প্রথম পাতা
অমর একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আজ
স্টাফ রিপোর্টার
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বুধবার
অমর ২১শে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আজ। মায়ের ভাষার দাবিতে বাঙালির আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর গৌরবময় দিন। বাঙালির আত্মগৌরবের স্মারক অমর একুশের এদিনে জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে মহান ভাষা শহীদদের, যাদের আত্মত্যাগে আমরা পেয়েছি মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার। যাদের ত্যাগে বাংলা বিশ্ব আসনে পেয়েছে গৌরবের সুউচ্চ আসন। একুশের প্রথম প্রহর থেকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হচ্ছে মহান ভাষা শহীদদের। সকালে প্রভাত ফেরির মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানানো হয় ভাষা শহীদদের। একুশের প্রথম প্রহরে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানান ভাষা শহীদদের প্রতি। দিবসটি উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। দিবসটি উপলক্ষে বেতার ও টেলিভিশনগুলো বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করছে।
এদিকে গতকাল এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২১ জন বিশিষ্ট নাগরিকের হাতে একুশে পদক তুলে দিয়েছেন। মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় ১৯৫২-এ জীবন দিয়েছিলেন সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, শফিউল্লাহ সহ নাম না জানা অনেকে। তাদের রক্তের বিনিময়েই আজকে মুখে মুখে বাংলা ভাষা। বাংলায় রচিত হচ্ছে হাজারো গান, কবিতা, নাটক, উপন্যাস আর অজস্র কথামালা। আজকের দিনটি শুধু সেই বীর ভাষাসৈনিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর, যারা ভাষার জন্য অকাতরে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন। দিনটি কেবল বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের সব প্রান্তে পালিত হচ্ছে বীরের রক্তস্রোত আর মায়ের অশ্রুভেজা অমর একুশে। বাঙালির রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতি দিয়ে জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। এরপর থেকেই যথাযোগ্য মর্যাদায় সারা বিশ্বে একযোগে পালিত হয়ে আসছে দিনটি।
একুশের এই দিনে বাংলার সংগ্রামী ছেলেরা যে ত্যাগ ও গৌরবগাঁথা রচনা করেছিলেন, তারই পথ ধরে আমরা মুখোমুখি হই স্বাধীনতা সংগ্রামে। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। লাভ করি লাল-সবুজের পতাকা। ১৯৫২ সালের এই দিনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনরত বাঙালি রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করে। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে হরতালের প্রস্তুতি চলতে থাকে। সরকার ২০শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ছয়টায় একটানা এক মাসের জন্য ঢাকা জেলার সর্বত্র হরতাল, সভা, মিছিলের ওপর ১৪৪ ধারা জারি করে।
এসব নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ছাত্ররা দলে দলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত হয়। ঐতিহাসিক আমতলায় ছাত্রদের সভা থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরিকল্পনা করা হয়, চার জন, চার জন করে মিছিল নিয়ে বের হওয়ার। ছাত্ররা মিছিল শুরু করলে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে ট্রাকে তুলতে থাকে। বিকাল ৩টায় গণপরিষদের অধিবেশনের আগেই শুরু হয়ে যায় ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ। বিকাল ৪টায় পুলিশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ছাত্রদের ওপর গুলি চালায়। বুলেট কেড়ে নেয় জব্বার ও রফিকের প্রাণ। গুলিবিদ্ধ আবুল বরকত রাত পৌনে আটটায় হাসপাতালে মারা যান। তাদের মৃত্যু সংবাদে বাংলা ভাষার প্রাণের দাবি সারা দেশে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে। শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। এরপর থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারি অমর ভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। শহীদদের স্মরণে সারা দেশে তৈরি হয় অসংখ্য শহীদ মিনার।
একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি। এদিন দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সঠিক নিয়মে, সঠিক রং ও মাপে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। দিবসটি পালন উপলক্ষে জাতীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনসমূহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
আজিমপুর কবরস্থানে ফাতেহা পাঠ ও কোরআনখানির আয়োজনসহ দেশের সকল উপাসনালয়ে ভাষা শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনায় প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশ মিশনসমূহ শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাণী পাঠ, বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন বিষয়ক আলোচনা সভা, পুস্তক ও চিত্র প্রদর্শনীসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করবে যেখানে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক এবং বাঙালি অভিবাসীদের আমন্ত্রণ জানানো হবে।
এ ছাড়াও দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদ্যাপন উপলক্ষে ঢাকা শহরের বিভিন্ন সড়কদ্বীপ সমূহ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সুবিধাজনক স্থানসমূহে বাংলাসহ অন্যান্য ভাষার বর্ণমালা সংবলিত ফেস্টুন দ্বারা সজ্জিত করা হয়েছে। একুশের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সমপ্রচার এবং ভাষা শহীদদের সঠিক নাম উচ্চারণ, শহীদ দিবসের ভাবগাম্ভীর্য রক্ষা, শহীদ মিনারের মর্যাদা সমুন্নত রাখা, সুশৃঙ্খলভাবে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, ইত্যাদি জনসচেতনতা মূলক বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি গণমাধ্যমসমূহ প্রয়োজনীয় প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
সংবাদপত্রসমূহে ক্রোড়পত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদানের বিষয়টি বিশেষভাবে উপস্থাপন করা হবে। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো একুশের বিশেষ অনুষ্ঠান সমপ্রচার করবে। মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ দুইদিনব্যাপী বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে একুশের প্রথম প্রহরে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবনসহ সারা দেশে সংগঠনের সকল কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ এবং প্রভাতফেরি।
এ ছাড়াও বিকাল ৩টায় রাজধানীর তেজগাঁওস্থ ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে সভাপতিত্ব করবেন। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক বিবৃতিতে ‘মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উপলক্ষে গৃহীত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করার জন্য আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনসমূহের সকল স্তরের নেতাকর্মী, সমর্থক এবং সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
দিবসটি উপলক্ষে বিএনপি গতকাল আলোচনা সভার আয়োজন করে। এতে কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য রাখেন। দলটির পক্ষ থেকে আজ সকালে প্রভাতফেরিতে অংশ নেবেন নেতাকর্মীরা।
পাঠকের মতামত
*শহীদ মিনার: করণীয় কী? আর করছি কী!* শহীদ মিনার ১৯৫২ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি সর্বপ্রথম নির্মাণ করা হয়। যা একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা শহীদদের স্মরণে ঢাকা মেডিকেল কলেজের পার্শ্বে নির্মাণ করা হয়েছিল। একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন এ যারা অংশগ্রহণ করেন তাদের প্রায় ৯০ শতাংশ মুসলিম। কিন্তু এ দিবস উদযাপন উপলক্ষে যা করা হয় তা মুসলিমদের আকিদা-বিশ্বাসের সাথে কতটুকু সংগতিপূর্ণ তা ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। শহীদ মিনার কেন্দ্রিক অনুষ্ঠানের অনেক কিছুরই মিল আছে হিন্দুদের পূজা-পার্বণের সাথে। কয়েকটি উদাহরণ: ▪এক. হিন্দু দেবদেবীর প্রতিমাকে যে উঁচু স্থানে স্থাপন করা হয় সে স্থানকে বলা হয় বেদী, শহিদ মিনারের পদ মূলকেও বলা হয় বেদী। বেদী শব্দটির অর্থ হিন্দুদের যগ্য বা পূজার জন্য প্রস্তুত উচ্চভূমি। (বাংলা একাডেমি) ▪দুই. প্রতিমা বা মূর্তির বেদীমূলকে পবিত্র মনে করা হয়, তাই সেখানে যেতে হয় নগ্নপদে । শহীদ মিনারের মূল কেউ পবিত্র মনে করার কারণেই সেখানে নগ্নপদে যেতে হয়। ▪তিন. লক্ষ্মীপূজার সময় আলপনা আঁকা হয়। শহীদ মিনারের পদমূলে যাবার পথেও আলপনা আঁকা হয়। আলপনা অর্থ ‘মেঝে, দেয়াল, সিঁড়ি প্রবৃত্তিতে অঙ্কিত হিন্দুদের মঙ্গলসূচক চিত্র বিশেষ’ (সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি) ▪চার. হিন্দু দেব-দেবীর পূজার সময় কয়েকটি বিষয় অপরিহার্য। এগুলো হলো লগ্ন, অর্ঘ্য বা নৈবেদ্য, স্তব বা বস্তুতি, পুরোহিত, দেবতা ও অর্চনা। এসবের সাথেও একুশে ফেব্রুয়ারির আচার-আচরণের সাদৃশ্য আছে। যেমন- অনুষ্ঠান জিরো আওয়ারে শুরু করা (লগ্ন), অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কৃষি (পুরোহিত), নির্দিষ্টভাবে আমার ভাইয়ের রঙে রাঙানো গান গেয়ে কাজ করা (স্তব/বস্তুতি), শহীদ মিনার (জড়পদার্থ)কে নিরবে শ্রদ্ধা জানানো (অর্চনা)। ▪পাঁচ. দুর্গাপূজার সময় দেখা যায়, দুর্গার মূর্তির পাশে রয়েছে আরও চারটি (দুর্গার পুত্র গণেশ ও কার্তিক এবং কন্যা সরস্বতী ও লক্ষীর) মূর্তি। এভাবে সব মিলে মূর্তির সংখ্যা হয়েছে পাঁচ। শহীদ মিনারগুলোর সংখ্যা পাঁচ। মিনারের সংখ্যা পাঁচ হওয়ার কারণ কি? ভাষা শহিদের সংখ্যা কি পাঁচ ছিল? আবার মধ্যবর্তী মিনারটির আকার অন্যদের তুলনায় বড় কেন? এ প্রশ্নগুলোর জবাব পাওয়া দরকার। মুসলিম সমাজে রীতি আছে, মৃত বা শহীদ মুসলিমদের মাগফেরাতের জন্য দুয়ার অনুষ্ঠান করা। কিন্তু ভাষা শহীদদের জন্য তাও করা হয় না; যা করা হয় তার সাথে ইসলামের রীতির মিল নেই। হিন্দুরা প্রতিমা পূজার পক্ষে এ যুক্তি পেশ করেন যে, দেবতা পূজারীদের নাগালের ভেতর নেই, তাই তার প্রতিমার মাধ্যমে তাকে পূজা দেওয়া হয়। শহীদ মিনারের বেলায়ও এ বিশ্বাস করা হয় যে, শহীদ মিনারকে সম্মান দেখানো ভাষা শহীদদেরকে শ্রদ্ধা করার সমতুল্য। শহীদ মিনার কেন্দ্রিক আচার অনুষ্ঠানকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখার দরকার আছে। ভাষা শহীদরা সবাই ছিলেন মুসলিম। কাজেই তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে আমরা এমন কিছু করতে পারি না যা ইসলামী চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। তা ছাড়া কোন মুসলিমই তাওহীদ বিরোধী কোন কাজ করতে পারে না। (সংগৃহীত)