নির্বাচিত কলাম
আন্তর্জাতিক
রাজনীতিতে অবিশ্বাস, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দুবাইয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক
মোহাম্মদ আবুল হোসেন
১ আগস্ট ২০২৩, মঙ্গলবার
জাতীয় পরিষদে বিরোধীদলীয় নেতা রাজা রিয়াজ দৃশ্যত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের নাম বাছাইয়ে প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ ও তার মধ্যে একমতে পৌঁছার বিষয়ে আস্থা প্রকাশ করেছেন। আগামী ১২ই আগস্ট বর্তমান পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তার আগেই এ ইস্যুতে একমত হতে হবে রাজনীতিবিদদের। যদি ১২ই আগস্টের আগে পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করা হয় তাহলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সময় একটু বেশি পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। কিন্তু যদি পার্লামেন্টে মেয়াদ পূর্ণ হয় তাহলে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে বাধ্য
রাজনীতিতে একদল আরেক দলকে বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস না করার কারণও আছে। একদল মনে করে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে কারচুপি করে। কারণ, পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র, প্রশাসন থাকে তার হাতে। তাদেরকে ব্যবহার করে যা চাইবে, তাই করা সম্ভব ক্ষমতাসীনদের পক্ষে।
জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেয়ার পর নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভারপ্রাপ্ত সরকার প্রধান হচ্ছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী। এই সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা। সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি নাসিরুল মুলক। ২০১৮ সালের ৩১শে মে তিনি দায়িত্ব নেন। একই বছরের ১৮ই আগস্ট নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান শপথ নেয়ার পরই তিনি পদত্যাগ করেন। দেশটিতে জাতীয় পরিষদ নামে পার্লামেন্ট বিলুপ্তির পর নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একজন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান নিয়োগ করতে পারেন প্রেসিডেন্ট। এক্ষেত্রে পার্লামেন্টে মেয়াদ শেষে তা ভেঙে দিলে বা আগেভাগে ভেঙে দিলেও একই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান নিয়োগের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে শলাপরামর্শ করতে হয় প্রেসিডেন্টকে। তারাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের বিষয়ে একমত পোষণ করলে তাকে ওই পদে বসানো হয়। যদি প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা একমত না হন তাহলে প্রেসিডেন্ট তার ইচ্ছেমতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী বাছাই করতে পারেন। সেটা করতে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে পরামর্শ করতে হয়।
এ পর্যন্ত এ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন মোট ৭ ব্যক্তি। তাদের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন গোলাম মুস্তাফা জাতোই। তিনি ছিলেন পাকিস্তানি একজন রাজনীতিক। ১৯৯০ সালের ৬ই আগস্ট থেকে একই বছর ৬ই নভেম্বর পর্যন্ত তিন মাসের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সরদার মীর বালাখ শের মাজারি। তিনি ১৯৯৩ সালে ৫ সপ্তাহের জন্য এই দায়িত্ব পালন করেন। তিনিও ছিলেন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বেলুচিস্তান, সিন্ধু এবং পাঞ্জাব রাজ্যের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় একটি মাজারি গোষ্ঠীর নেতা বা সর্দার ছিলেন তিনি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মঈন উদ্দিন আহমেদ কুরেশি। তিনি ছিলেন একজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মার্কিন অর্থনীতিবিদ ও সরকারি কর্মচারী। ১৯৯৩ সালের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট পদেও দায়িত্ব পালন করেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন পাকিস্তানি আইনজীবী, বাম রাজনীতিক ও মার্কসবাদী দার্শনিক মালিক মেরাজ খালিদ। ১৯৯৬ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন খাঁটি একজন দার্শনিক। পাকিস্তান পিপলস পার্টির একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাকে দেখা হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন মুহাম্মদ মিয়া সোমরু। তিনি পাকিস্তানের একজন রাজনীতিক, ব্যাংকার ও সিনেটর। বর্তমানে তিনি কেন্দ্রীয় একজন মন্ত্রী। ২০০৮ সালের ১৮ই আগস্ট থেকে একই বছরের ৯ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তার প্রয়াত পিতা আহমেদ মিয়া সোমরু ছিলেন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ডেপুটি স্পিকার। সিনেট কমিটি সিস্টেম প্রতিষ্ঠায় তার সহায়ক ভূমিকা আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মীর হাজার খান খসরু। তিনি পাকিস্তানের একজন বিচারক। ২০১৩ সালের ২৫শে মার্চ থেকে ৫ই জুন পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। এর আগে তিনি ফেডারেল শরিয়া কোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন।
সপ্তম ও সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নাসিরুল মুলক। এর আগে তিনি পাকিস্তানের ২২তম প্রধান বিচারপতি ছিলেন। পেশাগত দিক দিয়ে ছিলেন বিচারক। তাকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করেছিলেন। ২০১৪ সালের ৬ই জুলাই তাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ নিশ্চিত করেন তখনকার প্রেসিডেন্ট মামনুন হোসেন। এর আগে ২০১৪ সালের ৩০শে নভেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ৬ই জুলাই পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। তাকে ২০১৮ সালের ২৮শে মে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় ক্ষমতাসীনরা জানেন নির্বাচন তাদের অধীনে নিরপেক্ষ হবে না। তাই তারা পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান নিয়োগ চূড়ান্ত করতে চাইছেন। এক্ষেত্রে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী পিএমএলএন এবং পিপিপি সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিষয়ে তালিকা সংক্ষিপ্ত করেছে। এতে আছে মোট চার থেকে পাঁচ জনের নাম। এ তথ্য জানিয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ। তবে তিনি সেইসব নাম প্রকাশ করতে অনীহা জানিয়েছেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেছেন, পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএলএন) এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বাছাই করা হবে একজন রাজনীতিককে। এ জন্য তারা বিভিন্ন নাম থেকে প্রার্থীদের একটি শর্টলিস্ট তৈরি করেছে। এতে আছে ৫টি নাম। তবে সেই তালিকায় কার কার নাম আছে তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন তিনি। খাজা আসিফ বলেছেন, পিপিপি এবং পিএমএলএন একসঙ্গে চার থেকে পাঁচটি নাম চূড়ান্ত করেছে। তা নিয়ে অন্য দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হবে। এরপর এক সপ্তাহের মধ্যে একটি নাম চূড়ান্ত করা হবে। মিত্র জোটকে এ বিষয়ে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। তিনি বলেন, আমার মতে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। আমি মনে করি বর্তমান পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার দু’দিন আগেই তা ভেঙে দেয়া উচিত। কারণ পার্লামেন্টকে শূন্য রাখলে তাতে আরও অনেক জটিলতা সৃষ্টি হবে।
জাতীয় পরিষদে বিরোধীদলীয় নেতা রাজা রিয়াজ দৃশ্যত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের নাম বাছাইয়ে প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ ও তার মধ্যে একমতে পৌঁছার বিষয়ে আস্থা প্রকাশ করেছেন। আগামী ১২ই আগস্ট বর্তমান পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তার আগেই এ ইস্যুতে একমত হতে হবে রাজনীতিবিদদের। যদি ১২ই আগস্টের আগে পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করা হয় তাহলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সময় একটু বেশি পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। কিন্তু যদি পার্লামেন্টে মেয়াদ পূর্ণ হয় তাহলে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে বাধ্য। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বা প্রার্থীদের বিষয়ে পিএমএলএন এবং পিপিপি’র মধ্যে আলোচনা হলেও বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা এখনও শুরু হয়নি। এ মাসের শুরুর দিকে বিরোধীদলীয় নেতা রাজা রিয়াজ বলেছেন, ১লা আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হওয়ার কথা। রোববার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টায় ডন নিউজ প্রোগ্রামে ‘দুসরা রুখ’ অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন রাজা রিয়াজ। তাতে তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের সঙ্গে কাজের খুবই সুন্দর সম্পর্ক আছে তার। তিনি যে নাম বলবেন, তাতেই তার সম্মতি থাকবে। তিনি আরও বলেছেন, এ বিষয়টি গোয়ার্তুমির নয়। প্রধানমন্ত্রীর বাছাইকে মেনে নেয়া উচিত। এক্ষেত্রে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অর্থমন্ত্রী ইসহাক দারের প্রার্থিতার বিরোধিতা করেছেন। একই সঙ্গে গত ৯ই মে ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর পাকিস্তানে সৃষ্ট নৈরাজ্যের পর তার দল পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফকে নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন রাজা রিয়াজ। এখানে উল্লেখ্য, পিটিআইয়ের টিকিটে নির্বাচিত রাজা রিয়াজ। কিন্তু তিনি এ দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। স্বীকার করেছেন আগামী নির্বাচন করবেন পিএমএলএনের টিকিটে। তার মতে, পাকিস্তানের যে ক্ষতি ভারত করতে পারেনি, তাই করেছে পিটিআই। সংবিধানের ৬ নম্বর অনুচ্ছেদের অধীনে দলের নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও দাবি জানিয়েছেন তিনি। সামরিক আদালতে বেসামরিক লোকজনের বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, এসব মানুষ কেন সেনাবাহিনীর চৌহদ্দিতে হামলা চালাতে গিয়েছিল?