ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

সিলেটে ত্রাণের জন্য দীর্ঘ লাইন

ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে
২৭ জুন ২০২২, সোমবার
mzamin

কানাইঘাটে ত্রাণ নিতে মানুষের দীর্ঘ লাইন ছবি: মাহমুদ হোসেন

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে অভূতপূর্ব দৃশ্য। শ’য়ে শ’য়ে ত্রাণের ট্রাক ঢুকছে সিলেটে। এমন দৃশ্য গত  কয়েকদিন ধরে দেখছেন ওসমানীনগরের বেগমপুরের আতিক মিয়া। কিন্তু এই ট্রাকগুলো থেকে ত্রাণ আসে না তাদের কাছে। জানালেন- ‘ত্রাণের ট্রাক দেখছি। খাবার পাচ্ছি না। দল বেঁধে লোক যাচ্ছে ত্রাণ নিয়ে। কিন্তু আমরা ত্রাণ পাচ্ছি না।’ ওসমানীনগরের সাদিপুর ইউনিয়ন। এক পাশে নবীগঞ্জ। অন্যপাশে মৌলভীবাজার সদর ও জগন্নাথপুর।

বিজ্ঞাপন
বুক চিরে গেছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক। সড়কের দু’পাশই প্লাবিত। সাদিপুরকে বলা হয়; সিলেট জেলা পানি নিষ্কাশনের ‘বেসিন’। কালনীচর দিয়ে পানি নামে কুশিয়ারার। এ জন্য বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হয় ওই এলাকায়। এ ইউনিয়নের ওপর তাণ্ডবও চালায় কুশিয়ারা। বর্ষা মৌসুম হলেই ডুবে যায় এলাকা। এবারের বর্ষার ভয়াবহ বন্যায় ইউনিয়নের শতভাগ এলাকা তলিয়ে গেছে। এখনো মানুষজন বন্দি অনেক এলাকায়। যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন। প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষের এই ইউনিয়নে এখনো তেমন ভাবে পৌঁছাচ্ছে না ত্রাণ। এতে করে মানুষের মধ্যে হাহাকার বাড়ছে। ফার্মেসির মালিক প্রমেশ পাল জানিয়েছেন, ‘তাদের ইউনিয়নের দুর্গম এলাকাগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। পানিবন্দি মানুষ। অনেকেই খাবার পাচ্ছেন না। নৌকা সংকট রয়েছে। 

যারা রান্না করা খাবার নিয়ে আসছেন তারা বেশি দুর্গম স্থানে পৌঁছতে পারছেন না।’ তিনি জানান, ‘নৌকা নিয়ে বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছানো এখন বড় চ্যালেঞ্জ। রান্না করা খাবার নিয়ে অনেকেই আসছেন। এক বেলা খেলে অন্য বেলা উপোস থাকতে হয় লোকজনকে।’ সাদিপুর ও শেরপুরের কয়েকজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, কুশিয়ারা নদীর তীব্র স্রোতে এক রাতেই ভেসে যায় গ্রামের পর গ্রাম। মানুষ ঘুমে থাকতে থাকতেই পানিবন্দি হয়ে পড়েন। আর বের হতে পারেননি। কোথাও কোথাও এক সপ্তাহ ধরে মানুষ পানিবন্দি। অনেকেরই রান্নার জায়গা নেই। এ কারণে এখন শুকনো কিংবা রান্না করা খাবার তাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। সাদিপুর ইউনিয়ন আয়তন ও লোক সংখ্যার দিক থেকে অনেক বড় একটি ইউনিয়ন। ইউনিয়নের বরাদ্দ যা এসেছে তা দিয়ে স্বল্প সংখ্যক মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয়া সম্ভব হয়েছে। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সাহেদ আহমদ মুছার খোলা চিঠিই তার প্রমাণ।  খোলা চিঠিতে তিনি বলেন- ‘স্মরণকালের এই ভয়াবহ বন্যায় আপনাদের মতো আমিও বানভাসি। তথাপি আপনাদের ভালোবাসায় আপনাদের সেবক হয়ে যতটুকু পারছি পাশে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। 

সরকার, সমাজের বিত্তবান, প্রবাসী, আমার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ও স্বেচ্ছাসেবকদের সংগৃহীত ত্রাণ সমভাবে সকলের কাছে পৌঁছে দিতে আমার ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা আপনাদের অজানা থাকার কথা নয়। তারপরও কথা থেকে যায়। আমার ইউনিয়ন পরিষদের প্রায় ত্রিশ হাজারের উপর জনসংখ্যার জন্য এই ত্রাণ কি পর্যাপ্ত? মোটেও নয়। আমার পাশাপাশি যে দু’টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে, তাদের জনসংখ্যা ও সাদিপুর ইউনিয়নের জনসংখ্যায় রয়েছে বিস্তর ফারাক। এটা আপনাদের জানা তথ্য। কথা হচ্ছে আমরা কি জনসংখ্যা অনুযায়ী সরকারি সহায়তা পাচ্ছি? না।’ খোলা চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন- ‘সরকারি সহায়তার ক্ষেত্রে সম্ভবত আমাদের উপজেলার সকল ইউনিয়ন পরিষদে ত্রাণের সমবণ্টন হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সমপরিমাণ ত্রাণ দিয়ে সকলের চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। পাঁচ জনের খাবার দিয়ে আপনি ৭-৮ জনের খাবার চালিয়ে নিতে পারেন কিন্তু এর বেশি কি সম্ভব? আমি আপনাদের প্রতিনিধি হয়ে সরকারের কাছে আকুল আবেদন করছি, এই ভয়াবহ বিপদসংকুল বন্যা পরিস্থিতিতে অনুদানের সমবণ্টন না করে জনসংখ্যা অনুযায়ী ত্রাণ সহায়তা পাঠান। 

এতে জনদুর্ভোগ কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে।’ তিনি মানবজমিনকে জানিয়েছেন, তার ইউনিয়নে ১৪ টন চাল, ৪০০ শুকনো খাবার ও নগদ ৩২ হাজার টাকা বরাদ্দ এসেছে। কিন্তু ওই ত্রাণ তার ইউনিয়নের জন্য পর্যাপ্ত নয়। সাদিপুর ইউনিয়নের মতো অবস্থা পার্শ্ববর্তী পশ্চিম পৈলনপুর, বুরুঙ্গা ও গোয়ালাবাজার ইউনিয়নেরও। ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ পৌঁছাতে বেসরকারি উদ্যোগের কাছে হাত পাতছেন। জানাচ্ছেন আহ্বানও। বিশেষ করে প্রবাসীদের কাছে তারা আকুলতা জানাচ্ছেন। তবে এসব এলাকায় এখনো প্রবাসী উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ পুরোদমে শুরু হয়নি। দক্ষিণ সুরমার জালালপুর, সিলাম, তেতলী, দাউদপুর সহ কয়েকটি ইউনিয়নেও বেসরকারি পর্যাপ্ত ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না। দক্ষিণ সুরমা সিলাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহ ওলিউর রহমান জানিয়েছেন, ‘সরকারি ভাবে আসা ত্রাণ দিয়ে সবার চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না।  বেসরকারিভাবে ত্রাণ অনেকেই বিতরণ করেন। আমরা সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছি।

 তার এলাকায় এখনো বহু মানুষ ত্রাণ পায়নি।’ দক্ষিণ সুরমার ইউএনও নুসরাত লায়লা নীরা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘ইতিমধ্যে তার উপজেলায় ২৮ টন চাল বিতরণ হয়েছে। আরও ৬০ টন এসেছে। সেগুলো বিতরণ করা হচ্ছে।’ সিলেটের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে বালাগঞ্জ উপজেলার। এখনো সড়কে পানি। উপজেলার ৬টি ইউনিয়নই প্লাবিত। কুশিয়ারা তীরবর্তী এলাকার মানুষজন খাদ্য সংকটে রয়েছে। দুর্গম হওয়ার কারণে এসব এলাকায় এখনো তেমন ত্রাণ পৌঁছেনি। ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, জকিগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারেও রয়েছে ত্রাণ সংকট। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, বন্যার শুরুতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সুনামগঞ্জ ও সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ সহ কয়েকটি এলাকা। এ কারণে বাইরে থেকে আসা বেসরকারি ত্রাণ যাচ্ছে ওই এলাকাগুলোতে। সিলেটের কুশিয়ারা তীরের এলাকাগুলোতে তেমন ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না। সরকারি ত্রাণ সকলকে দেয়া সম্ভব নয়। এ জন্য বেসরকারি ত্রাণই এখন পানিবন্দি মানুষের ভরসা। এদিকে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়া সিলেটে ক্ষয়ক্ষতির শেষ নেই। ঘরবাড়ি, ফসল, প্রাণিসম্পদ সবক্ষেত্রেই হয়েছে ব্যাপক ক্ষতি। 

এবারের বন্যায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন সোয়া ৪ লাখ পরিবারের প্রায় ২২ লাখ মানুষ। রোববার সিলেট  জেলা প্রশাসন সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।  জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার আহসানুল আলম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সিলেট সিটি করপোরেশনের আংশিক এলাকা, জেলার ১৩টি উপজেলা ও ৫টি পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৯৯টি ইউনিয়নের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ৪ লাখ ১৬ হাজার ৮১৯টি পরিবারের ২১ লাখ ৮৭ হাজার ২৩২ জন সদস্য ক্ষতির মুখে পড়েছেন বন্যায়। তিনি জানান, ২২ হাজার ৪৫০টি ঘরবাড়ি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২৮ হাজার ৯৪৫ হেক্টর জমির ফসল পড়েছে ক্ষতির মুখে। বন্যাকবলিত এলাকার জন্য এখন অবধি দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ১৪১২ টন চাল, ১৩ হাজার ২১৮ প্যাকেট শুকনো খাবার এবং নগদ ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের গতকাল বিকালে সর্বশেষ তথ্য মতে- কানাইঘাট ও সিলেটে সুরমা, জকিগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার এক থেকে দেড় সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো। 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status