শেষের পাতা
অমর একুশে গ্রন্থমেলা
লাগামহীন বইয়ের দাম, ক্রয়ের তালিকা সংক্ষিপ্ত করছেন পাঠক
মুনির হোসেন
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বৃহস্পতিবারঅমর একুশে গ্রন্থমেলা এখন তার ‘যৌবন’ পার করছে। বরাবরের মতো মধ্য ফেব্রুয়ারিতে এবারো মেলা জমে উঠেছে। নগরে মেট্রোরেলের নতুন সংযোগের কারণে শুরু থেকেই মেলায় দর্শনার্থীদের ভিড় ছিল লক্ষণীয়। যদিও মূল বিকিকিনি শুরু হয়েছে মাঝ সময়ে এসে । এখন মেলায় আসলে পাঠক বই কিনছেন। তবে বইয়ের দাম নিয়ে আক্ষেপ রয়েছে তাদের। চাইলেই পছন্দ মতো বই কিনতে পারছেন না পাঠক। তাই ক্রয়ের তালিকা সংক্ষিপ্ত করতে হচ্ছে তাদের। কারণ এবারের মেলায় বইয়ের দাম লাগামহীন। অন্যান্য বারের তুলনায় বইপ্রতি দাম বেড়েছে প্রায় ৪৫-৫০ শতাংশ। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। প্রকাশকরা বলছেন, কাগজ, কালি, মুদ্রণ, বাইন্ডিংসহ বিভিন্ন খাতে দাম বাড়ায় বইয়ের দাম বাড়াতে হয়েছে। তবুও পাঠকের কথা মাথায় রেখে বইয়ের দাম যথেষ্ট রিজনেভল রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। তারা জানান, এবারের মেলায় যে পরিমাণ দর্শনার্থী আসছেন সেই তুলনায় বিক্রি হচ্ছে না। অন্যদিকে পাঠক বলছেন, দাম বেশি হওয়ায় বই কিনতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। চাহিদামতো যথেষ্ট বই কিনতে পারছেন না তারা। ক্রয়ের তালিকা করতে হচ্ছে সংক্ষিপ্ত। এ ক্ষেত্রে পছন্দের লেখকের বই কিনতে না পারারও আক্ষেপ রয়েছে অনেকের। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা দাম বাড়ায় পছন্দমতো বই কিনতে পারছেন না। বইয়ের দাম বাড়ায় সৃজনশীল জ্ঞান চর্চা ব্যাহত হচ্ছে বলেও মনে করেন তারা।
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব মেলায়ও পড়েছে। বইয়ের দাম বেড়ে গেছে অনেকগুণ। যেটি পাঠকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বই পড়ুয়াদের বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত। এসব ঘরের ছেলে মেয়েরা প্রচুর বই পড়ে। সে তুলনায় উচ্চবিত্তরা কম পড়ে। কিন্তু বইয়ের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদেরকে বই ক্রয়ের তালিকা সংক্ষিপ্ত করতে হচ্ছে। যেটি খুবই কষ্টকর। বইয়ের দাম সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা উচিত বলে মনে করেন তিনি। নালন্দ প্রকাশনীর ম্যানেজার মো. জাকির হোসেন খান বলেন, একজন প্রকাশক বরাবরই চান বইয়ের দাম পাঠকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে। কারণ বেশি পাঠকের কাছে বই পৌঁছে দেয়া হচ্ছে একজন প্রকাশকের সার্থকতা। তাই প্রকাশক কখনো চান না বই পাঠকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাক। তবে কাগজ, কালি, প্রিন্টিংসহ সব ক্ষেত্রে দাম বাড়ায় বইয়ের দাম বাড়াতে হচ্ছে প্রকাশকদের। তিনি বলেন, কাগজের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। মেকআপ প্লেট আগে যেটার দাম ১০০ টাকা ছিল সেটি এখন ২৮০ টাকা, ৫ ফর্মা বান্ডিং আগে ছিল ১০ টাকা এখন সেটি ২০ টাকা, আগে যে কালি ১৫০ টাকায় কেনা যেতো এখন সেটি কিনতে হচ্ছে ৩০০ টাকার বেশি দিয়ে- সব মিলিয়ে ছাপানোয় দাম বেড়েছে অনেক।
এ ছাড়াও প্রুফ রিডিংসহ অন্যান্য লেবার কস্টও বেড়ে গেছে। তাই প্রকাশকরা বইয়ের দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। ইয়াজ আল রিয়াদ নামে সাবেক এক ছাত্রনেতা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লিখেন, মেলায় বইয়ের দাম দেখে ভিরমি খেয়ে গেলাম। এক কথায় আগুন বলতে যা বুঝায় আর কি। তাই মাত্র একটা বই কিনে চলে এলাম। সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলাম বলেন, বইয়ের দাম বাড়লে একজন পাঠককে তার চাহিদার তালিকা সংক্ষিপ্ত করতে হয়। আবার যেসব পাঠক একটি করে বই কিনতো সে কেনা বন্ধ করে দেবে। তাই অন্যান্য জিনিসের মতো বইয়ের দাম বাড়ালে পাঠকের বই কেনার প্রতি অনীহা তৈরি হবে। সহনীয় রাখলে সবাই বই কিনবে, পড়বে। যেটা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে। রাজধানীর সিটি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ইমামুল হক বলেন, বইয়ের দাম অনেক বেড়ে গেছে। আমরা চাইলেও পছন্দমতো বই কিনতে পারছি না। কিছুটা রিজনেভল রাখলে আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো হয়। ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রী নাইমা সুলতানা বলেন, বইয়ের দাম এবার অন্যান্য বারের তুলনায় অনেক বেশি। একটি ভালো মানের বইয়ের দাম ৫০০ টাকার উপরে।
৫ হাজার টাকা বাজেট করেও অনেকে ১০টা বই কিনতে পারছেন না। সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে মনোযোগী হওয়া উচিত বলে মনে করেন এ শিক্ষার্থী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কানিজ ফাতিমা বলেন, মেলায় সব বইয়েরই দাম বেড়ে গেছে। শিক্ষার্থীরা পড়তে চায়, কিন্তু বইয়ের দাম বেড়ে যাওয়ায় কিনতে পারে না। বইয়ের দাম বাড়লে সৃজনশীল সাহিত্য চর্চা ব্যাহত হয়। তাই উৎপাদন খরচ কমিয়ে পাঠকের হাতে বই তুলে দেয়া মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। জিনিয়াস পাবলিকেশনের ম্যানেজার আব্দুল বাতেন ভূঁইয়া বলেন, কাগজ, কালি, মুদ্রণ, প্লেট, প্রুফ রিডিং সব ক্ষেত্রে দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। তাই চাইলেও বইয়ের দাম কম রাখা সম্ভব নয়। আগে যে কাগজ ১৮০০ থেকে ২২০০ টাকায় ক্রয় করা হতো এখন সেটি কিনতে হচ্ছে ৩২০০ থেকে ৩৫০০ টাকায়। তবে পাঠকের ক্রয়ক্ষমতার কথা চিন্তা করে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি জানান, বইয়ের দাম ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ বেড়েছে। পাঞ্জেরি পাবলিকেশনের ইনচার্জ ইফতেখার আহমেদ আজিজ বলেন, প্রকৃত পাঠক যারা তারা দাম বাড়লেও কিনবেন- কমলেও কিনবেন। তাদের কাছে দাম মুখ্য নয়। তবে এটা ঠিক যে কেউ কেউ পাঁচটার জায়গায় একটা কিনছেন। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কাগজ, কালি, প্লেট, প্রিন্টিংসহ সব খাতে দাম বাড়ায় বইয়ের দাম বাড়াতে হয়েছে। ঐতিহ্য প্রকাশনীর প্রকাশক আরিফুর রহমান বলেন, মেন্টেনিংস কস্ট বেড়ে যাওয়ায় বইয়ের দাম বাড়ানো লাগে। তবে আমরা বইয়ের দাম পাঠকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে চেষ্টা করছি।
সব কিছুর দাম বাড়তি, উনাদের দোষ কোথায়?