শেষের পাতা
টিপু হত্যাকাণ্ড
দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর হুমকিতে তটস্থ পরিবার, থানায় ১১ জিডি
স্টাফ রিপোর্টার
২৮ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবারশাহজাহানপুরে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যাকাণ্ডের দুই বছর পরও আতঙ্ক কাটেনি তার পরিবারে। এখনো হত্যা মামলার বাদী নিহতের স্ত্রীকে বিদেশি নম্বর থেকে হুমকি দিচ্ছে। দুবাইতে অবস্থানরত পলাতক দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর নামে অজ্ঞাত নম্বর থেকে আসামিদের জামিনে বাধা না দেয়া, মামলা তুলে নেয়াসহ বিভিন্ন কারণে প্রায়ই ফোন আসছে। অকথ্য ভাষায় গালাগালিসহ স্বামীর মতো স্ত্রী ও সন্তানকে হত্যা করা হবে। হুমকি পেয়ে টিপুর স্ত্রী দক্ষিণ সিটির নারী কাউন্সিলর ও মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ফারহানা ইসলাম ডলি পুলিশ ও ডিবি’র দ্বারস্থ হয়েছেন। থানায় জিডিও করেছেন। পুলিশের পক্ষ থেকে ডলির বাসায় নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। রাত-দিন দু’জন পুলিশ সদস্য তার বাসায় পাহারা দিচ্ছেন। তবুও ভয়ভীতি নিয়ে সন্তানরা স্কুল-বিশ^বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। ডলি রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও জনপ্রতিনিধি হওয়াতে নানা প্রয়োজনে বিভিন্ন স্থানে ছুটাছুটি করতে হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, টিপু হত্যার ঘটনায় টিপুর স্ত্রী ফারহানা শাহজাহানপুর থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলার তদন্ত করে ডিবি’র মতিঝিল বিভাগ ৩৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দিয়েছে। চার্জশিটে তালিকাভুক্ত অপরাধী জিসান আহমেদ ওরফে মন্টি ও জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ‘স্বাধীনতা’ মানিকসহ ছয়জনকে পলাতক দেখানো হয়েছে। পলাতক অন্য চারজন হলো- কামরুজ্জামান বাবুল, আমিনুল, রিফাত ও রানা মোল্লা। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বেশির ভাগ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে কাইল্লা পলাশসহ ছয়জন জামিনে রয়েছেন। মামলার প্রধান আসামি সুমন শিকদার ওরফে মুসা ও মাসুম মোহাম্মদ আকাশসহ চারজন এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
শাহজাহানপুর ও মতিঝিল এলাকার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এমন বেশ কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, মতিঝিল এলাকার প্রভাবশালী নেতা ছিলেন টিপু। তার আমলে কোনো সন্ত্রাসীই সেখানে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। টিপুর জন্য অনেকেই স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ নানা অবৈধ ব্যবসায় সুবিধা করতে না পেরে ওই এলাকার রাজনীতিবিদ, কাউন্সিলর, সাবেক ছাত্রনেতা, পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীরা মিলে টিপুকে হত্যার পরিকল্পনা ও পরে বাস্তবায়ন করেন। ডিবি’র তদন্তে পরিকল্পনা, নির্দেশদাতা, কিলারসহ অনেকের নাম উঠে এসেছে।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, টিপু হত্যাকাণ্ডে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জড়িত। ঘটনার শুরুতেই তদন্তে আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসীদের সম্পৃক্ততা পায় ডিবি। হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিদেশে পলাতক দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ মন্টি ও জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক একযোগে কাজ করেন। দেশে তাদের হয়ে কয়েকজন সরাসরি হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। এখনো তাদের সহযোগীরা মতিঝিল এলাকায় সক্রিয়। তারা এলাকায় চাঁদাবাজিসহ মাদক ব্যবসায় জড়িত রয়েছে। কিলিং মিশনের দেড় মাস আগে দুবাইয়ে পলাতক সন্ত্রাসী জিসানের নির্দেশে অস্ত্রের জোগান দেয় ইশতিয়াক আহমেদ জিতু। টিপুকে হত্যার আগে সেই অস্ত্রটিই দেয়া হয় শুটার মাসুম মোহাম্মদ আকাশকে।
টিপুর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম ডলি বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর সন্ত্রাসীরা আমাকে হুমকি-ধমকি দিয়ে চলেছে। কয়েকদিন আগেও বিদেশ থেকে এক শীর্ষ সন্ত্রাসী হত্যার হুমকি দিয়েছে আমাকে। ডিবি ও থানা পুলিশকে জানিয়েছি। আমার বাসায় নতুন করে পুলিশি নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। পরিবার নিয়ে চরম শঙ্কার মধ্যে আছি। ডলি আরও বলেন, চার্জশিটভুক্ত ছয় আসামি এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। তারাই আমাকে এখনো হুমকি দিচ্ছে। তিনি বলেন, স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে আমি দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। এতে তারা বাধা দিচ্ছে। পলাতক আসামিরা এখনো আমাকে মামলা তুলে নিতে হুমকি দিচ্ছে। জামিনে থাকা আসামিরাও তাদের লোকজন দিয়ে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। অপরাধীরা মামলা এগিয়ে নিতে বাধা দিচ্ছে। সর্বক্ষেত্রে তারা প্রভাব বিস্তার করে আমাকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ডিএমপি কমিশনার ও ডিবি প্রধানের কাছে অভিযোগ দিয়েছি। তারা আমার পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। আমাকে সব ধরনের সহযোগিতা করছেন তারা।
তিনি বলেন, স্বামী হত্যার পরিকল্পনাকারী মুসার গডফাদাররা এখনো সন্ত্রাসী তৎপরতায় রয়েছে। তাদের অনেকে জামিনে থেকে ফের পরিবারসহ তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছে। এ নিয়ে এ পর্যন্ত ১১টি জিডি করেছি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের উপ-কমিশনার (মতিঝিল) রাজীব আল মাসুদ বলেন, মামলার বাদী ফারহানা ইসলাম ডলি এর আগেও অনেক জিডি করেছেন। সম্প্রতি একটি বিদেশি নম্বর থেকে ফোন করে হুমকি দেয়া হয়েছে বলে জিডি করেছেন। আমাদের কাছেও এসেছিলেন। আমরা তদন্ত করছি। বিদেশি নম্বর হওয়াতে আমাদের ট্র্যাক করার সুযোগ নাই। তবুও আয়ত্তের ভেতরে যতটুকু আছে সেটি দিয়ে চেষ্টা করছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মতিঝিল এলাকায় এখন আর কোনো সন্ত্রাসী নেই। কারণ টিপু হত্যাকাণ্ডের পর আমরা সবাইকে গ্রেপ্তার করেছি। তারা এখনো জেলে আছে। এই হত্যা মামলার বেশির ভাগ আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। চার্জশিটও দিয়েছি। দেশের বাইরে থাকা পুরনো সন্ত্রাসীরা এলাকায় তাদের লোক দিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে বলে তথ্য পেয়ে তদন্ত চলছে।
গত রোববার টিপু হত্যার দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। ২০২২ সালের ২৪শে মার্চ রাতে শাহজাহানপুর রেলগেটের কাছে ফ্লাইওভারের নিচে যানজটে আটকে থাকা মাইক্রোবাসে থাকা টিপু (৫৫)কে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সময় সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে পাশের রিকশায় থাকা বদরুন্নেসা কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া আফরান জামাল প্রীতিও খুন হন।