নির্বাচিত কলাম
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
রাজার জন্মদিনের মতো হবে কি আওয়ামী লীগ, বিএনপি সংলাপ?
তারিক চয়ন
১৮ জুলাই ২০২৩, মঙ্গলবার
দুটি দলই বিভিন্ন সময়ে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ‘বিদেশি অশুভ শক্তি’র হস্তক্ষেপের কথা সরাসরি কিংবা ইনিয়েবিনিয়ে উচ্চারণ করেছে। কিন্তু, এক পক্ষ অন্য পক্ষের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা এমনকি মুখ দেখাদেখিও বন্ধ করে দিলে বিদেশি শক্তিকে সংলাপের জন্য ভাড়া করে হলেও যে আনতে হয়, সেটাই তো বাস্তবতা। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সরকারি দল যেহেতু নিয়মিতভাবে ‘বিদেশি অশুভ শক্তির হস্তক্ষেপের’ বিপরীতে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সবাইকে সতর্ক করছে সেজন্য এবং ‘সরকারি দল’ হিসেবে তাদেরই দেশের বৃহত্তর স্বার্থে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সহ সব পক্ষের সঙ্গে সংলাপ আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া উচিত। সরকারি দলের বক্তব্য অনুযায়ী সংলাপ আয়োজন এবং সংলাপে বিরোধী পক্ষকে রাজি করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দায় তো তাদের উপরই বর্তায়
বৃটেনের নতুন রাজা তৃতীয় চার্লসের অফিসিয়াল জন্মদিন এবং তিনি ও তার স্ত্রী রানী ক্যামিলার রাজ্যাভিষেক উদ্যাপনে ঢাকাস্থ বৃটিশ হাইকমিশন গত ২১শে জুন রাতে রাজধানী ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলে জাঁকজমকপূর্ণ এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আমন্ত্রিত অতিথিদের অভ্যর্থনা থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানের একেবারে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়েই ছিল রাজকীয় ছাপ। এর মাত্র দু’সপ্তাহ আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের নতুন হাইকমিশনার সারাহ কুক বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির নিকট পরিচয়পত্র পেশ করেন বলে অনুষ্ঠানে তার সরব উপস্থিতি নতুন এক মাত্রা যোগ করে।
দরজায় ঢুকতেই অতিথিদের স্বাগত জানান লাল জামা আর ইয়া বড় কালো টুপি পরিহিত বৃটেনের বিখ্যাত কোল্ড স্ট্রিম গার্ডের সদস্যরা। হরেক রকমের বিলেতি ও বনেদি খাবারের পাশাপাশি পাঁচ তারকা হোটেলের বলরুমের পাশে রাখা গরম গরম ঢাকাইয়া কাচ্চি বিরিয়ানির ইয়া বড় ডেগ দেখে সব অতিথিরা যেমন বিস্মিত হয়েছেন, তেমনি কাচ্চিপ্রিয় বহু বাঙালি একাই অনেক প্লেট কাচ্চি সাবাড় করে অন্যদের সেই স্বাদ নেয়া থেকে বঞ্চিত করেছেন।
ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিক, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক জগতের তারকা, ব্যবসায়ী, নানা শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধি থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানে যোগ দেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। তিনি ছাড়াও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান এমপি, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, নাহিম রাজ্জাক এমপি সহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যকে অনুষ্ঠানে দেখা গেছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নুরের পাশাপাশি আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।

বিএনপি নেতারা যখন অনুষ্ঠানের মূল মঞ্চের ঠিক সামনে নিজেদের মাঝে আলাপচারিতায় ব্যস্ত তখন ঠিক পাশেই উপস্থিত হন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা ফারুক খান। এক পর্যায়ে মির্জা আব্বাস এবং ফারুক খান একে অপরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে খোশগল্পে মেতে উঠেন। বিষয়টিকে কেন্দ্র করে চারপাশে এক উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এর কিছুক্ষণ আগেই বৃটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক তার বক্তব্যে বলেছিলেন, আজকের এই জন্মদিন উদ্যাপন বৃটেনের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিরই প্রতিফলন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার আহ্বানও জানান বৃটিশ দূত।
বলাবাহুল্য, শুধু বৃটিশ দূতই নন, বন্ধুদেশগুলোর ঢাকায় নিযুক্ত সব রাষ্ট্রদূত এবং কূটনীতিকরাই আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু এবং বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার জন্য অনবরত আহ্বান জানাচ্ছেন। আর সেজন্য তারা সরকারি দল এবং বিরোধী দলগুলোর মাঝে আলোচনা বা সংলাপের তাগিদও দিয়ে যাচ্ছেন। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য সোচ্চার পশ্চিমা দেশগুলো বারবারই বলছে, তোমরা একত্রে বসে নিজেদের সমস্যা নিজেরাই ঠিক করো। ঢাকা ত্যাগের আগে সদ্য বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়াও বলেছেন, ‘আমি সহিংসতা প্রত্যাখ্যান করে সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক, শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও ন্যায্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করতে সব পক্ষকে আহ্বান জানাই।’ তিনি এটাও বলেছেন, ‘আসুন, আমরা বাংলাদেশের জনগণকে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ করে দিই।’ অবশ্য, শুধু বিদেশি বন্ধুরা কেন, বাংলাদেশের রাজনীতিকরা নিজেদের সমস্যা নিজেরা মিলে ঠিক করতে পারলে দেশবিরোধী শক্তি ছাড়া কারোই তো অখুশি হওয়ার কথা নয়।
নিজেদের সমস্যা নিজেরা ঠিক করতে চাইলে যে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করা কিংবা ‘সংলাপ’-এর প্রয়োজন সেটা বাস্তবতা। কিন্তু, অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে সংলাপ শব্দটির প্রতি এদেশের অনেকেরই বিরক্তির কারণ রয়েছে। নিকট অতীতে দেশের দুই বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে দেশি-বিদেশি যে উদ্যোগেই হোক না কেন, কোনো সংলাপেই অর্থবহ কোনো ফল পাওয়া যায় নি। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র নেতাকর্মীদের মধ্যেই মূলত সংলাপ নিয়ে নেতিবাচক ভাবনা কাজ করে বেশি। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের ঠিক আগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ- তারানকো দুই দলের একেবারে জ্যেষ্ঠ এবং বর্ষীয়ান নেতাদের নিয়ে এক টেবিলে বসেছিলেন। পাঁচদিনের সফরে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সংসদের তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করলেও কোনো ফল আসে নি। বিএনপি ওই নির্বাচন বয়কট করলে সরকারি তরফে ‘সাংবিধানিক ধারা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য নির্বাচন করে কিছুদিন পর আরেকটি নির্বাচন দেবো’- এ ধরনের কথা বললেও পরবর্তীতে সরকার আর কোনো নির্বাচন তো দেয়ইনি, উল্টো সরকারি তরফে বলা হতে থাকে যে, ‘বিএনপি নির্বাচনী ট্রেন মিস করেছে, একবার ট্রেন চলে গেলে আর তাকে ধরা যায় না’। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি’র সংলাপও কাজে আসেনি। শুধু বিএনপিই নয়, স্বয়ং কামাল হোসেনও অনেকবার বলেছেন, উক্ত সংলাপে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয় নি। ফলে, খুব স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি যদি বিশ্বাস করে ‘আওয়ামী লীগ কথা দিয়ে কথা রাখে না’, তাহলে দলটি কেন সংলাপে বসতে চাইবে সে প্রশ্ন করা অবান্তর।
আশার বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি নেতারা মাঝেমাঝে দুই পক্ষের মাঝে সংলাপের বিষয়টি একেবারে উড়িয়ে দিলেও প্রায়ই তারা সংলাপের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে তাকে স্বাগত জানান। তবে, নির্বাচনের আগে সুনির্দিষ্ট ইস্যুতে অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে সংলাপে সব সময়ই রাজি- বিএনপি এমনটি অনেকবার জানালেও ইস্যুবিহীন কোনো সংলাপে যেতে রাজি নয় দলটি। তাছাড়া, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেই এ বিষয়ে সংলাপের উদ্যোগ নিতে হবে বলেও দলটির দাবি। অন্যদিকে, সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা না করার বিষয়ে অনড় আওয়ামী লীগ। মূলত, এ কারণেই থমকে আছে সংলাপ। আর এভাবেই, সংলাপ না করার বিষয়ে গোঁ-ধরে বসে আছে দুই দল।
দুটি দলই বিভিন্ন সময়ে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ‘বিদেশি অশুভ শক্তি’র হস্তক্ষেপের কথা সরাসরি কিংবা ইনিয়েবিনিয়ে উচ্চারণ করেছে। কিন্তু, এক পক্ষ অন্য পক্ষের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা এমনকি মুখ দেখাদেখিও বন্ধ করে দিলে বিদেশি শক্তিকে সংলাপের জন্য ভাড়া করে হলেও যে আনতে হয়, সেটাই তো বাস্তবতা। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সরকারি দল যেহেতু নিয়মিতভাবে ‘বিদেশি অশুভ শক্তির হস্তক্ষেপের’ বিপরীতে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সবাইকে সতর্ক করছে সেজন্য এবং ‘সরকারি দল’ হিসেবে তাদেরই দেশের বৃহত্তর স্বার্থে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সহ সব পক্ষের সঙ্গে সংলাপ আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া উচিত। সরকারি দলের বক্তব্য অনুযায়ী সংলাপ আয়োজন এবং সংলাপে বিরোধী পক্ষকে রাজি করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দায় তো তাদের উপরই বর্তায়।
বৃটিশ রাজার জন্মদিনে বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস এবং আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক খান যেভাবে খোশগল্পে মেতে উঠেছিলেন কিংবা প্রভাবশালী দেশগুলোর রাষ্ট্রদূত, মন্ত্রী, এমপিদের সঙ্গে দুই দলের শীর্ষ নেতারা যেভাবে হাসিমুখে আলোচনা করেন, সেভাবে নিজেরা খোলামনে আলোচনা করলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়!
পাঠকের মতামত
৩ মেয়াদে চক্রান্ত, বিনা ভোট ও রাতের ভোটে নির্বাচন করে জনগণ, বিরোধী দল ও ভিন্ন মতাদর্শের নাগরিকদের চরম নির্যাতন করে এখন এত কি সংলাপের দরকার হলো। পূর্ববৎ চালিয়ে যেতে সমস্যা কোথায়। সংবিধান অনুসারে নির্বাচন করুক। ১৫ বছর সবাইকে পেঁদানি দিয়ে এখন সংলাপের ওকালতি করা রহস্যময় বটে।
তারিক চয়ন সাহেব সংলাপের খোয়াব দেখেছেন। এত সংলাপের কি দরকার, আবার কোন একটা তরিকায় নিজেদের কব্জায় নির্বাচন একটা করতে পারলেই হয়ে যাবে!
সংলাপ দিয়ে যদি রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করা যেত তাহলে রাজা বাদশারা ক্ষমতা বা রাজসিংহাসনের ছেড়ে পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে যেত না ? অথবা রাজা বাদশারা জেল হাজতে বসে নির্ধারিত খাবার খেতে না। রাজনীতি এমন একটা ব্যাপার যেখানে চুল ছেরাছেরি ছাড়া ক্ষমতা থেকে নামার উপায় নেই। সংলাপ দিয়ে অনেক সময় স্ত্রী, ছেলেমেয়ের মনও পাওয়া যায় না, সেখানে দুই বুবু ?
দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রত্যশা করা দিবা স্বপ্ন। সংবিধান জনগনের কল্যানের জন্য প্রনয়ন করা হয়। যে সংবিধান জনগনের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয় তা জনগনের জন্য নয়।
দুর্দান্ত একটি কলাম।
সংলাপ আসলে কি নিয়ে হবে এটাই আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে পরিস্কার নয়। আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে, বিএনপি বলছে এই সরকার কে এখনই পদত্যাগ করতে হবে এবং তত্তাবধায়ক সরকার এর অধীনে নির্বাচন হতে হবে। এখন আমাদের মত সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, এই মুহূর্তে যদি সরকার কে পদত্যাগ করতে হয় তবে তত্তাবধায়ক সরকার কে আনবে? আবার আওয়ামী লীগের মত প্রধান রাজনৈতিক শক্তি তত্তাবধায়ক সরকার এর পক্ষে নয়। তাহলে সংলাপ এর আগের ইতিহাসের মতই অমিমাংসিতই রয়ে যাবে। আবার এদিকে আরেক সমস্যা আছে, বিএনপি সংলাপের পক্ষে নয়। কারন এই তত্তাবধায়ক সরকার কে বার বার প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিতর্কিত করেছে বিএনপিই। সংলাপে বসলে এই কথাগুলো উঠবে এবং নিশ্চিত ভাবে বিএনপি অপ্রস্তুত হবে। এই ভয়ে তারা সংলাপে যেতে রাজি নয়।