বাংলারজমিন
নোয়াখালী জেলা প্রশাসনে ৪ প্রভাবশালী কর্মচারী অবৈধ বিদেশ ভ্রমণ ও সম্পদ অর্জন করেও বহাল তবিয়তে
স্টাফ রিপোর্টার, নোয়াখালী থেকে
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, রবিবারনোয়াখালী জেলা প্রশাসনের চার কর্মচারী অবৈধভাবে একাধিকবার বিদেশ ভ্রমণসহ স্বর্ণ চোরাচালান ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গঠিত তদন্ত কমিটি তদন্তে সত্যতা পেয়েছে। পাঁচ বছর আগে ঘটনার সত্যতা পেয়ে তাদের পাসপোর্ট জব্দসহ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে তদন্তের সুপারিশ করেছে। কিন্তু এ পর্যন্তই শেষ। অভিযুক্তরা এখনো দাপটের সঙ্গে কাজ করছে।
অভিযুক্তরা হলেন, জেলা প্রশাসনের সংস্থাপন শাখার (সদ্য অবসরপ্রাপ্ত) অফিস সহকারী মো. আবদুল মুকিত, এল.এ (ল্যান্ড এক্যুইজিশন) শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মোস্তফা, এসএ (এস্টেট এক্যুইজিশন) শাখার অফিস সহকারী আবদুর রহিম, এল.এ (ল্যান্ড এক্যুইজিশন) শাখার অফিস সহকারী মো. রিয়াজ উদ্দিন। সূত্র মতে নোয়াখালীর সাবেক জেলা প্রশাসক বদরে মুনির ফেরদৌসের নেতৃত্বে ২০১৪-১৭ সাল পর্যন্ত অভিযুক্তরাসহ আরও কিছু অসাধু কর্মচারী সিন্ডিকেট গড়ে তোলে গণপূর্তের রেকর্ডীয় জমি খাস দেখিয়ে কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে বন্দোবস্ত, ঘুষ নিয়ে কর্মচারী বদলি, পদোন্নতি ও লোকজনকে চাকরি দিয়েছেন। এছাড়া চার কর্মচারী কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে একাধিকবার বিদেশ ভ্রমণ করে চোরাচালানে জড়িয়ে পড়ে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন।
এনিয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) দীপক চক্রবর্তী ২০১৯ সালের ৩১শে জানুয়ারি বিষয়টি সরজমিন তদন্ত করেন এবং ওই বছরের ৩১শে মার্চ প্রতিবেদন দাখিল করেন। এতে তিনি অভিযুক্ত চার কর্মচারীর অবৈধ বিদেশ ভ্রমণসহ বিপুল বিত্তবৈভব অবৈধভাবে অর্জনের প্রমাণ পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন। প্রতিবেদনের সুপারিশে তদন্ত কর্মকর্তা দীপক চক্রবর্তী বলেন, অফিস সহকারী আবদুল মুকিত, আবদুর রহিম, হারাধন চন্দ্র পালকে আর্থিক সংশ্লেষমূলক রাজস্ব শাখা, উপজেলা ভূমি অফিস, ট্রেজারি শাখা, আরএম শাখায় এক বছরের কম সময়ান্তে ৩-৪ বার পদায়ন ও দীর্ঘ সময় থাকার সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগে বর্ণিত কর্মচারী সিন্ডিকেটকে অবৈধ উপার্জনের সুযোগ করে দেওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত মর্মে প্রতীয়মাণ হয়। এছাড়া আবদুল মুকিত ও আবদুর রহিম কর্তৃক যথাযথ কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে বিদেশ ভ্রমণের বিষয়টি প্রমাণিত মর্মে প্রতীয়মাণ হয়। এ দু’জনের বিপুল বিত্তবৈভব অবৈধভাবে অর্জনের বিষয়টি পাসপোর্ট জব্দ করাসহ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্তৃক বিস্তারিতভাবে তদন্ত করা প্রয়োজন।
সুপারিশে আরও বলা হয়, বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত অফিস সহকারী আবদুল মুকিত, আবদুর রহিম ও হারাধন চন্দ্র পালকে আর্থিক সংশ্লেষবিহীন শাখায় জরুরি ভিত্তিতে পদায়নের জন্য নোয়াখালী জেলা প্রশাসককে নির্দেশনা প্রদান করা প্রয়োজন। এছাড়া কর্মচারীদের বদলি-পদায়নের ক্ষেত্রে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জেলা ম্যাজিস্ট্রেসি পরিবীক্ষণ অধিশাখার ২০১৫ সালের ৮ই জুলাই তারিখের ১৯১ নম্বর স্মারকের নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ না করার দায় তৎকালীন জেলা প্রশাসক বদরে মুনির ফেরদৌস এড়াতে পারেন না।
দায়ের হওয়া প্রতিবেদনসহ বিষয়টি তৎকালীন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান ২০১৯ সালের ১৫ই এপ্রিল দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মহাপরিচালক (তদন্ত) মো. মোস্তাফিজুর রহমানকে চিঠি দিয়ে অবহিত করেন। তবে বিগত পাঁচ বছরেরও অনিয়মে জড়িত এসব কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উপরন্তু অসাধু এ সিন্ডিকেট দিন দিন আরও শক্তিশালী হয়ে জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরকে নিজেদের কব্জায় রেখে অনিয়ম করে আসছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে জেলা প্রশাসনের সংস্থাপন শাখার সাবেক অফিস সহকারী মো. আবদুল মুকিত, এসএ (এস্টেট এক্যুইজিশন) শাখার বর্তমান অফিস সহকারী আবদুর রহিম, এল.এ (ল্যান্ড এক্যুইজিশন) শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মোস্তফা ও একই শাখার অফিস সহকারী মো. রিয়াজ উদ্দিনের অবৈধ বিদেশ ভ্রমণের বিস্তারিত ইমিগ্রেশন তথ্য প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
এতে দেখা যায়, সংস্থাপন শাখার সাবেক অফিস সহকারী মো. আবদুল মুকিত দু’টি পাসপোর্ট (এই-৫৪২৪২০৭ ও বিপি-০৬৫৪৪৭৪) ব্যবহার করে সাতবার অবৈধভাবে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। এরমধ্যে ২০১৩ সালের ২৭শে জুন কলকাতা গিয়ে ফেরেন ৫ই জুলাই, ২০১৫ সালের ২১শে আগস্ট মালয়েশিয়া গিয়ে ফেরেন ৩০শে আগস্ট, একই বছরের ২৪শে ডিসেম্বর মালয়েশিয়া গিয়ে ফেরেন ২০১৬ সালের ১লা জানুয়ারি, ২০১৬ সালের ২৯শে এপ্রিল সিঙ্গাপুর গিয়ে ফেরেন ১ মে, একই বছরের ২৬শে মে সিঙ্গাপুর গিয়ে ফেরেন ২৯ মে, ওই বছরের ২০ অক্টোবর ব্যাংকক গিয়ে ফেরেন ২৩শে অক্টোবর এবং ২০১৭ সালের ২৫শে জুলাই সিঙ্গাপুর গিয়ে ফেরেন ২৮শে জুলাই।
এস.এ শাখার অফিস সহকারী আবদুর রহিম এই-৩৬৯৫৮৯২ নম্বরের পাসপোর্ট ব্যবহার করে গত ২০১৩ সালের ২৬শে জুন কলকাতা গিয়ে ফেরেন ৩ জুলাই, ২০১৫ সালের ২১শে আগস্ট মালয়েশিয়া গিয়ে ফেরেন ৩০শে আগস্ট, একই বছরের ২৪শে ডিসেম্বর মালয়েশিয়া গিয়ে ফেরেন ২০১৬ সালের ১লা জানুয়ারি, ২০১৬ সালের ২৯শে এপ্রিল সিঙ্গাপুর গিয়ে ফেরেন ১লা মে, একই বছর ২৬শে মে সিঙ্গাপুর গিয়ে ফেরেন ২৮শে মে, ওই বছরের ২১শে জুলাই সিঙ্গাপুর গিয়ে ফেরেন ২৫শে জুলাই।
এল.এ শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মোস্তফা এসি-৯৭৩০১৬৪ নম্বর পাসপোর্ট ব্যবহার করে মোট ৮ বার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। এরমধ্যে ২০১২ সালের ১৬ই জুলাই কলকাতা গিয়ে ফেরেন ১৯শে জুলাই, একই বছরের ৫ই ডিসেম্বর ব্যাংকক গিয়ে ফেরেন ১০ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সালের ২৬শে জুন কলকাতা গিয়ে ফেরেন ৫ই জুলাই, ২০১৫ সালের ২৫শে জুলাই ব্যাংকক গিয়ে ফেরেন ২৯শে জুলাই, একই বছরের ২৪শে ডিসেম্বর মালয়েশিয়া গিয়ে ফেরেন ২০১৬ সালের ১লা জানুয়ারি, ২০১৬ সালের ২৬শে মে সিঙ্গাপুর গিয়ে ফেরেন ২৯শে মে, একই বছরের ২০শে অক্টোবর ব্যাংকক গিয়ে ফেরেন ২৩শে অক্টোবর এবং ২০১৭ সালের ১০ই মার্চ ভারত গিয়ে ফেরেন ১৩ই মার্চ।
এল.এ শাখার অফিস সহকারী মো. রিয়াজ উদ্দিন এই-২৪৪৭২৭২ নম্বর পাসপোর্ট ব্যবহার করে সাতবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। এরমধ্যে ২০১৩ সালের ২৬শে জুন কলকাতা গিয়ে ফেরেন ৫ই জুলাই, ২০১৫ সালের ২৫শে জুলাই ব্যাংকক গিয়ে ফেরেন ২৯শে জুলাই, একই বছরের ২১শে আগস্ট মালয়েশিয়া গিয়ে ফেরেন ৩০শে আগস্ট, ২০১৬ সালের ২৯শে এপ্রিল সিঙ্গাপুর গিয়ে ফেরেন ১লা মে, ২৬শে মে সিঙ্গাপুর গিয়ে ফেরেন ২৯শে মে, ২১শে জুলাই সিঙ্গাপুর গিয়ে ফেরেন ২৫শে জুলাই এবং ওই বছরের ২০শে অক্টোবর ব্যাংকক গিয়ে ফেরেন ২৩শে অক্টোবর। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অফিস সহকারী আবদুল মুকিত নোয়াখালী সদর উপজেলার বিনোদপুর গ্রামের মো. আবদুল সোবহানের ছেলে। তিনি ১৯৮৩ সালের ৩রা অক্টোবর এমএলএসএস পদে চাকরিতে যোগদান করে ১৯৮৮ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর জারীকারক পদে এবং ২০০৩ সালের ১৬ই নভেম্বর অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে পদোন্নতি পান। পরে তিনি নোয়াখালী ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়, ফেনীর পরশুরাম ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ নোয়াখালী সদর, বেগমগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ ও হাতিয়া ভূমি অফিসে চাকরি করেন। বিভিন্ন স্থানে তার অন্তত ২০ কোটি টাকার দৃশ্যমান সম্পদ থাকার অভিযোগ উঠলেও তিনি নির্বিঘ্নে অবসরে যান।
এস.এ শাখার অফিস সহকারী আবদুর রহিম নোয়াখালী সদর উপজেলার ফকিরপুর গ্রামের মো. আবদুর রশিদের ছেলে। তিনি ১৯৯৬ সালের ১লা ডিসেম্বর এমএলএসএস পদে নোয়াখালী জেলার রাজস্ব প্রশাসনের এসএ শাখায় যোগদান করেন। পরে ২০০৩ সালের ১৫ই নভেম্বর পর্যন্ত তিনি বেগমগঞ্জ ও হাতিয়া ভূমি অফিসে চাকরি করেন। ২০০৩ সালের ১৬ই নভেম্বর অফিস সহকারী-কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে পদোন্নতি পেয়ে তিনি জেলা প্রশাসকের সংস্থাপন শাখায় যোগদান করেন। পরে ২০০৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে, ২০০৭ সালের ২৩শে এপ্রিল পর্যন্ত কালেক্টরেট নেজারত শাখায়, ২০০৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এস.এ শাখায়, ২০১৬ সালের ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত আর.এম শাখায় এবং ২০১৬ সালের ১২ই এপ্রিল থেকে অদ্যাবধি এস.এ শাখায় কর্মরত আছেন। তার কোটি কোটি টাকার বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লটসহ সম্পদের পাহাড়ের উৎস অদৃশ্য কারণে তদন্ত হয়নি। তার কাছে এখনো ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদেরকে ‘ভালো জায়গায়’ বদলির জন্য তদবিরের কোটি কোটি টাকা জমা আছে বলে অভিযোগ আছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে আবদুল মুকিত, আবদুর রহিম, মো. মোস্তফা ও মো. রিয়াজ উদ্দিন, তারা সকলেই কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে বিদেশ ভ্রমণের বিষয়টি নিশ্চিত করলেও অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের বিষয়টি অস্বীকার করেন। এছাড়া চার কর্মচারীর সবার দাবি, অবৈধভাবে বিদেশ ভ্রমণের জন্য তারা রাষ্ট্রের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন। অন্যদিকে নোয়াখালীর সাবেক জেলা প্রশাসক বদরে মুনির ফেরদৌসের মোবাইলে বারবার কল দিলেও তা বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। নোয়াখালীর বর্তমান জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, কর্মচারীদের এমন বিদেশ ভ্রমণ সম্পূর্ণ অবৈধ। তাদের এ বিষয়টি নিয়ে আগেই ব্যবস্থা নেয়ার কথা। না নিয়ে থাকলে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।