শরীর ও মন
শিরদাঁড়ার বক্রতা (Kyphosis)
ডা. মো. বখতিয়ার
৫ জুন ২০২২, রবিবারকাইফোসিস হলো মেরুদণ্ডের রেখার একটি অস্বাভাবিকতা যেটি অস্বাভাবিকভাবে বাঁকায়। সাধারণত প্রত্যেকের শরীরেই প্রায় ২৫ থেকে ৪৫ ডিগ্রি ব্যাপ্তিতে একটি বাঁকা মেরুদণ্ড থাকে। কিন্তু কাইফোসিস আক্রান্তদের কারও কারও মেরুদণ্ডের বক্রতা ৫০ ডিগ্রি বা তারও বেশি পৌঁছতে পারে। এই অবস্থা হলে অনেক সময় আক্রান্ত ব্যক্তিটির মাথা নত রাখতে হয়। দেখা যায় বক্রতা বা কাইফোসিসজনিত কিছু সমস্যা হলেও অনেকের আবার চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। তবে, গুরুতর ক্ষেত্রে এই বক্রতা ব্যথা ও শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা তৈরি করতে পারে। এসময় চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচার পদ্ধতির মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ করে থাকেন।
লক্ষণসমূহ
- ডান এবং বাম কাঁধের উচ্চতায় পার্থক্য।
- স্ক্যাপুলার উচ্চতা বা অবস্থানের পার্থক্য (কাঁধের ফলক)
- মাথা শরীরের অন্যান্য অংশের চেয়ে বেশি এগিয়ে বা সামনে দেখায়।
- নিচে বাঁকানোর সময় উপরের পিঠ অস্বাভাবিকভাবে উঁচু দেখায়।
- হ্যামস্ট্রিংয়ের পেশি (উরুর পেছনের পেশি) টান অনুভব করে।
- তবে হালকা অবস্থায় কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।
কারণসমূহ:
১. পোস্টারাল কাইফোসিস
পোস্টারাল কাইফোসিস বৃদ্ধির সময় দেখা যায়। এটি ৫০ ডিগ্রি বা তারও বেশি বর্ধিত হয়। পোস্টারাল কাইফোসিসে স্লুচিং বেশ নমনীয় এবং রুটিন ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে সংশোধন করা যায়। এই কাইফোসিস হলে ব্যথা তেমন অনুভূত হয় না।
২. স্কিউম্যানের কাইফোসিস
এটির কারণে মেরুদণ্ড অস্বাভাবিক বিকাশ হয়। মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়। সাধারণত এর বক্রতা শক্ত হয় এবং বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আরও খারাপ হয়, যার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে অক্ষম করে তোলে।
৩. জন্মগত কাইফোসিস
গর্ভাশয়ে থাকা অবস্থায় মেরুদণ্ডের অস্বাভাবিক বিকাশের কারণে এই ধরনের কাইফোসিস হয়। জন্মগত কাইফোসিসের সঠিক কারণ কী তা এখনও জানা যায়নি।
ঝুঁকির কারণসমূহ
২. অস্টিওজেনেসিস অপূর্ণতা বা ভঙ্গুর হাড়ের রোগ ৩. স্কোলিওসিস (মেরুদণ্ডকে প্রভাবিত করে) হলো মেরুদণ্ডের এমন একটি অবস্থা যা “এস” অক্ষরের এর মতো বাঁকানো।
৪. স্পিনা বিফিদা-
মেরুদণ্ড এবং মেরুদণ্ডের অসম্পূর্ণ গঠনের কারণে স্পিনা বিফিদা একটি জন্মগত ত্রুটি।
৫. পেজেটের রোগজনিত কারণে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াটিকে প্রভাবিত করে এমন একটি ব্যাধি যা হাড়ের ভঙ্গুরতা বৃদ্ধি করে।
৬. Neurofibromatosis একটি জিনগত রোগ যা স্নায়ুতন্ত্রের টিউমার গঠনের সূত্রপাত করে।
৭. যক্ষ্মা (টিবি): এই রোগটি একটি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণে ঘটে যা প্রায়শই ফুসফুসকে আক্রমণ করে। তবে কিছু ক্ষেত্রে, যক্ষ্মা মেরুদণ্ডকেও প্রভাবিত করতে পারে।
৮. পেশিবহুল ডিসস্ট্রফি: পেশিবহুল ডিসস্ট্রফি জেনেটিক কারণগুলোর দ্বারা সৃষ্ট একটি রোগ। যার কারণে পেশি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যায়।
৯. কম্প্রেশন ফ্র্যাকচার: চাপের কারণে সংকোচনের ফ্র্যাকচার বা মেরুদণ্ডের ফ্র্যাকচারগুলো মেরুদণ্ডের বক্রতা প্রভাবিত করতে পারে।
১০. মেরুদণ্ডের ক্যান্সার বা ক্যান্সারের বিস্তার পাশাপাশি কেমোথেরাপি এবং রেডিওথেরাপি মেরুদণ্ডকে দুর্বল এবং ফ্র্যাকচারের জন্য ঝুঁঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে।
১১. হাড়ের ঘনত্ব হ্রাস হওয়া মেরুদণ্ডকে বাঁকাতে পারে।
১২. মেরুদণ্ডের জয়েন্ট প্যাডগুলোর ক্ষয়।
১৩. মেরুদণ্ডের জখম।
এ ছাড়া আরও কিছু অজানা কারণ রয়েছে।
নির্ণয় /পরীক্ষাসমূহ:
ইমেজিং পরীক্ষা: এক্স-রে বক্রতার ডিগ্রি দেখাতে পারে এবং মেরুদণ্ডের বিকৃতি শনাক্ত করতে পারে। আবার চিকিৎসক প্রয়োজন মনে করলে সিটি স্ক্যান করাতে পারেন, টিউমার মনে হলে এমআরআই করাতে পারেন।
হাড়ের ঘনত্ব পরীক্ষা: হাড়ের ঘনত্বের মাত্রা দেখতে এই পরীক্ষা করা হয়।
রক্ত পরীক্ষা: যক্ষ্মার মতো সংক্রমণের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি পরীক্ষা করার জন্য রক্তের নমুনা পরীক্ষা করা হয়।
চিকিৎসা: বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটি ভুল দেহভঙ্গির কারণে হয়। এই ধরনের রোগীদের কেবল ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে তাদের দেহভঙ্গি উন্নত করা হয়।
কাইপোসিসের চিকিৎসার যে ধরনের ওষুধ ব্যবহৃত হয় তা হলো ব্যথা উপশমকারী যেমন প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন, পাশাপাশি অস্টিওপরোসিসের ওষুধ। স্কিউম্যানের কাইফোসিস আক্রান্ত বাচ্চাদের মধ্যে সতর্কতা জরুরি। যাতে মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে না যায়। এ ধরনের রোগে চিকিৎসকরা হাড়ের ঘনত্ব বজায় রাখতে সহায়তা করার জন্য রোগীদের প্রায়শই ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ, মদ্যপান না করা এবং ধূমপান এড়াতে বলেন।
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষকএবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা বদরুদজোদা মডার্ন হাসপাতাল, সফিপুর, কালিয়াকৈর, গাজীপুর।