নির্বাচিত কলাম
সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ
বুয়েটের পাল্টা রাজনীতি বাংলাদেশ ধরতে পারবে কি?
দিদারুল ভূঁইয়া
২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবারকাজেই প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে এদেশের মেডিকেল শিক্ষা ধ্বংস করো, রাজনীতি দিয়ে বুয়েট ধ্বংস করো, কারিকুলাম দিয়ে গোটা সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থাই (যতটুকু আছে আর কি) শেষ করে দাও - এটা ভারত, বাংলাদেশের মাফিয়াতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা যৌথ উদ্যোগ।
তাহলে কি এদেশের সব কিছুর, সকল আশা ভরসাই শেষ? মানুষ ঘুরে দাঁড়াবে না? দাঁড়াবে। এদেশের মানুষকে অনেকভাবে ঠকানো সম্ভব। অনেকদিন ধরেও ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু দিনশেষে বাংলাদেশের চাষা-ভুসারাই জয়ী হবেন। বাংলাদেশের আপামর জনতা যেমন ৭ তারিখের ডামি নির্বাচনকে হারিয়ে দিয়েছে, বুয়েটিয়ানরা যেমন আজকে এই মাফিয়াতন্ত্রের রাজনীতিকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে- এ পথেই দেশ একদিন মাফিয়াতন্ত্রকে পুরোপুরি পরাজিত করবে। সেদিন আর খুব বেশি দূরে নয়
২০১৯ সালের ৮ই অক্টোবর সকালে যখন সারা দেশ জানতে পারলো কী নির্মম, নৃশংসতায় আবরার ফাহাদকে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা সারারাত ধরে পিটিয়ে পিটিয়ে খুন করেছে; সে সকালটার কথা একবার ভাবুন তো। সে সময় যারা বুয়েট ছাত্র ছিল, তাদের কথা, তাদের পরিবারের কথা একবার ভেবে দেখুন। কেমন আতঙ্কের ছিল সে সকালটা তাদের জন্য? পরবর্তীতে ঘটনার পরম্পরায় যখন বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হলো, তারা সবাই কেমন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন?
তবে বুয়েটের ছাত্র, তাদের পরিবার, শিক্ষকসহ আপামর জনতার সেই স্বস্তি সরকারি দলের কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। তাই তারা এখন আবার বুয়েটে ছাত্র রাজনীতির নামে দুর্বৃত্তায়ন, কলুষতা ও মাস্তানতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে উঠে পড়ে লেগেছে।
ছাত্রলীগ এরইমধ্যে ঘোষণা করেছে ‘কারও বাপের সাধ্য নাই’ বুয়েটে এবার ছাত্রলীগকে রুখে।
আওয়ামী লীগ, সরকার এবং রাষ্ট্র কাঠামোর বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে এই সর্বোত প্রচেষ্টা কি কেবল রাজনীতির জন্যই আসলে? এমনটা দেশের কেউই মনে করেন বলে আমার মনে হয় না। এমনকি যারা এর পক্ষে কাজ করছেন, সমর্থন দিচ্ছেন; তারাও হয়তো না।
এ বিষয়ে আলাপের আগে আরও কয়েকটা বিষয় আরেকটু খুঁটিয়ে দেখি। বুয়েটিয়ানদের নিজস্ব একটি জরিপে অন্তত ৯৭ ভাগ বুয়েটিয়ান জানিয়েছেন তারা বুয়েটে রাজনীতি চান না। এখন রাজনীতির বাইরে আসলে কিছু নাই। বুয়েটিয়ানদের এই যে ‘না চাওয়া’, এটাও একটা রাজনৈতিক আচরণ। তাহলে কি বুয়েটিয়ানরা রাজনীতি কী, সেটাই বুঝেন না?
অনার্স চূড়ান্ত বর্ষের এক ছাত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘রাজনীতি ছাড়া বুয়েট অনেক ভালোভাবে চলছে। যখন রাজনীতি চালু ছিল তখন একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের আধিপত্য ছিল ক্যাম্পাসে। তখন তারা গায়ের জোরে ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ করেছে। (বিবিসি বাংলা, ১লা এপ্রিল)
যদিও এটা একজনের বক্তব্য মাত্র, কিন্তু কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে বোঝা যায়, বুয়েটিয়ানরা আসলে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির আধিপত্য চান না, রাজনীতির নামে গায়ের জোরে ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ চান না; জুলুম, নিপীড়ন, নির্যাতন- তথা জুলুমতন্ত্র চান না।
সে রাজনীতি কি আমরা সাধারণ মানুষরা চাই? না। চাই না। কেবল বুয়েটে নয়, কোথাও চাই না। নিশ্চয় বুয়েটিয়ানরাও কেবল বুয়েট নয়, কোথাও এমন রাজনীতি চান না। এখানে বুয়েটিয়ান এবং দেশের সাধারণ জনগণের আকাঙ্ক্ষা আসলে একদম একই। জরিপে যে ৯৭ শতাংশ বুয়েটিয়ান রাজনীতি চান নাই এবং ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনে যে প্রায় ৯৫ ভাগ ভোটার ভোট দেন নাই; দুইটা ভোটের ফলাফলে ৯০ এর ঘরের এই মিল মোটেই কাকতালীয় কিছু নয়। এটাই এখন এ দেশের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা। সবচেয়ে বড় সত্য- অন্তত ৯৫ ভাগ মানুষ এই জুলুম, লুটপাট, পাচারের রাজনীতি, পাচারের সরকার, রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি চান না। এর পরিবর্তন চান।
বুয়েটিয়ানদের দাবির আরেকটা দিক হলো, তাদের মূল অভিযোগ যে, সরকারি দলের (তা যে দলেরই সরকার থাকুক না কেন) জুলুমের বিপক্ষে, সেটা তারা প্রকাশ্যে তো দূরে থাক, এমনকি নাম প্রকাশ না করেও বলতে পারছেন না। পরিস্থিতিটা এতই নাজুক। এতই ভয়ঙ্কর। অবশ্য যেখানে নদীর পানি, গ্যাস, সার্বভৌমত্ব এসব নিয়ে বললেও পিটিয়ে খুন করা হয়, সেখানে এই ভীতি সহজে অনুধাবনযোগ্য।
বুয়েটিয়ানদের এই স্বাভাবিক যে দাবি, তার বিপরীতে ছাত্রলীগের তর্ক হলো রাজনীতি বন্ধের নামে বুয়েটে অপরাজনীতি, মৌলবাদ, জামায়াত- শিবির-হিজবুত তাহরীর রাজনীতি চলছে। তারা জানিয়েছে বুয়েটের হলে হলে হিজবুত তাহরীর পোস্টার, স্ক্যানকোডে ভর্তি। এমনকি হিজবুত তাহরীর নামে বুয়েটিয়ানদের নাকি ই-মেইলও করা হয়েছে। এসব বুয়েটিয়ানদের ‘অন্ধকার সংগঠন’টির দিকে প্রলুব্ধ করছে বলে ছাত্রলীগের অভিযোগ।
ছাত্রলীগের অন্য সব অভিযোগ ভৌত হলেও, এই পোস্টার, স্ক্যানকোডের অভিযোগ নিয়ে আলাপ করা দরকার। একটু দূর থেকে আলাপটা করা যাক। দেখবেন, ঢাকাসহ সারা দেশে আওয়ামী লীগ আর তার বিভিন্ন ডামি লীগ ছাড়া অন্য সকল দলের পোস্টারিং প্রায় নিষিদ্ধ। আমরা রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন বিভিন্ন সময়ে ঢাকা, রংপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় পোস্টারিং করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছি। এমনকি একবার নওগাঁর রাস্তায় পোস্টারিং করায় রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের এক নেতার বাড়িতে হামলা, এলাকায় শোডাউন, মিছিল, জঙ্গি সমাবেশ করেছিল ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ।
বুয়েটে এই পোস্টার, স্ক্যানকোড, ই-মেইলের ঘটনায়ও তাই অবাক হবার কিছু নাই। কথা হচ্ছে হঠাৎ ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন লীগ কেন বুয়েটের পেছনে লাগলেন? যেখানে আবরারের রক্তের দাগ এখনো শুকায় নাই? যেখানে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে খোদ শেখ মুজিবের বক্তব্য আছে?
সোশ্যাল মিডিয়াতে বিভিন্ন জনের যে মতামত, বুয়েটের আগামী বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের ফেয়ার শেয়ারের জন্য ছাত্রলীগের এই প্রস্তুতি- আমি এই মতের সঙ্গে দ্বিমত নই। তবে বিষয়টা এতটুকুই- এই মতের ঘোর বিরোধী।
একটু খেয়াল করলে দেখবো কারিকুলাম নিয়ে সরকারের যে উদ্যোগ, তাতে আগামী দিনে বাংলাদেশ হবে সারা পৃথিবীর ‘কামলা সাপ্লাইয়ার’। শ্রমজীবী মানুষকে খাটো করে দেখছি না। কথা হলো এই কারিকুলামে ছাত্র-ছাত্রীরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, আমলা হবে না। ভালো মানের কামলা হবে কেবল। এটা আমার কথা না। অনেক বিশেষজ্ঞরাই একথা বলেছেন, রাজপথে এই কারিকুলাম প্রতিরোধে আন্দোলন করছেন। আসলে মাফিয়াতন্ত্রের দিক থেকে দেখলে এটাই তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো। বাংলাদেশ, ভারত দুই দেশের মাফিয়ারাই এটা চায়।
বাংলাদেশের মাফিয়ারা চায় এদেশের কৃষকের ছেলে-মেয়েরা তাদের বিদেশ পড়ুয়া ননীর পুতুলদের চেয়ে সব দিক থেকে পিছিয়ে থাকুক। যাতে তারা এখানে ফিরে আমাদের ছেলে-মেয়েদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে পারে। এদেশের ছেলে-মেয়েরা সারা পৃথিবীতে ‘কামলা’ খেটে ডলার আনুক। যাতে এ মাফিয়ারা ও তাদের উত্তরসূরিরা সেগুলো লুটপাট ও পাচার করে তাদের ভোগের জোগান নিশ্চিত করতে পারে। আর ভারতের মাফিয়ারা চায় এদেশে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা আসবে ইন্ডিয়া থেকে। এদেশের ছেলে-মেয়েরা বিশ্বসেরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হলে ভারতের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারদের চাকরি দিবে কে? ভারতের যে বিপুল ডলারের চাহিদা, তার পূরণ হবে কেমন করে? এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে সফল হলে, এদেশের জনগণ উন্নত, মানবিক জীবনের অধিকারী হলে ভারত রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। বাংলাদেশ থেকে ভারতের ঝুঁকি আসলে এটাই।
কাজেই প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে এদেশের মেডিকেল শিক্ষা ধ্বংস করো, রাজনীতি দিয়ে বুয়েট ধ্বংস করো, কারিকুলাম দিয়ে গোটা সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থাই (যতটুকু আছে আর কি) শেষ করে দাও - এটা ভারত, বাংলাদেশের মাফিয়াতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা যৌথ উদ্যোগ। তাহলে কি এদেশের সব কিছুর, সকল আশা ভরসাই শেষ? মানুষ ঘুরে দাঁড়াবে না? দাঁড়াবে। এদেশের মানুষকে অনেকভাবে ঠকানো সম্ভব। অনেকদিন ধরেও ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু দিনশেষে বাংলাদেশের চাষা-ভুসারাই জয়ী হবেন। বাংলাদেশের আপামর জনতা যেমন ৭ তারিখের ডামি নির্বাচনকে হারিয়ে দিয়েছে, বুয়েটিয়ানরা যেমন আজকে এই মাফিয়াতন্ত্রের রাজনীতিকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে- এ পথেই দেশ একদিন মাফিয়াতন্ত্রকে পুরোপুরি পরাজিত করবে। সেদিন আর খুব বেশি দূরে নয়।
লেখক: অর্থনৈতিক সমন্বয়ক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন
ধন্যবাদ সবাইকে লেখাটি পড়ার ও মতামতের জন্য।
Mr. Mohsin, Can you show any positive contribution of govt party student organization in history?
এভাবে সাহসিকতার সাথে যদি সবাই কলম ধরে তাহলে দেশের রূপটা মনে হয় পাল্টে যাবে ধন্যবাদ দিদারুল আলম ভাই কে
সাবাস, দিদারুল ভূঁইয়া সাবাস। জাতি তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এক আবরারকে তারা নাশ করতে পেরেছে, সব আবরারকে নয়। সত্য-ন্যায়ের বিজয় অবশ্যম্ভাবি। মিথ্যা-অন্যায় ক্ষণস্থায়ী।
চমৎকার উপস্থাপনা। জনগনের মনের কথাগুলো তুলে ধরেছেন লেখক। সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সকল ছাত্র সংগঠনের রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তি বন্ধ করা এখন সময়ের দাবী। ছাত্রলীগ নামক বিষফোড়া সাধারণ ছাত্রদের আরেক আতংক।
অসাধারন ও সময় উপযোগী লিখা। BAL দের চেতনা দেশ দঃশের চেতনা। মামুরা সব শেষ করে দিবে।
বুয়েটের ছাত্র ছাত্রী রা সকল দলের রাজনীতির বিপক্ষে। রাজনীতির জায়গা হল রাজপথ, বুয়েট বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস নয়। এটা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জায়গা। যেখানে ভারত গাড়ি বানাচ্ছে, সেখানে আমরা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জায়গায় গুন্ডামীর রাজনীতি করতে চাচ্ছি।
এখানে কলাম লেখক যেভাবে শুধু একটা রাজনৈতিক দল কে তুলোধুনো করেছেন তাতে তার রাজনৈতিক পরিচয় নতুন করে দেওয়ার কি খুব দরকার আছে? আসলে তারা বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি করতে পারছে না বিধায় কেউ করতে পারবে না - এই মতে কথা বলছেন। বুয়েটে এর আগেও সনি হত্যা, দীপন হত্যা হয়েছে, এই কথা ইনারা কেউ বলছেন না। ছাত্র রাজনীতি এমন একটি বিষয় যেখানে আমাদের কে সাবধানতার সাথে কথা বলাই ভালো। এরাই আমাদের দেশের সব অর্জন এনে দিয়েছে। সেটা বুয়েট, মেডিক্যাল, সাধারণ বিস্ববিদ্যালয়, কলেজ এমনকি স্কুলের ছেলে মেয়েদেরও অবদান আছে। বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আড়ালে কি হচ্ছে তা কিন্তু পরিস্কার। কাচের ঘরে বসে ঢিলাঢিলি চলে না।