ঢাকা, ১০ মে ২০২৪, শুক্রবার, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিঃ

শরীর ও মন

গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা

সচেতনতা এবং স্বাস্থ্য সম্মত জীবনযাপন করলে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ কিডনি বিকল প্রতিরোধ সম্ভব

স্টাফ রিপোর্টার

(১ মাস আগে) ১০ মার্চ ২০২৪, রবিবার, ৬:১৫ অপরাহ্ন

বাংলাদেশে প্রাপ্ত বয়স্কদের মাঝে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগীর হার শতকরা ১৬ থেকে ১৮ ভাগ। কিডনি রোগের শেষ পরিণতি কিডনি বিকল। একবার কিডনি বিকল হয়ে গেলে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় কিডনি সংযোজন অথবা ডায়ালাইসিস। সবাই যদি কিডনি রোগের ব্যাপকতা, ভয়াবহতা, পরিণতি ও কারণ সম্পর্কে সচেতন থাকে এবং স্বাস্থ্য সম্মত জীবনযাপন করে তা হলে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে এই মরণঘাতী কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা সম্ভব।

‘‘বিশ্ব কিডনি দিবস-২০২৪’’ উদযাপন উপলক্ষ্যে আয়োজিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে দেশের শীর্ষস্থানীয় কিডনি বিষয়ক বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কিডনি এওয়ারনেস মনিটরিং এন্ড প্রিভেনশন সোসাইটি (ক্যাম্পস), শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে এই গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন।

বিশ্বব্যাপী কিডনি রোগ একটি ভয়াবহ স্বাস্থ্য সমস্যা, কিডনি রোগের প্রকোপ ব্যাপক, এ রোগের মারাত্মক পরিণতি, অতিরিক্ত চিকিৎসা খরচ এবং চিকিৎসা ব্যয় সাধ্যাতীত হওয়ায় সিংহভাগ রোগী প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর করুন চিত্র তুলে ধরেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ক্যাম্পস আয়োজিত “সবার জন্য কিডনি স্বাস্থ্য-চিকিৎসায় সমঅধিকার; অর্জনে করণীয়” শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। বক্তাগণ সরকারি/বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কিংবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত ও পরিকল্পিত প্রয়াসের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। 

বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ক্যাম্পস’র প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ। প্রবন্ধে তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুসারে, ২০৪০ সালের মধ্যে ৫০ লাখের বেশি কিডনি বিকল রোগী সংকটাপন্ন অবস্থায় চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করবে। বর্তমানে ৮৫ কোটির অধিক লোক দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। দুঃখজনক হলেও সত্য এরমধ্যে ৭৫ কোটি রোগী জানে না যে মরণঘাতী কিডনি রোগ নীরবে তাদের কিডনি নষ্ট করে চলেছে। প্রতি বছর ১ কোটি ৩০ লাখ লোক আকস্মিক কিডনি বিকল রোগে আক্রান্ত হয় যার ৮৫ ভাগই আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে। উন্নত দেশে কিডনি বিকলের চিকিৎসা করতে গিয়ে সরকার হিমশিম খাচ্ছে।

বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রাপ্ত বয়স্কদের মাঝে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগীর হার শতকরা ১৬ থেকে ১৮ ভাগ কিডনি রোগের শেষ পরিণতি কিডনি বিকল। একবার কিডনি বিকল হয়ে গেলে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় কিডনি সংযোজন অথবা ডায়ালাইসিস। কিন্তু এই চিকিৎসা এতটাই ব্যয়বহুল যে, শতকরা ১০ জন কিডনি বিকল রোগী তা বহন করতে পারে না। তাই আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে প্রায় ৯০ ভাগ রোগী বিনা চিকিৎসায় অথবা আংশিক চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করে। পক্ষান্তরে, সবাই যদি কিডনি রোগের ব্যাপকতা, ভয়াবহতা, পরিণতি ও কারণ সম্পর্কে সচেতন থাকে এবং স্বাস্থ্য সম্মত জীবনযাপন করে তা হলে ৫০ থেকে৬ ০ ভাগ ক্ষেত্রে এই মরণঘাতী কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা সম্ভব।

সুস্থ জীবন ধারার প্রধান সোপানগুলো হলো যেমন অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা, নিয়মিত ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রম করা, পরিমিত স্বাস্থ্যসম্মত বা সুষম খাবার গ্রহণ, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, ধূমপান পরিহার করা, পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি পান করা, তীব্র মাত্রার ব্যাথার ওষুধ পরিহার করা। তাছাড়া যারা ঝুঁকিতে আছেন যেমন যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ওজন বেশি, বংশে কিডনি রোগ আছে, যারা ধূমপায়ী, যারা তীব্র মাত্রার ব্যথার ওষুধ খেয়েছেন, যাদের পূর্বে কোন কিডনি রোগের ঝুঁকি আছে তাদের বছরে অন্তত ২ বার প্র¯্রাব ও রক্তে ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা করে নেয়া উচিত। কেননা প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগ শনাক্ত করতে পারলে চিকিৎসার মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

তিনি আরও বলেন, কিডনি বিকলের চিকিৎসা সর্বাধিক ব্যয়বহুল। ফলে চিকিৎসা করতে গিয়ে পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। উন্নত দেশগুলোতে ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজন স্বাস্থ্য বীমার মাধ্যমে হয়। রোগীর পকেট থেকে দিতে হয় না। পাশর্^বর্তী দেশগুলোতে আংশিক খরচ সরকার বহন করে থাকে। আশাকরি, শিগগিরই আমাদের দেশে ‘‘কিডনি সুরক্ষা বীমা” চালু হবে। যার ফলে হয়তো কিডনি রোগীদের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হবে এবং সবাইকে চিকিৎসার আওতায় আনা যাবে।  

আমরা ক্যাম্পসের স্লোগান ‘‘কিডনি রোগ জীবননাশা-প্রতিরোধই বাঁচার আশা’’ ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে চাই। অর্থাৎ কিডনি রোগ  প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করে চিকিৎসার মাধ্যমে মরণব্যাধি কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা যায়। এর জন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, কিডনি সহ অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত দরিদ্র, সুযোগ বঞ্চিত রোগীদের জন্য চিকিৎসা প্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য বীমা চালু করা যেতে পারে, বাইরের অনেক দেশে তা আছে, যদিও আমাদের দেশে কিছু সীমাবদ্ধতা ও রয়েছে।

তিনি বলেন, ক্যাম্পস’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদের যে প্রস্তাব বা দাবি যে প্রধানমন্ত্রীর নামে অর্থাৎ “শেখ হাসিনা কিডনি সুরক্ষা বীমা” নামে একটি বীমা প্রকল্প চালু করা, সেটি একটি ভাল আইডিয়া, আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এটি নিয়ে কথা বলব, তিনি মানব দরিদ্র এবং সবসময় মানুষের কল্যাণ চিন্তা করেন তাই দরিদ্র রোগীদের কল্যাণে এরকম একটি বিষয়ে তিনি সদয় বিবেচনায় নিতেও পারেন । তিনি বলেন, সরকার অব্যাহত ভাবে নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করে যাচ্ছে যার মূলে মানুষের মঙ্গল, যেমন বিনামূল্যে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ইনস্যুলিন সরবরাহ, উচ্চ রক্ত চাপের ২/১ টি ওষুধ বিনামূল্যে প্রদান এসব অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ থেকে কিডনির সমস্যা হওয়ার আশংকা প্রবল এবং এসবই নীরব ঘাতক অথচ একটু সচেতন হয়ে এ রোগগুলোর সবই প্রতিরোধ করা সম্ভব।

প্রতিরোধ করেই রোগ কমিয়ে আনার উপর গুরুত্ব আরোপ করে জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ বলেন, মানুষ হয়ত কথা শুনতে বা মানতে চায় না তবে কীভাবে বললে শুনবে সেই প্রক্রিয়ায় যেতে হবে তবেই সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে আর রোগের হার কমে আসবে ।
বৈঠকে অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, দেশে কিডনি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, ডায়ালাইসিস সেন্টার সহ কিডনি চিকিৎসার সুযোগ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই যৎসামান্য তাই দেশের কিডনি চিকিৎসার চিত্র খুবই হতাশা ব্যঞ্জক। যদি দেশে একসাথে ৪০ থেকে ৫০ হাজার রোগীর কিডনি বিকল হয়ে যায় তখন যে দুর্যোগ তৈরি হবে তা সামাল দেয়ার সামর্থ্য কোথায়? এটিকে মাথায় রেখে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।

কিডনি রোগকে ‘নীরব দুর্যোগ’ বলে উল্লেখ করে কিডনি ফাউন্ডেশন এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন উর রশিদ বলেন, এ রোগের জটিলতা ও চিকিৎসা ব্যয়ের আধিক্য বিবেচনায় প্রতিরোধকেই একমাত্র অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।

গাজী আশরাফ হোসেন বলেন, বিশেষ করে বাচ্চাদের এবং যুব সমাজের মাঝে যাতে কিডনি রোগ প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য নিয়মিত খেলাধুলা, নিয়মিত হাঁটা ও ব্যায়াম করার ব্যবস্থা নিতে হবে। কঠিনভাবে তাদের ফাস্টফুড, জাঙ্কফুড, অলসতার প্রবণতা থেকে মুক্ত করতে হবে।

ক্যাম্পস এর নির্বাহী পরিচালক রেজওয়ান সালেহীন বলেন, ক্যাম্পস কিডনি রোগ প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত সচেতনতার বাণী প্রচার করে যাচ্ছে। আমরা যদি কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলি তা হলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

শরীর ও মন থেকে আরও পড়ুন

প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2022
All rights reserved www.mzamin.com