ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

ভিসা স্যাংশন নীতি

কতোটা পাল্টাবে পরিস্থিতি

শুভ কিবরিয়া
২৬ মে ২০২৩, শুক্রবার
mzamin

বিরোধীরা বিশেষ করে বিএনপি’র জন্য এটা একটা উভয়মুখী চ্যালেঞ্জ। সহিংসতা অথবা চাপিয়ে দেয়া সহিংসতার অভিযোগ বিএনপি কতোটা মোকাবিলা করতে পারবে? সামনের দিনের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করবে, সেই সক্ষমতাকে তারা বাস্তবে কতোটা কাজে লাগাতে পারবে, সেটা একটা বড় বিষয়। তবে, মার্কিন এই নীতি ঘোষণা তাদের কর্মীদের যে মনোবল বাড়াবে তাতে কোনো ভুল নেই। আওয়ামী লীগ-বিএনপি বাদ দিয়ে আমরা আমজনতার দৃষ্টিতে এখন বাংলাদেশকে দেখি। তাহলে দেখবো স্বাধীনতার ৫২ বছর পর একটা স্বাধীন দেশের নিয়তি হচ্ছে, আমেরিকার ভিসা-স্যাংশন নীতি অর্জন। দেশের সম্পদ-সার্বভৌমত্ব এখন আমেরিকার ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপরে অনেকটাই জিম্মি। ক্ষমতার পুরুষ্টু উপরিকাঠামো নিজের ও নিজের পরিবারের ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশকে বেচে দিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পর তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের সচিব, তার মাঠপ্রান্তের তরুণ সহকর্মীদের একটা ধন্যবাদপত্র পাঠিয়েছিলেন নিজের স্বাক্ষরে। সেই নির্বাচন কেমন হয়েছিল, তা এখনো মানুষের স্মৃতিতে আছে। তবে নির্বাচন কমিশনের সচিব ভদ্রলোক খুব খুশি, উৎফুল্ল ছিলেন তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে। তার প্রভাব ছিল এই চিঠিতে।

বিজ্ঞাপন
ভদ্রলোক সিনিয়র সচিব হিসেবে রিটায়ার্ড করেছেন। সরকারের আনুকূল্যে কাজ করার প্রাইজ হিসাবে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য পদেও বসেছেন। প্রশাসনে যেসব জুনিয়র কর্মকর্তা এই নির্বাচনের সঙ্গে নানাভাবে জড়িত ছিলেন বিশেষত ডিসি, ইউএনও, এসি ল্যান্ড-তাদের অনেকেই নির্বাচন কমিশনের সচিবের এই থ্যাঙ্কস লেটার নিয়ে চুপচাপ থাকলেও কেউ কেউ ছিলেন খুবই প্রচারমুখীন। আমাদের পরিচিত এক ছোট ভাই, ভালো অফিসার, কিন্তু এই চিঠি পাবার পর, তার ছোটবেলার রাজনীতির জিগির চাগা দিয়ে উঠলো ভীষণ। তিনি যে নির্বাচন কমিশনের সচিবের দলীয় আনুগত্যের পথের মানুষ সেটা জানান দিতে, ফেসবুকে তার আইডিতে সেই চিঠিকে ‘গৌরবের স্মারক’ হিসাবে টানিয়ে রেখেছিলেন বহুদিন। এই ছোট ভাই’র সঙ্গে দেখা নাই অনেককাল। তার খবরও রাখি না। ভেবেছিলাম চাকরিতে তার আয় উন্নতি হয়েছে নিশ্চয়। কিন্তু ক’দিন আগে খবর পেলাম ভদ্রলোকের পরের প্রমোশনটা ঠিকমতো হয় নাই। তার ব্যাচের অনেকের প্রমোশন হলেও তিনি প্রমোশন পান নাই। খবরটা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কেননা একজন জুনিয়র অফিসার, সামনে তার বিস্তর পথ বাকি। অথচ প্রথম জীবনেই হোঁচট খেয়ে গেল, দলীয় ক্যাডার হিসেবে গভীরতর আত্মপ্রকাশের পরও! আজ হঠাৎ সেই পরিচিত ছোটভাই’র মুখটা ভেসে উঠলো, আমেরিকার সাম্প্রতিক নতুন বাংলাদেশের মানুষের ভিসা নীতি ঘোষণার আওয়াজ শুনে। 

অনেকগুলো বিষয় একসঙ্গে ঘটলো। 
এক. আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন এই নয়া ঘোষিত বাংলাদেশের জন্য ‘বিশেষ ভিসা নীতি’ টুইট করেন। অর্থাৎ তিনি নিজেই সোশ্যাল মিডিয়ায় দুনিয়াজোড়া জানালেন।
দুই. পরে এ বিষয়ে তার বিস্তারিত বিবৃতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। 
তিন. তারপরে আমেরিকান ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেটের স্পোক্সম্যান বা মুখপাত্র ম্যাথু মিলার নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে ‘অ্যানাউন্সমেন্ট অফ ভিসা পলিসি টু প্রমোট ডেমোক্রেটিক ইলেকশনস ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি চালুর বিষয়টি তুলে ধরেন। এ বিষয়ে তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। 

চার. তারপরই বাংলাদেশের চ্যানেল আই’র তৃতীয়মাত্রায় বিশেষ অতিথি হিসেবে এসে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু সেই ভিসা নীতি বিষয়ে সাক্ষাৎকার দিলেন। এই বিষয়গুলো কোনোটাই কাকতালীয় নয়। খুবই যোগসূত্র মূলক এবং পূর্বপরিকল্পিতও বটে। এবং এ ঘটনাও জানানো হয় যে, মে মাসের ৩ তারিখে এটা সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে। সরকারের যে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ গত ক’দিন ধরে, তাতে বোঝা যাচ্ছিল কোথাও তাল-লয় সুর কেটেছে। এটা এখন পরিষ্কার , আমেরিকার ভিসা-নীতি নিয়ে অবহিত সরকার, তার দল-কর্মীবাহিনী এবং দলঅনুগত সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে সাহসহারা করতে চায় নাই। কিন্তু মার্কিন পক্ষে এই প্রবলতর কায়দায় ভিসা-নীতি ঘোষণা ও ভিসা স্যাংশন বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতি জানিয়ে দেয়ার ফলে দল অনুগত বাহিনীর সাহস কি আগের মতোই থাকবে? মাঠপ্রান্তে দলের লোকজনের মনোবল কি আগের মতোই চাঙ্গা থাকবে? সেই আলোচনায় যাবার আগে আমরা এই ভিসা স্যাংশন বিষয়ে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গির নীতিগত দিকটা বোঝার চেষ্টা করি।

কেনো এই স্যাংশন?
আমেরিকার ভাষ্য হচ্ছে, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নতুন এই ভিসা নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। নতুন নীতির আওতায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের আমেরিকায় যাবার ভিসা দেবে না তারা।
কারা এই স্যাংশনের আওতায় পড়বে?

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত থাকছে। এমনকি, ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, জনগণকে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার চর্চাকে সহিংসতার মাধ্যমে বাধাদান যারা করবে তারা এর আওতায় আসবে। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, ভোটার, নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখতে বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার পদক্ষেপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ অভিযুক্ত হওয়ার পরিসর প্রায় অসীম। ব্যাপারটা অনেকটা আমাদের দেশে নানা মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করার মতো ব্যাপার। যখন যাকে দরকার হবে নানা অজুহাতে তাকে এর আওতায় এনে ফেলা যাবে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে আমেরিকার ভিসা না পেলে কী হবে? এর দুটো দিক আছে। প্রথমত, আজ অবধি আমেরিকাই একমাত্র দেশ যেখানে সবাই যেতে চায়, থাকতে চায়। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, নিরাপত্তা বিবেচনায় এখনো সেটাই সেরা দেশ। সেটা আমাদের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে ডান-বাম নেতানেত্রী, সামরিক-বেসামরিক-বিচারিক আমলাতন্ত্রের পরিবারের কারা কারা আমেরিকায় থাকেন তাদের একটা তালিকা করলেই বোঝা যাবে। দ্বিতীয়ত, সকল প্রকারের ক্ষমতাবানদের অনেকেরই নানাভাবে অর্জিত সম্পত্তি আমেরিকায় আছে। এদের অনেকেরই পরের জেনারেশন ওখানেই থাকতে চায়। ফলে সাধারণ মানুষের জন্য না হলেও, ক্ষমতাবানদের জন্য আমেরিকার ভিসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার ভিসা স্যাংকশনের নামে ওখানে রাখা সম্পত্তির ওপর স্যাংশন নাজির হলে অনেকেরই পরের জেনারেশন হাপিত্যেশ করে যাবে। এ ছাড়াও ভিসা নীতির কারণে বিপদে পড়তে পারে আমাদের মেধাবী শিক্ষার্থীরা, শিক্ষকরা, গবেষকরা, এনজিওবিদরা, সুশীল সমাজের অংশীজনরা, সামরিক-বেসামরিক এলিটরা, ব্যবসায়ীরা, রাজনীতিবিদরা। সুতরাং ভিসার ব্যাপারে আমেরিকা কট্টর হলে গজব নেমে আসবে পাওয়ারফুলদের জীবনে।

সরকার কী করবে?

সরকারের জন্য দুরকম পথ খোলা আছে। প্রথমত, মার্কিন এই অধিপত্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পপুলিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলা। সম্ভবত সেই পজিশনে সরকার আর নাই। দীর্ঘদিনের ক্ষমতার অনেক নোংরা পলি জনগণের মন বিষিয়ে দিয়েছে। বাজারে গেলে তা বোঝা যায়। চাল-আটা-সব্জি-পিয়াজসহ সকল খাদ্যপণ্যের দাম সরকার জনমুখী রাখতে পারে নাই। সুশাসন-ন্যায়বিচার-সুনীতির প্রেক্ষিতে জনমনের হিসাব বাদই দিলাম। সরকারের জনভিত্তি ঠিক কতোটা জনপ্রিয় সেটা পুলিশ-প্রশাসনের ঘেরাটোপে বোঝা কঠিন। তাই আমেরিকাবিরোধী কোনো আন্দোলন লিড করলে সরকার তাদের কতোটা পাশে পাবে সে হিসাবে সন্দেহ আছে।

দ্বিতীয়ত, সরকার এটাকে সুযোগ হিসাবেও নিতে পারে। এই স্যাংশনকে উপলক্ষ্য করে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে একটা নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করে তার মাধ্যমে জনরায় মেনে নিয়ে পরের ধাপে যাত্রা করা। অনেকে সেটাকে সেফ এক্সিটও বলতে চান। কিন্তু সন্দেহ হয়, যে সিস্টেম সরকার তৈরি করে রেখেছে, সেই সিস্টেমের সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষমতা আর আছে কিনা? চাইলেও এই মেশিনারি দিয়ে সরকার একটা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে কিনা?

তৃতীয়ত, বিরোধীরা বিশেষ করে বিএনপি’র জন্য এটা একটা উভয়মুখী চ্যালেঞ্জ। সহিংসতা অথবা চাপিয়ে দেয়া সহিংসতার অভিযোগ বিএনপি কতোটা মোকাবিলা করতে পারবে? সামনের দিনের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করবে, সেই সক্ষমতাকে তারা বাস্তবে কতোটা কাজে লাগাতে পারবে, সেটা একটা বড় বিষয়। তবে, মার্কিন এই নীতি ঘোষণা তাদের কর্মীদের যে মনোবল বাড়াবে তাতে কোনো ভুল নেই। আওয়ামী লীগ-বিএনপি বাদ দিয়ে আমরা আমজনতার দৃষ্টিতে এখন বাংলাদেশকে দেখি। তাহলে দেখবো স্বাধীনতার ৫২ বছর পর একটা স্বাধীন দেশের নিয়তি হচ্ছে, আমেরিকার ভিসা-স্যাংশন নীতি অর্জন। দেশের সম্পদ-সার্বভৌমত্ব এখন আমেরিকার ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপরে অনেকটাই জিম্মি। ক্ষমতার পুরুষ্টু উপরিকাঠামো নিজের ও নিজের পরিবারের ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশকে বেচে দিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আমাদের রাজনীতি, রাজনীতিবিদরা নিজেরাই এতটা দুষ্টুক্ষত অর্জন করেছে যে, এই রাষ্ট্রনৈতিক বিপদের দিনে জনগণকে পাশে পাবে না। কেননা, জনগণের কথা তারা ভাবে নাই। ভেবেছে যেনতেন প্রকারে ক্ষমতাকে আঁকড়ে থাকার কথা। এক অর্থে বাংলাদেশের এখন গভীর অসুখ। আমেরিকান এই অজুহাত আমাদের বড় বিপদের কারণ হয়ে যেতে পারে। লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানের কথা ভুললে চলবে না। তাই দেশকে বাঁচাতে সকলকে সাবধান হতে হবে। এই স্যাংশন যদি আমাদের সতর্ক না করে, তাহলে আরও অনেকরকম বহুমাত্রিক আন্তঃরাষ্ট্রীয় স্বার্থের প্রতিযোগিতার বলি হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশ। কাজেই সাধু সাবধান!! নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার ধনুপণ এখন ছাড়তে হবে ক্ষমতাবানদেরই।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংবাদিক।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status