প্রথম পাতা
শিক্ষাবিদরা বলছেন অধঃপতনের লক্ষণ
শিক্ষক লাঞ্ছনায় প্রতিবাদের ঝড়
স্টাফ রিপোর্টার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
২৯ জুন ২০২২, বুধবারআশুলিয়ায় শিক্ষার্থীর প্রহারে শিক্ষক নিহত ও নড়াইলে শিক্ষককে জুতার মালা পরানোর ঘটনার প্রতিবাদে ঝড় বইছে সারা দেশে। ক্ষুব্ধ শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। শিক্ষাবিদরা বলছেন এমন ঘটনা দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে অধঃপতনেরই ইঙ্গিতবহ। আশুলিয়ায় বখাটে এক শিক্ষার্থীর মারধরের শিকার আহত শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার সোমবার সকালে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এর আগে গত শনিবার দুপুরে নিহত শিক্ষকের কর্মস্থল আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকার হাজী ইউনুস আলী কলেজে প্রকাশ্যে ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে ও খুঁচিয়ে গুরুতর আহত করে ওই প্রতিষ্ঠানেরই দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম জিতু। ৩৫ বছর বয়সী এই শিক্ষক আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজ শাখার রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক এবং অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি ছিলেন। এক ছাত্রী জিতুর বিরুদ্ধে ইভটিজিংয়ের অভিযোগ দিয়েছিলেন নিহত শিক্ষক উৎপলের কাছে।
এ নিয়ে ওই ছাত্রকে শাসানোই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য। এদিকে নড়াইল জেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজে শিক্ষককে জুতার মালা পরানোর মতো নিকৃষ্ট ঘটনা ঘটেছে। ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি’র সাময়িক বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর শর্মার ছবি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নড়াইল সদরের এক কলেজছাত্র। পরদিন ১৮ই জুন কলেজে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
কিশোররা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, গ্যাং তৈরি করছে এগুলো খুবই খারাপ লক্ষণ। আমরা অন্ধকারের দিকে যাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সমাজে একটা অবক্ষয় এসে গেছে। এটা শাস্তি দিয়ে দূর করা যাবে না। গোটা ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে হবে। তরুণদের সাংস্কৃতিক কাজের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। এখন কোনো সংস্কৃতির চর্চা নাই। নাটক, গান, বাজনা, বিতর্ক নাই, খেলাধুলা নাই। যার ফলে কিশোররা বীরত্ব প্রকাশের জন্য গ্যাং সৃষ্টি করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, আমরা কখনও ভাবিনি একজন শিক্ষার্থী শিক্ষককে আক্রমণ করবে। একজন শিক্ষক শৃঙ্খলা নিশ্চিতের দায়িত্বে। কিন্তু তার নিরাপত্তার জায়গাটা কেন অনিশ্চিত ছিল? প্রত্যাশা থাকবে দোষীদের দ্রুত শাস্তি দেয়া। আর কলেজ শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরিয়ে কক্ষ থেকে বের করে দেয়া হলো। এটা অত্যন্ত বেদনার জায়গা।
আমার মনে হয়, বড় একটা ঘাটতি তৈরি হচ্ছে সমাজের। আমরা শিক্ষার্থীদের জিপিএ-৫ তৈরিতে মনোযোগ দিচ্ছি কিন্তু মানবিক মানুষ তৈরিতে কোনো নজর দিচ্ছি না। তিনি আরও বলেন, মানবিক গুণ তৈরি করা এটা কারিকুলামের মাঝেও নাই। শিক্ষকরা সেইভাবে পালন করছি না। পরীক্ষায় ভালো ফলফলটাই আমরা সফলতা হিসেবে ধরে নিচ্ছি। মানুষ হবার শিক্ষার ঘাটতি থেকেই যায়। বুয়েটের আবরারের মতো শিক্ষার্থীকে হত্যার শিকার হতে হয়। আবার আশুলিয়াতে শিক্ষককে খুন হতে হয়। এগুলো শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। যারা শিক্ষার নীতি নির্ধারণীতে সংশ্লিষ্ট আছেন তাদের উচিত হবে, প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় সত্যিকারের মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেয়া উচিত। জিপিএ-৫ ধারী শিক্ষার্থী তৈরি না করে মানুষ তৈরি করার শিক্ষা নিয়ে বেশি ভাবা প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের শিক্ষক, সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, শিক্ষককে অপমান, নিপীড়ন বা নির্যাতন করা এসব সংস্কৃতি যে তৈরি হলো এটি খুব ভয়ঙ্কর একটা তথ্য দিচ্ছে।
যারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তৈরি করবেন তারা যদি অপমানিত হন, অপদস্ত হন তখন আসলে ভরসার জায়গাটা কমে যায়। একটি দেশ আইনি প্রক্রিয়া বা কাঠামো থাকে। যেটা দিয়ে দেশ চলবে। কিন্তু কিছু অলিখিত আইন থাকে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম শিক্ষকদের নীতি, আদর্শের বক্তব্য, সামাজিক মূল্যবোধ, সম্প্রতি, ভাবনা এগুলো আইনের থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু আমাদের দেশে একটি গোষ্ঠী কোনোভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছে, বখে যাওয়া শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হচ্ছে। এগুলোর মধ্য দিয়ে আমরা একটা অস্থির অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমরা যদি এখুনি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি তাহলে আরও বেড়ে যাবে। এই দুই ঘটনার প্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ’র ব্যানারে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে ক্যাম্পাসে। এতে জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ মিহির লাল সাহা বলেন, অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের পরিবারের ইতিহাস দেখতে হবে। পরিবার তাদের শিক্ষাদানে ব্যর্থ। ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের জুতার মালা পরিয়ে শিক্ষকের সামনে দাঁড় করাতে হবে। এটি হলে বিচারের প্রথম কাজ এগোবে।
আজ লজ্জায় মুখ ঢাকতে হচ্ছে যে আমি একজন শিক্ষক। এ সময় শিক্ষার্থীরা বলেন, শিক্ষার্থীরা কোন পর্যায়ে পৌঁছালে শিক্ষককে অপমান করতে পারে। নড়াইলে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও সাভারে শিক্ষক হত্যার ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক বিচার হওয়া উচিত। জাতি গড়ার কারিগর শিক্ষককে আজ জুতার মালা পরানো হচ্ছে, হত্যা করা হচ্ছে। এসব ঘটনায় জাতির বিবেক কলুষিত, হতভম্ব ও বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী উৎপল কুমার সরকারের হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাদদেশে। মানববন্ধনে বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ও নিহত শিক্ষকের সহপাঠী ফণী ভূষণ বিশ্বাস বলেন, হামলাকারী ছাত্রের বিরুদ্ধে উত্ত্যক্তের অভিযোগ দিয়েছিল এক ছাত্রী। হামলাকারী ছাত্র বিদ্যালয়ের সভাপতির আত্মীয়। এই হত্যায় জড়িত সবাইকেই শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান। বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নাসির উদ্দিন বলেন, আজকে ২০২২ সালে আমরা সভ্যতার এমন একপর্যায়ে দাঁড়িয়েছি, যেখানে একজন ছাত্র তার শিক্ষককে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। আর আমাদের সেই ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে হচ্ছে। এই ঘটনাকে কোনো সাধারণ অপরাধ হিসেবে দেখলে চলবে না। সভ্যতার উন্নয়নের নিচে আমরা যে অন্ধকার লালন করি, এই ঘটনা তার প্রমাণ। মঙ্গলবার হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে বিক্ষোভ করেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা।
এ সময় তারা ‘আমরা ন্যায়বিচার চাই’, ‘শিক্ষক হত্যার বিচার চাই’। এই বিক্ষোভ সমাবেশে ছয়টি দাবি জানানো হয়। এগুলো হলো- মামলার প্রধান আসামিকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার, অজ্ঞাতনামা আসামিদের গ্রেপ্তার, প্রধান আসামি ওই ছাত্রের পলাতক পরিবারের সদস্যদের আইনের আওতায় আনা, নিহত শিক্ষকের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ, স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্থানীয় ও বাইরের শিক্ষার্থীদের মধ্যকার ভেদাভেদ দূর করতে আইন প্রণয়ন এবং কিশোর গ্যাং ও কিশোর অপরাধ দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এদিকে নড়াইলে মির্জাপুর ইউনাইডেট ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে লাঞ্ছিত ও অপমান করার জন্য নিন্দা জানিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের পরিচালক মো. আতাউর রহমান মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানান। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৬শে জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২৮তম সিন্ডিকেট সভায় স্বপন কুমার বিশ্বাসকে লাঞ্ছিত করার ঘটনা আলোচনা হয় এবং নিন্দা প্রকাশ করা হয়। সিন্ডিকেট সভায় সভাপতিত্ব করেন ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মো. মশিউর রহমান।
ভাইস চ্যান্সেলরের নির্দেশক্রমে ঘটনাটি সরজমিনে তথ্যানুসন্ধান করার জন্য ৩ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কেউ দোষী চিহ্নিত হলে তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে। শাহবাগে সমাবেশ: নড়াইলে অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস ও সাভারে শিক্ষক হত্যার প্রতিবাদে রাজধানীর শাহাবাগে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ডাকে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল বিকাল পাঁচটায় জোটের ব্যানারে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত হয়ে প্রখ্যাত অভিনেতা ও নাট্য ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, সারা বাংলাদেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজ খারাপ শিক্ষকদের নৈরাজ্য চলছে। সব ধরনের অনিয়মে তারা মূল ভূমিকা পালন করলেও তাদের কোনো ধরনের অসুবিধা হয় না। কিন্তু যে শিক্ষকরা নীতি, শৃঙ্খলা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্যে থাকতে চান তাদেরই করুণ দশা হয়। যেমনটি হয়েছে হৃদয় মণ্ডলের, নড়াইলের অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের এবং সাভারে যে শিক্ষক প্রাণ দিলেন সেই শিক্ষকের।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ প্রতিবাদ সভায় বক্তৃতাকালে বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে কলেজের এক ছাত্রের দেয়া পোস্টকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনাকর পরিস্থিতি প্রশমন- এ লক্ষ্যে অরুণ কুমার বিশ্বাস পুলিশে খবর দিয়েছিলেন। এই ছিল তার অপরাধ। তিনি আরও বলেন, পরবর্তীকালে আমরা আরও জেনেছি এই ন্যক্কারজনক ঘটনার পেছনে মাদ্রাসাছাত্র ও বহিরাগতদের পাশাপাশি যারা এই অধ্যক্ষকে অপসারণ করতে চান তাদেরও একটা ইন্ধন ছিল। ভিডিওতে আমরা দেখেছি পুলিশের সামনে এই অধ্যক্ষকে জুতোর মালা পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলেও তারা ছিল সম্পূর্ণ নির্বিকার। বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে সারা দেশে যে ঐক্যের ও আনন্দের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল ঠিক তখনই এই ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদগুলো আমাদের বেদনাহত করেছে। পুলিশের সামনেই মাথা নত করে জুতোর মালা গলায় সে কলেজ শিক্ষক পুলিশের গাড়িতে ওঠে। এরপর আমাদের সামনে আসলো আশুলিয়ার নির্মম ঘটনা।
এই ঘটনাগুলো পরিকল্পিত। তরুণ সমাজের মধ্যে উগ্র সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার বিস্তার আমাদের সমাজকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে নিচ্ছে। পরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস এসব ঘটনায় প্রশাসন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে উল্লেখ করে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করেন। আগামী ১১ই জুলাই সারা দেশে সব জেলা-উপজেলায় জোটের প্রতিবাদ সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি।