্তশিল্প হয় না, তবে সব কাঠই পোড়ে। আমি কয়েকটি দোকানে উঁকি দিয়ে কাষ্ঠ শিল্পসামগ্রী দেখতে থাকি। চমৎকার কাজ কাঠের কারুশিল্পীদের। আজ থেকে ১০০ বছর আগে পাঞ্জাবের হুশিয়ারপুর নামক গ্রাম থেকে কয়েকজন কাঠকারিগর সিমলায় এসে বসতি গাড়ে। এদের হাতেই গড়ে ওঠে সিমলার কাঠশিল্প।
যে রাস্তা দিয়ে নেমে এসেছি তার নাম রিজ সানজুলি রোড, এর কিছুটা নিচ দিয়ে গেছে সিমলা শহরকে বেষ্টন করে যাওয়া সার্কুলার রোড, সেটি অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত। আমি দু’পাশের দোকানপাট পিছনে ফেলে এগিয়ে যাই, দেখি রিজ সানজুলি রোড বাঁক নিয়ে ডানে, অর্থাৎ পূর্বদিকে গেছে। সে সড়কটি অনেকটাই নির্জন, কিছুটা উপরে যে এক জমজমাট, কোলাহলময় চত্বর রয়েছে, তা টের পাওয়া যায় না। শহরের এত কাছে শহরতলী? সেখানে মিনা চৌহান নামের একজন সাদামাটা নিরাভরণা নারীর কাছে জানতে পারি ওপাশের অতিকায় দালানটি একটি হাসপাতাল। রিজের ব্যালকনিতে যার মূর্তি আছে তার নামেই, নেহেরুর প্রিয় শহর সিমলায় তার প্রিয় কন্যার নামে সরকারি হাসপাতাল। পথের একপাশে ফল বিক্রি হচ্ছে। আমি হাসপাতালের ডাক অগ্রাহ্য করে জীবনের দিকে ফিরে আসি।
লাক্কার বাজারে এসে কিছু চাবির রিং কিনি। ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রকার চাবির রিং ও কলম পাওয়া যায়, গিফট আইটেমের ভিতর এ দুটোই কমদামী। কাঠের ছোট টুকরো দিয়ে বানানো চাবির রিংয়ের একপাশে রঙিন কালিতে মুদ্রিত এরভঃ ড়ভ ঝযরসষধ, অন্যপাশটা খালি। চাবির রিংয়ের দাম দশ রুপি, নাম লিখিয়ে নিলে কুড়ি। আমি অনেকগুলো নেবো -এই প্রস্তাব দিয়ে দরদাম করি প্রতিটি পনেরো রুপি। যে দোকানির সঙ্গে কথা বলি, বেশ বয়স্ক মানুষটি, সম্মত হন। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসরুটের সহযাত্রী সহকর্মীদের নাম একটি কাগজে লিখে দেই, মাথায় নীল পাগড়ি, অনেকটা কাবুলিওয়ালার মতো দেখতে বয়স্ক শিখ ভদ্রলোকটি কালো রঙে তুলি ডুবিয়ে চমৎকার হরফে এক এক করে নামগুলো লিখে দেন। ইংরেজি হরফগুলো ভিক্টোরীয় স্টাইলের। আমি মন দিয়ে তার লিখনরীতি দেখি। ভাবি ইনি সেই হুশিয়ারপুরের যাত্রী কি না। চাবির রিং নয়, সিমলার কাঠের পণ্যের সেরা নমুনা হচ্ছে কাঠের খেলনা ও হাঁটার লাঠি।
রিজে এসে দেখি মানুষের ভিড় আরও প্রাণবন্ত হয়েছে, সুন্দরীদের মেলা বসেছে। আমার মনে পড়লো বৃটিশ শাসনামলে সিমলা ছিল শ্বেত চামড়াদের প্রণয়কুঞ্জ, কোর্টশীপের রাদেভূঁ। বিবাহযোগ্যা সাদা রমণীরা, বিবাহইচ্ছুক সাদা যুবকেরা জীবন সঙ্গী খুঁজতে সিমলায় আসতো। নাচ-গান, অভিসার, হৈ-হুল্লোড়ে সিমলার বাতাস ভরে থাকতো। সান্ধ্য মদের আসর আর কুমারী রাত যুবতী হলে জোড়ায় জোড়ায় নাচের নিক্কনধ্বনি বাহুলগ্নাদের ঘনিষ্ঠ করতো, আর দূরবর্তীদের করতো ঈর্ষান্বিত। সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল সংরক্ষিত। সিমলার সেসব কেচ্ছাকাহিনীও কম ছড়ায়নি বাতাসে, লোকমুখে। রিজে একটি ক্লাব আছে, আর নিচে আছে একটি জায়গা, যার নাম ঝপধহফধষ চড়রহঃ।
সিমলায় পর্যটকদের একটি প্রিয় জায়গা এই স্ক্যান্ডাল পয়েন্ট রিজ ও মল (গধষষ)-র মিলনস্থলে দাঁড়িয়ে, তাকে শনাক্ত করার জন্য একটি সাইনপোস্ট আছে। সিমলায় স্ক্যান্ডাল কম হয়নি, তবে এটি ছিল সবচেয়ে সাড়া জাগানো। কথিত আছে এ পয়েন্ট থেকেই ভাইসরয়ের মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যান পাতিয়ালার মহারাজা ভূপিন্দার সিং। সেটা ১৮৯২ সাল, মহারাজা প্রেমে পড়েন ওই বৃটিশ সুন্দরীর, সে মেয়েরও মন টলেছিল। ফলশ্রুতি ভাইসরয়ের ভয় উপেক্ষা করে যুগলের পলায়ন ও বিবাহ। ভাইসরয় সিমলায় মহারাজার প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারী করলে মহারাজা সিমলা থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে চাইল (ঈযধরষ)-এ এক অপূর্ব প্রাসাদ নির্মাণ করেন!
মলের চারপাশে অনেক দোকানপাট ও রেস্তরাঁ রয়েছে। সেখানে ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের এক নায়ক লালা লাজপত রায়ের পূর্ণদেহ স্ট্যাচু রয়েছে। লালা লাজপত রায় জন্মগ্রহণ করেন পাঞ্জাবে, তাকে ‘পাঞ্জাবের কেশরী’ নামে ডাকা হয়। ভাবলাম সাহসী জননায়ককে কোথায় এনে স্থাপন করলো হিমাচল সরকার? লাল বাল পাল খ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রভাবশালী ত্রয়ীর প্রথমজন তিনি, অন্য দু’জন হলেন বাল গঙ্গাধর তিলক ও বিপিন চন্দ্র পাল। সেখানে দু’জন বয়স্ক মানুষকে স্ক্যান্ডালটি কাকে নিয়ে ঘটেছিল জিজ্ঞেস করলে, একজন বললেন, ‘সে তো অনেক লম্বা গল্প।’
৫
সিমলার মানচিত্রটি ভারতের মানচিত্রের অনুরূপ (পূর্ব ভারত বাদে)। আমি আছি এই মানচিত্রের ঊর্ধ্বভাগে ভারতের মানচিত্রে সিমলা যেখানে, ঠিক সেখানেই। আমার হোটেল রুমের নিচেই মল (সধষষ) রোড, তার ওপাশে দামি হোটেল ক্লার্ক। সড়কের দু’পাশের দু’টি হোটেলে দামের কী বৈপরীত্য। আমার হোটেলের রুম ভাড়ার আট থেকে দশ গুণ ভাড়া ক্লার্ক হোটেলটির, যার বহিরাঙ্গ বৃটিশ আমলের, ভিতরে আধুনিক সকল বিলাসই উপস্থিত। দোতালা হোটেলটি পাঁচ তারকা স্ট্যাটাসের। শৈলনিবাস সিমলায় পাঁচ তারকা হোটেল আছে অনেকগুলো- ওবেরয় গ্রান্ড, রেডিসন, কমবারমেয়ার, মারিনা এবং আরও কিছু।পাহাড় চূড়া ও ঢালে বসানো হোটেলগুলোর জানালা ও ব্যালকনি থেকে হিমালয়ের অপূর্ব নিসর্গ দেখা যায়। এসব বিলাসবহুল হোটেলে নীতি একটাই- ফেল কড়ি, মাখো তেল।
মল-রিজ রোড ধরে স্কুল ইউনিফর্ম পরা বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরীরা যাচ্ছে। অনিন্দ্য শৈলশহরটি কেবল পর্যটনের জন্যই বিখ্যাত নয়, ভালো স্কুলের জন্যও সমধিক খ্যাত। সিমলায় প্রথম স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫৯ সালে, নিজের নামে তা প্রতিষ্ঠা করেন বিশপ কটন। দেড়শ’ বছরের প্রাচীন বিশপ কটন স্কুল আজো স্বমহিমায় প্রোজ্জ্বল। ভারতের সেরা আবাসিক স্কুলগুলোর তালিকায় তার স্থান প্রায় অটুট। দুনিয়ার অনেক সৈন্যবাহিনীর সেনাধ্যক্ষ এ স্কুলের ছাত্র ছিলেন। রতন টাটা, ললিত মোদি, কুমার গৌরব, জীভ মিলখা সিং, রাসকিন বন্ড-সহ অনেক বিখ্যাত মানুষ এ স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র।
১৮৬৪ ও ১৮৬৬ সালে দু’বছরের ব্যবধানে সিমলায় আরও দু’টি মিশনারি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। কনভেন্ট অফ যেশাস অ্যান্ড মেরি স্কুল (১৮৬৪)। এটি প্রথমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যুদ্ধে নিহত বৃটিশ সেনাদের এতিম হয়ে যাওয়া সন্তানদের এতিমখানা হিসেবে। পরে এটি মেয়েদের স্কুলে পরিণত হয়। প্রীতি জিনতা এ স্কুলেরই ছাত্রী। স্কুলটির অপর নাম চেলসি- একেবারে লন্ডনী কারবার! দ্বিতীয় স্কুল অকল্যান্ড হাউসও মেয়েদের একটি কনভেন্ট। ১৯০৫ সালের ভূমিকম্পে স্কুলটির ব্যাপক ক্ষতি হয়। ১৯২১ সালে পুরনো স্কুলটি পুরোপুরি ভেঙে লাল টিনের ছাদ ও হলুদ দেয়ালের চমৎকার ভবনসমূহ নির্মাণ করা হয়। সিমলায় কেবল মেয়েদের জন্য আরও একটি ভালো স্কুল আছে। এটি হলো লরেটো তারা হলো। ওই নামের জায়গায় অবস্থিত বলে এর নাম লরেটো তারা হলো। সারা ভারতে লরেটো সিস্টারদের প্রতিষ্ঠিত ১৫টি স্কুলের মাঝে তারা হলো স্কুলটি শীর্ষ তালিকায়।
ভারতের হিল স্টেশনগুলোতে, যেমন মিশৌরি, দেরাদুন, নৈনিতাল, দার্জিলিং-এ খ্রিস্টান মিশনারিরাই প্রথম বোর্ডিং স্কুল গড়ে তোলেন। কেবল সিমলা নয়, ভারতের প্রতিটি পাহাড়ি পর্যটন শহরে মিশনারিরা দারুণ সব স্কুল গড়ে তুলেছেন। শিক্ষার গুণগত মানের প্রতি তাদের নিষ্ঠা কিংবদন্তিতুল্য। ফলশ্রুতি আজো সর্বভারতীয় তালিকায় মিশনারি স্কুলগুলো অগ্রগণ্য, আর সমতলের চেয়ে অধিকতর মানসম্পন্ন পর্বতাঞ্চলের স্কুলগুলো। ধনী বাবা-মা এসব ব্যয়বহুল স্কুলে সন্তান পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন।
সিমলার আরও দু’টি ভালো স্কুল হলো উঅঠ পাবলিক স্কুল ও চিন্ময় বিদ্যালয়। এসব স্কুলের এলুমনাইরা ভারতের এলিট শ্রেণির অংশ, তারা অনেকেই নেতৃত্বের আসনে বসেছেন, নিজ নিজ ভুবনে স্বীকৃতি পেয়েছেন।
ভেবেছিলাম একটু গড়িয়ে নেবো, কিন্তু অমন সৌন্দর্যভরা পর্বতদুহিতার রূপ যে তাতে দেখতে পাবো না। তড়িঘড়ি সাদা মার্বেলে মোড়ানো সিঁড়ি বেয়ে নেমে বাইরে আসি। ডানে ঘুরলে বড় সিমলা, বামে ঘুরলে ছোট সিমলা। সবাই বড়র দিকেই যায়, আমিও গিয়েছি, সেখানেই সব স্ফূর্তি, আনন্দ আয়োজন। এবার মনে হলো ছোট সিমলার দিকে যাই। পূর্বমুখী সড়কটি ধরে যত এগুই ততই নির্জনতা, ততই প্রকৃতির সান্নিধ্য। কিছুদূর যেতে হিমাচল প্রদেশ হাইকোর্ট ভবন পড়লো। বাঙালকে হাইকোর্ট দেখাচ্ছে কোন অদৃশ্য শক্তি ভাবার চেষ্টা করলাম, তখন মনে পড়লো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই অবিস্মরণীয় পঙক্তি, ‘এ পথ তুমিই নিয়েছ বেছে।’
শেষ বিকেলে একটু হিম হিম বাতাসে হেঁটে যেতে অপূর্ব অনুভূতির সৃষ্টি হলো। রাস্তা যেখানে সার্প টার্ন নিয়ে উত্তরের উঁচু পাহাড়টির কোলের দিকে গেছে, সেখানে একটি বাড়ির প্রাঙ্গণে পাহাড়ি ফুলঅলা গাছে অনেকগুলো বানর বসে ফুল খাচ্ছে। আমাকে দেখে তারা বিন্দুমাত্র ভড়কালো না, আসলে ভড়কিয়েছি আমি। আরও ভড়কালাম নির্জন স্থানটিতে মাটি ফুঁড়ে দু’জন মানুষ আবির্ভূত হওয়ায়। কী চায় তারা? আমাকে একটি ছোট লিফলেট ধরিয়ে দিলো। তাতে পার্টটাইম কাজ, যেমন টিউশনি, ইত্যাদির সুযোগ। ভাবলাম ভালোই তো, মানুষ কাজ পায় না, এরা কাজ দিচ্ছে। বানরদের দিকে মন দিতে গিয়ে আমি মানুষ দেখতে পাইনি। উত্তরপুরুষের দিকে তাকিয়ে আমি পূর্বপুরুষ ভুলে গেলাম।
জাখু মন্দির যে পাহাড়ে সেখান থেকে নেমে এসেছে বানরগুলো। বিভিন্ন বাড়ির ছাদে তাদের অবাধ বিচরণ। বানরদের সান্ধ্যভোজে মগ্ন রেখে দৈবআবির্ভূত মানুষ দু’জনকে বিদায় জানিয়ে আমি চলে আসি ছোট সিমলার শেষ প্রান্তে। এখানে পথ বাঁক নিয়ে উঠে গেছে ঊর্ধ্বে, সেখানে হিমাচল প্রদেশের সচিবালয়ের হলুদরঙা বড় দালান। সময়াভাবে সেদিকটায় আর উঠিনি। অন্য কারণ সে সময়ে পশ্চিমের পাহাড়গুলোর চূড়ায় দিবাকর দেখা দিয়েছেন। আকাশ জুড়ে তার সপ্তরঙের সিংহাসন, রাজাধিরাজের মতো তার রূপ! একটি ছাদের মতো জায়গায় গাড়ি পার্ক করে রাখা, সেখানে রেলিঙ্গের পাশ থেকে নিচের ও পাহাড়গাত্রের ঘরবাড়ি, ওপাশের পাহাড়ে মনুষ্যবসতি, পাহাড়ের গা বেয়ে চলা পিঁপড়ের মতো গাড়ি সকল, আর আকাশে সূর্যের মোহময় সাম্রাজ্য বিমুগ্ধ হয়ে দেখি। নিচের একটি আগাগোড়া লাল রঙের দোতলা বাড়ি খুব পছন্দ হয় আমার। ইচ্ছে হয় সেখানে প্রিয়জনদের নিয়ে বসবাস করি। বুঝি কেন জীবনের সকল ইঁদুর দৌড় শেষ করে মানুষ পাহাড় বা সমুদ্রের কাছে যেতে চায় ঐকান্তিক ইচ্ছায়।
সূর্য না ডোবা পর্যন্ত আমি সেই খোলা ছাদে পায়চারি করলাম আর জগতে অসংখ্য মানুষের মতো আরেকটি সূর্যাস্ত প্রত্যক্ষ করলাম। জীবনে আমিও অনেক সূর্যাস্ত অবলোকন করেছি, তবে এ হলো সিমলায় সূর্যাস্ত এর তাৎপর্যই আলাদা।
(মানবজমিন ঈদ সংখ্যা ২০২৪-এ প্রকাশিত)