ঈদ আনন্দ ২০২৩
আমার ছোটবেলার ঈদ
মাহবুবা চৌধুরী
(১১ মাস আগে) ২২ এপ্রিল ২০২৩, শনিবার, ৮:৪৮ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৩:৪৫ অপরাহ্ন
শবেবরাতের পর থেকেই আমাদের বাড়িতে শুরু হয়ে যেত ঈদের প্রস্তুতি। বাড়িঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা, ঘষামাজা, নতুন আসবাবপত্র কেনা- সবই চলতো সমান তালে। আমাদের বাড়িটা ছিল বিরাট বড়। সাত কামরার বাড়ি, মাঝখানে বিরাট একটা উঠোন.…
ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে আমি
সেই কবেকার কথা। এখনো স্মৃতিগুলো চোখের সামনে জ্বল জ্বল করছে। আমি বেড়ে উঠেছি পুরান ঢাকার আরমানীটোলায়। মায়ের কাছে শুনেছি আমার জন্ম পুরান ঢাকার ইসলামপুরের ডাক্তার আলতাফন্নেসার হাতে। আব্বার প্রেস এবং পাবলিকেশন্স ব্যবসা ছিল। সচ্ছল পরিবারেই বেড়ে ওঠেছি, কখনো অভাব দেখিনি। সাত বোন আর তিন ভাইয়ের মধ্যে আমার অবস্থান ঠিক মাঝখানে।
আমার আব্বা কে, এম, সেরাজুল হক
আমাদের গ্রামের বাড়ি শাইনপুকুর, ঢাকা জেলারই অন্তর্ভুক্ত। ঢাকা থেকে খুব দূরে নয়। তখনকার দিনে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব একটা উন্নত ছিল না। লঞ্চ, স্টিমার কিংবা নৌকাই ছিল একমাত্র ভরসা। সকালে রওয়ানা দিলে বাড়ি যেতে রাত হয়ে যেতো। তাই গ্রামের বাড়িতে খুব কমই যাওয়া হতো। মাঝে মাঝে আব্বা আর চাচা যেতেন, সঙ্গে বড় ভাইরা।
পুরান ঢাকার বাসিন্দারা ভীষণ উৎসবপ্রিয়। বিশেষ করে ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো তারা বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে পালন করতেন। ছোটবেলায় দেখেছি শবেবরাত এলেই চারদিকে পরে যেতো সাজ সাজ রব। পাড়া প্রতিবেশী আর আত্মীয়স্বজনের বাড়ি থেকে আসতো খঞ্চা ভরে নানা পদের হালুয়া আর বাহারি রুটি। রুটিগুলো হতো নানা রকম আর নানা আকৃতির। কোনটা মাছের, কোনটা পাতার আবার কোনটা কুমিরের আকৃতির রুটি। সেই রুটির উপর বসানো থাকতো আয়না পুতির মালা আরও কতো কি। মা’ও তৈরি করতেন অনেক রকম হালুয়া রুটি। খঞ্চা ভরে পাঠাতেন পাড়া প্রতিবেশী আর আপন জনের বাড়িতে। শবেবরাতে আব্বা কিনে দিতেন নতুন জামা। সেই জামা পরে বাড়ির সবার সঙ্গে রাত জেগে ইবাদত বন্দেগী করার মধ্যে ছিল এক অনাবিল আনন্দ।
শবেবরাতের পর থেকেই আমাদের বাড়িতে শুরু হয়ে যেত ঈদের প্রস্তুতি। বাড়িঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা, ঘষামাজা, নতুন আসবাবপত্র কেনা- সবই চলতো সমান তালে। আমাদের বাড়িটা ছিল বিরাট বড়। সাত কামরার বাড়ি, মাঝখানে বিরাট একটা উঠোন। এটাকে উঠোন না বলে ছোটখাটো একটা মাঠ বলাই ভালো। উঠোনের এক পাশে ছিল ফুলের বাগান আর এক পাশে খোলা জায়গা। বিকাল হলেই সঙ্গী সাথীদের নিয়ে গোল্লাছুট, কুমির ডাঙ্গা বা রুমাল চোর খেলায় মেতে উঠতাম। মাঝে মাঝে ভাইদের সঙ্গে ক্রিকেট ফুটবলও খেলতাম। ছোট ছিলাম বলে আমাকে খেলায় নিতে চাইতো না, ফিস ফিস করে বলতো ও দুধভাত- তখন এ কথাটার অর্থ বুঝতাম না, বড় হওয়ার পর যখন কথাটার অর্থ বুঝেছি তখন মনে মনে একাই হেসেছি।
রোজার প্রতিটি দিনই ছিল ভীষণ আনন্দের। বাড়ির সবাই মিলে এক সঙ্গে সেহরি আর ইফতার করার মধ্যে ছিল এক অনাবিল আনন্দ। সেহরির জন্য মা তৈরি করতেন নানা পদের মুখরোচক তরকারি। সেগুলো এতই লোভনীয় হতো যে পেটে ক্ষুধা না থাকলেও খেতে ইচ্ছে করতো। সেহরির পর সবাই মিলে গল্প করতে করতে প্রতিদিনই ভোর হয়ে যেতো। উঠোনে ছিল বেশ বড় একটা শিউলী গাছ। ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথার মধ্যে ছিল আলাদা এক আনন্দ। ইফতারে মা নানা পদের খাবার তৈরি করতেন; তারপরও আব্বা বাইরে থেকে কিনে আনতেন নানা ধরনের ইফতার। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি ছিল বলে আমাদের খাবার টেবিলটাও ছিল অনেক বড়। ইফতার দিয়ে পুরো টেবিলটা না ভরলে আব্বা তৃপ্তি পেতেন না। আসলে আব্বা ছিলেন ভীষণ ভোজন রসিক মানুষ। আমাদের বাড়িতে কখনো বাজারের ব্যাগে বাজার আসতো না। টুকরি ভরে মিনতির মাথায় বাজার আসতো প্রতিদিন। একবার আমাদের এক আত্মীয় আব্বার বাজার দেখে প্রশ্ন করেছিলেন এটা কি পুরো সপ্তাহের বাজার? উত্তরে মা যখন বললেন এটা একদিনের বাজার; জবাব শুনে ভদ্র মহিলা তো একেবারে থ’। বললেন একদিনে এত কিছু খাবেন? আমরা হলে তো এ বাজার এক সপ্তাহ খেতাম।
ছোটবেলায় ঈদের দিনে আমরা
রোজা শুরু হলেই আমরা ছোটরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম ঈদের কেনাকাটার জন্য। আব্বা যেদিন বলতেন আজ তোমাদের ঈদের শপিং-এ নিয়ে যাবো তখন সে কি আনন্দ। আব্বা আমাদের নিউ মার্কেটে নিয়ে যেতেন। তখন প্রতি ঈদেই কোনো না কোনো নতুন কাপড় বাজারে আসতো। কখনো ব্রকেড, ক্যারোলিন, নেট, শামুজ কিংবা লাখো মে এক। আমরা ঘুরে ঘুরে কাপড় পছন্দ করতাম। কেনা হয়ে গেলে নিউ মার্কেটের মাস্টার টেইলারে বানাতে দিয়ে আসতাম। আরেকদিন যেতাম জুতো কিনতে। জামা-জুতো খুব যত্ন করে আলমারিতে তুলে রাখতাম। আমরা ছোটরা সেহরিতে উঠে জামা-জুতো বের করে দেখতাম। বিছানার ওপর জুতো পরে হাঁটতাম, তারপর আবার বাক্সে রেখে দিতাম। জুতো পায়ে কখনো মাটিতে হাঁটতাম না, যদি ধুলো লেগে পুরনো হয়ে যায়। ঈদে আমরা দুটো জামা পেতাম একটা দামি আর একটা সাধারণ।
স্বামী এবং একমাত্র ছেলের সঙ্গে
বড় দু’বোনের অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। বড় দুলাভাই ইন্ডাস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। পোস্টিং ছিল কুমিল্লায়। মেজ দুলাভাই ছিলেন ব্যাংকার, পোস্টিং ছিল ফেনীতে। দু’ বোনই রোজার ঈদ করতো বাবার বাড়িতে আর কোরবানি ঈদ শ্বশুরবাড়িতে। ঈদের ছুটির সঙ্গে মিলিয়ে ছুটি নিয়ে দিন দশেক ঢাকায় বেড়িয়ে যেতেন। বড় দু’বোনের উপস্থিতি ঈদকে অনেক বেশি রঙিন করে তুলতো। ঈদের পর দুলাভাইদের সঙ্গে সিনেমা দেখা, বেবি আইসক্রিম খাওয়া, রমনা পার্কে ঘুরে বেড়ানোর মজাই ছিল আলাদা। একবার ঈদে মেজ দুলাভাই জানালেন এবারের ঈদে ঢাকায় আসা হবে না- কারণ ট্রেনের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের সবার সে কি মন খারাপ। ঈদের আনন্দ যেন অনেকটাই ফিকে হয়ে গেল। শবেকদরে আব্বা বাজার থেকে মেহেদী নিয়ে এলেন। তখনকার দিনে টিউবে মেহেদী ছিল না। মেহেদী পাতা বেটে তারপর পরতে হতো। মেহেদী পরতে বসে আমাদের সে কি মন খারাপ- মেজ আপা আসছে না, ঈদটাই যেন ফিকে ফিকে লাগছে। ঈদের চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে লোকজন চারদিকে বোমাবাজি ফুটাতে লাগলো। আব্বা সাহায্যকারী ছেলেটিকে নিয়ে বাজারে ছুটলেন; আমিও আব্বার সঙ্গী হলাম। নয়াবাজারে বাজার করতেন আব্বা। বাসা থেকে বেশ কাছে হেঁটেই যাওয়া যায়। বাজারটা যেন আনন্দে ভাসছে। চারদিকে ঝলমলে আলো, সবার মুখেই হাসি। খাসি, গরু, মুরগি সব মাংসই কিনলেন আব্বা। বাজার আসতেই মা রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। আজ সারারাত রান্না করবেন, শেষ রাতের দিকে ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে ফজরের আজানের সময় উঠে পড়বেন। ফ্রিজে রান্না করে রেখে দেয়া খাবার আব্বা আম্মা মোটেও পছন্দ করতেন না। টাটকা রেঁধে টাটকা খেতে এবং খাওয়াতে পছন্দ করতেন। মা বার বার তাড়া দিচ্ছেন অনেক রাত হয়েছে এবার ঘুমিয়ে পড়ো। দেরি করে ঘুমালে ভোরে উঠতে দেরি হয়ে যাবে। ঈদের খুশিতে মোটেও ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না; তবুও মায়ের আদেশ, তাই বিছানায় যেতেই হলো। এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। রাত দুপুরে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। সদর দরজায় কারা যেন জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে; সেই সঙ্গে কড়াও নাড়ছে। ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলাম; কেমন যেন ভয় ভয় করছে। আব্বা আর বড় ভাইয়েরা দরজার ভেতর থেকে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করছে কে? কি চাই? হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ পেলাম। তারপর কথাবার্তা আর হাসির শব্দ ভেসে এলো। লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম, দেখলাম মেজ আপা আর দুলাভাই বাচ্চাদের নিয়ে ভেতরে ঢুকছে। নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। দুলাভাই অনেক চেষ্টা করে ট্রেনের টিকিট জোগাড় করে রাত দুটোয় শ্বশুরবাড়িতে এসেছেন সবার সঙ্গে ঈদ করতে। মেয়ে জামাইকে কাছে পেয়ে আব্বা-আম্মার মুখটা যেন আনন্দে ঝলমল করছে। ঈদের দিন খুব ভোরে উঠে পড়তাম। চারদিকে আবছা আলো, কনকনে শীত কোনো কিছুই দমিয়ে রাখতে পারতো না আমাদের। কোনোরকম গরম পানি ছাড়াই গোসলে ঢুকে যেতাম। ঈদের খুশিতে শীতকে শীত বলে মনে হতো না। কে কার আগে গোসল করবে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেতো। গোসল শেষ হলে বড় দুই বোন আমাদের সাজাতে বসে যেত। নতুন জামা জুতো পরিয়ে চুল বেঁধে মুখে ফেস পাউডার পরিয়ে দিতো। সাজা শেষ হলে বার বার নিজেকে আয়নায় দেখতাম।
বড়বেলায় ভাই-বোনদের সঙ্গে
বাড়ির সামনেই আরমানীটোলা মাঠ। বিরাট ঈদের জামাত হতো সেই মাঠে। আব্বা এবং ভাইদের সঙ্গে নামাজে যেতাম। ওরা নামাজ আদায় করতো আর আমরা ছোটরা দু’চোখ ভরে তাকিয়ে দেখতাম অপূর্ব সেই দৃশ্য। নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে দেখতাম আম্মা রান্নাবাড়া শেষ করে নতুন কাপড় পরে একেবারে তৈরি। হাসিমুখে সবাইকে আপ্যায়ন করছেন। আমাদের বাড়ির একটা রেওয়াজ ছিল ঈদের দিন যারাই বেড়াতে আসবেন নাস্তা নয়, তাদেরকে লাঞ্চ অথবা ডিনার করে যেতে হবে। বাসায় প্রচুর মেহমান আসতো ঈদের দিন। আত্মীয়স্বজন, আব্বার বন্ধু-বান্ধব, ভাইদের এবং আমাদের প্রচুর সহপাঠীর সমাগম ঘটতো আমাদের বাসায়। আমাদের একমাত্র চাচা আর ফুফু থাকতেন ফার্মগেটে। তারাও সকাল বেলায় চলে আসতেন আমাদের বাসায়। খাওয়া-দাওয়া, গল্প-গুজব আর হই-হুল্লোড়ে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে যেতো। বিকালে সবাই মিলে ফার্মগেটে চাচার বাসায় যেতাম। তেজকুনীপাড়ায় আব্বা এবং চাচার অনেকগুলো বাড়ি ছিল। এলাকাটার নাম ছিল রাহাত মঞ্জিল এরিয়া- আমার দাদার নামে। আমার দাদার নাম ছিল রাহাত উল্লাহ খান। চাচার বাসায় গেলেই আমার চাচাত বোন শোভা আপা আমাদের নিয়ে বেড়াতে বের হতেন। ভাড়াটিয়াদের আর শোভা আপার বান্ধবীদের বাসায়। বেড়াতে বেড়াতে সন্ধ্যা হয়ে যেতো। চাচার বাসায় খাওয়া-দাওয়া করে অনেক রাতে বাড়ি ফিরতাম। ঈদে বাড়তি আনন্দ ছিল ছবি তোলা। তখনকার দিনে ফিল্ম কিনে ক্যামেরায় ছবি তুলতে হতো। মেজ ভাইয়া তার হাত খরচের পয়সা থেকে ফিল্ম কিনে আনতেন। কখনোই আব্বার কাছ থেকে পয়সা নিতেন না। এটি ছিল তার কাছে মহা আনন্দের বিষয়।
একবার ঈদের মাসখানেক আগে আব্বা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। প্রচণ্ড জ্বর। কতো ডাক্তার, কতো ওষুধ কিছুতেই জ্বর কমছে না। ডাক্তার আসছে, ডাক্তার যাচ্ছে- নানা রকম টেস্ট দিচ্ছে। বার বার ওষুধ পাল্টে দিচ্ছে তবুও অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। বাড়ির প্রতিটা মানুষ গোপনে চোখের জল ফেলছে, অজানা এক আশঙ্কায় নিদ্রাহীন রাত কাটাচ্ছে। ধীরে ধীরে ঈদ ঘনিয়ে এলো- সেদিকে কারও খেয়াল নেই, মনের মধ্যে শুধু একটাই দুশ্চিন্তা আব্বা বাঁচবেন তো? আব্বার পরিচিত একজন ডাক্তার ছিলেন, ডাক্তার ওমর। হঠাৎ তার কথা মনে পড়লো। বড় ভাইয়া বললেন একবার ডাক্তার ওমরকে দেখালে কেমন হয়? ডাক্তারকে খবর দেয়া হলো। আব্বাকে দেখে নতুন কয়েকটা টেস্ট দিলেন। টেস্টের রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বললেন ম্যালেরিয়া। ওষুধ লিখে দিলেন। তিন দিনের মধ্যেই আব্বার অবস্থার উন্নতি হলো, ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন আব্বা। ঈদের আগেই আব্বা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেন। সেবারের ঈদটা ছিল অন্যান্য ঈদের চাইতে অনেক বেশি আনন্দের।
আমাদের ছোটবেলায় প্রতি ঈদেই কোনো না কোনো নতুন ফ্যাশন বের হতো। টেডি জামা, টেডি জুতো, বেলবটম প্যান্ট আরও কতো কী। আমি তখন ফ্রক পরি। ঈদের জামা কেনা হয়ে গেছে, মনে মনে ভীষণ ইচ্ছে, যদি একটা বেলবটম প্যান্ট বা পাজামা পেতাম। বড় ভাইয়ার সব কিছুতেই আগ্রহ। যদিও এ ব্যাপারে তার কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। বললেন, তোমার জন্য আমি তৈরি করবো বেলবটম পাজামা। বাড়িতে সেলাই মেশিন ছিল। বড় ভাইয়া বসে গেলেন বেলবটম পাজামা তৈরি করতে। বেলবটমের বৈশিষ্ট্য ছিল প্যান্ট বা পাজামার উপরের দিকটা চাপানো আর নিচের দিকটা ঢিলে ঢালা। বড় ভাইয়া আমার জন্য চটজলদি তৈরি করে ফেললেন বেলবটম পাজামা। বললেন, এই যে তোমার বেলবটম। এবার ঝটপট পরে ফেলো দেখি। আমি তো খুশিতে আটখানা। পরতে যেয়ে দেখি পাজামা যে কিছুতেই উপরে উঠছে না। অনেক টানাটানি করেও বেলবটম পরা গেল না। বড় ভাইয়া বললেন, কোনো অসুবিধা নেই; আমি দু’পাশে তালি দিয়ে দিচ্ছি তা হলে পরতে কোনো অসুবিধা হবে না। তালি দেয়া বেলবটম পরতেই ভাইবোনেরা সবাই মিলে মুখ টিপে হাসাহাসি করতে লাগলো। কি আর করা বেলবটমের পরিকল্পনা বাতিল করে সেবার ফ্রক পরেই ঈদ করতে হলো।
একাত্তরের পঁচিশে মার্চের পর আমরা সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। দীর্ঘ ন’মাস আমরা গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় ফিরে আসি। আমরা কল্পনাও করতে পারিনি আমাদের জন্য কতো বড় একটা দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। খবর এলো আব্বার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লুট হয়ে গেছে। প্রেস, বইপত্র কিছুই অবশিষ্ট নেই। আব্বা খুব চাপা স্বভাবের মানুষ ছিলেন। ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়লেও মুখে কখনো তা প্রকাশ করতেন না। ছোট হলেও বুঝতে পারতাম, আমরা একটা সমস্যার মধ্যদিয়ে যাচ্ছি। তখন আব্বার একমাত্র আয়ের উৎস ছিল বাড়ি ভাড়া। ঐ টাকা দিয়ে মোটামুটি হিসাব করেই চলতে হতো তখন। এরই মধ্যে রোজার ঈদ এসে গেল। আব্বা আমাদের নিউমার্কেটে নিয়ে গেলেন। এবারের ঈদে আমরা পেলাম একটা করে সুতির জামা। বড় দু’বোন যথারীতি ঈদ করতে এসেছে। ওদের কাছে পেয়ে আমরা ভীষণ খুশি। চাঁদ রাতে আব্বা বাজারে গেলেন। ঘণ্টাখানেক পর খালি হাতে ফিরে এলেন। ঘরে ঢুকেই ধপ করে বিছানার ওপর বসে পড়লেন। মা বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে- তোমার শরীর খারাপ লাগছে? আব্বা মাকে আশ্বস্ত করে বললেন, আমার কিছু হয়নি, আমি ঠিকই আছি। মা বললেন, কিছুতো একটা হয়েছে তা না হলে তুমি বাজার না করে ফিরে আসতে না। আব্বা বললেন, বাজার আমি ঠিকই করেছিলাম কিন্তু বাড়িতে আনতে পারিনি। আমি দশ সের খাসির মাংস, দশটা বড় মোরগ, সাত সের পোলাওর চাল, দুই সের ঘি, আর সেমাই কিনে মিনতির মাথায় রেখে গরম মসলা কিনছিলাম। কেনা শেষ করে পেছনে তাকিয়ে দেখি মিনতি নেই। ভাবলাম হয়তো আশপাশে কোথাও আছে কিন্তু সারা বাজার তন্ন তন্ন করেও লোকটাকে খুঁজে পেলাম না। সওদা নিয়ে মিনতি পালিয়েছে। মা বললেন, হিসাবের সংসারে এতো দেখছি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। আব্বা আবার বাজারে গেলেন এবং কিনে আনলেন ঈদের দিনের রান্নার সব উপকরণ। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালেন আব্বা। পুনরায় চালু করলেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সচ্ছলতা ফিরে এলো সংসারে। আমরা আবার ফিরে গেলাম সোনালী দিনের সোনালী ঈদে।