শেষের পাতা
দেশের অর্থনীতি জটিল থেকে জটিলতর অবস্থানে যাচ্ছে
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
৩১ ডিসেম্বর ২০২৩, রবিবারবেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ও নাগরিক প্ল্যাটফরমের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, দেশের অর্থনীতি জটিল থেকে জটিলতর অবস্থানে যাচ্ছে। এতে বিদেশের টাকা শোধ করতে পারছি না। আবার জ্বালানি নিয়ে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। মূল্যস্ফীতি আগামী দিনে কোথায় দাঁড়াবে বুঝে উঠতে পারছি না। এমন অবস্থায় কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র সেটা কীভাবে মোকাবিলা করবে, সেই উৎকণ্ঠা আমাদের সবার মধ্যে বিরাজ করছে।
গতকাল রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে নাগরিক প্ল্যাটফরম ফর এসডিজি বাংলাদেশ আয়োজিত ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও ন্যায্যতার লক্ষ্যে নাগরিক এজেন্ডা’ শীর্ষক তিন পর্বের ধারাবাহিক মিডিয়া ব্রিফিংয়ের শেষ পর্বে তিনি এসব কথা বলেন। ব্রিফিং-এ সুশাসন সম্পর্কিত ৩টি বিষয়ভিত্তিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।
অর্থনীতির জটিল সময়ে আটলান্টিকের ওপার থেকে কেউ এসে দেশের সবকিছু ঠিক করে দিয়ে যাবে; এমনটা ভেবে নিশ্চুপ থাকার সময় এটা নয় বলে মন্তব্য করে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমাদের এক তৃতীয়াংশই তরুণ, তারা যদি ভূমিকা না রাখে, তাহলে কেউ এসে পরিবর্তন করে দিয়ে যাবে না। তিনি বলেন, আমার দেশের সমস্যা আমাকেই সমাধান করতে হবে। অন্য কেউ এসে সমাধান করে যাবে, সেটার আশায় বসে থাকাও বোকামী।
তিনি বলেন, নির্বাচনী ইশতেহারে আগামী দিনে যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, তার কোনো পর্যালোচনাই এবার হলো না। যে কারণে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের কাছেই পৌঁছালো না। এটা গণতন্ত্রের বড় ধরনের শূন্যতা তৈরি হলো। একটি রাজনৈতিক শূন্যতার মাঝে নির্বাচনী ইশতেহার এসেছে। যা নিয়ে কারও আগ্রহ নেই। আগের ইশতেহার কেন্দ্র করে যে মূল্যায়ন করার কথা ছিল সেটা হয়নি। আগামীতে যে প্রতিশ্রুতি দিলেন, সেটাও মূল্যায়ন করা গেল না।
তিনি আরও বলেন, এ ধরনের নির্বাচন এর আগে ১৯৮৮, ১৯৯৬ সালে দেখেছি। নির্বাচন যদি বহু মানুষের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে এর ফলাফলও টিকিয়ে রাখা কঠিন। আগামী দিনে অর্থনীতি যেভাবে জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি আগামী দিনে কই গিয়ে দাঁড়াবে এই উৎকণ্ঠা সবার মাঝে।
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, নির্বাচন আসবে যাবে, কিন্তু যদি নির্বাচন মানুষের কল্যাণে না হয়- সে নির্বাচন জনগণের উপকারে আসবে না। এই মুহূর্তে দেশের অর্থনীতির অবস্থা যেখানে যাচ্ছে, সেখানে সামনের অর্থনীতি কীভাবে মোকাবিলা করবেন? আগামী দিনে প্রথাগত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যদি ভঙ্গ হয়, তবে সবাইকে ভুগতে হবে। ইতিহাসের কাছে নাগরিকদের দায় আরও বেড়ে গেল।
এই নির্বাচনকে ‘বিশেষ নির্বাচনী তৎপরতা’ উল্লেখ করে বলেন, এটাকে সাধারণভাবে আমরা নির্বাচন বলছি। কিন্তু আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আমি বলি এটি একটি বিশেষ নির্বাচনী তৎপরতা। এর ফলে ইতিহাসের কাছে নাগরিকদের দায় বেড়ে গেল। আগামী দিনে আমাদের ভূমিকা আরও বাড়বে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, প্রার্থীদের সম্পর্কে আমরা জানতে পারি হলফনামার মাধ্যমে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রার্থীরা যে হলফনামা জমা দিয়েছে, তাতে অনেককেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যেতে দেখা গেছে। সেখানে যে সম্পদের বিবরণ দেয়া হয়েছে এবং যে ট্যাক্সের বিবরণ দেয়া হয়েছে, সেগুলোর কখনো তুলনামূলক বিশ্লেষণ হয়? যদি তাই হয়, তাহলে অনেকেরই দেখেছি আয় ৫০০ গুণ পর্যন্ত বাড়লো, তাহলে তিনি কি সে হারে কর দিয়েছেন? এনবিআর কি কখনো সেই খোঁজ নিয়েছে?
তিনি বলেন, আইএমএফ বলছে আমাদের কর জিডিপি বাড়াতে হবে, আমি মনে করি এই হলফনামা আমাদের জন্য বড় একটি সুযোগ। এখন এনবিআর কি করে সেটাই দেখার বিষয়? তারা কি আগামী দিনে এ বিষয়গুলো নিয়ে বলবেন?
দেবপ্রিয় বলেন, আমরা দেখছি যে যতবার নির্বাচন করেছে, তার আয় গাণিতিকভাবে সে পরিমাণ বেড়ে গেছে। যে যতবার নির্বাচন করেছে, তার আয় ততবার বেড়েছে। তার মানে নির্বাচনে আসাই হলো আয় বাড়ানোর ভালো একটা রাস্তা। কিন্তু এভাবে তো আপনি পুরো রাষ্ট্রকে অধিকারহীন করে দিয়ে সংকীর্ণ একটি গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় সম্পদের মালিকানা করে দিচ্ছেন।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, আপনারা বুঝেন তাহলে কেন সবাই নির্বাচিত হতে চায়, পাগল হয়ে গেছে কেন। কারণ রাষ্ট্রীয় সম্পদের অধিকার পাওয়া নাগরিক অধিকারের চেয়ে তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে ঢুকতে পারলে অ্যাকসেস টু স্টেট রিসোর্সেস, এটাই সবচেয়ে ভালো রাস্তা।
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পাতানো এবং আত্মঘাতিমূলক প্রতিযোগিতার নির্বাচনের মাধ্যমে একচ্ছত্রবাদ পাকাপোক্ত করতে গিয়ে অগণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশের ঝুঁকি রয়েছে। তিনি বলেন, এই নির্বাচনে ভোটার অংশগ্রহণটাই বড় চ্যালেঞ্জ। অনেকেই ভোট দিতে যাবে না, তবে ভোটাররা ভোট দিতে না গেলেও হয়তো তাদের ক্ষমতাসীনদের নজরদারির মধ্যে পড়তে হবে। তবে সবকিছু আইনগতভাবেই হবে, এমনকি এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চ্যালেঞ্জও করা যাবে না। সর্বোপরি এই নির্বাচনের মাধ্যমে একটি দলের ক্ষমতাও পাকাপোক্ত হয়ে যাবে। তিনি বলেন, নির্বাচন পরবর্তী সময়ে দেশে অনেক কিছুই হবে। আমরা একটি আত্মঘাতী প্রতিযোগিতায় নামছি।
সিপিডি’র বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা এখন সমান্তরাল বাস্তবতায় অবস্থান করছি। আমাদের অনেক অর্জন আছে, তবে আমাদের সমাজে এখনো যথেষ্ট পরিমাণ বৈষম্য আছে। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বণ্টনের ক্ষেত্রে ন্যায্যতায় সমস্যা আছে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আলম, জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক এডভোকেট সালমা আলীসহ আরও অনেকে।
মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সভাপতিত্ব করেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। মিডিয়া ব্রিফিংয়ের তাৎপর্য উপস্থাপন করেন সিপিডি’র ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সিপিডি’র ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।