শেষের পাতা
শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে বিদায়
স্টাফ রিপোর্টার
২৯ মে ২০২২, রবিবারএকটি কফিনের অপেক্ষায় ছিল দেশের মানুষ। যার ভেতরে নিথর দেহে শুয়ে আছেন অমর একুশে গানের রচয়িতা, প্রবীণ সাংবাদিক, কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। চিরনিদ্রায় শায়িত হতে দেশে আসবেন তিনি। গতকাল বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে অপেক্ষার অবসান ঘটে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে আসা কফিনটি নামে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সেখান থেকে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মরদেহ নিয়ে আসা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে নেয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে। জানাজার নামাজের পর মরদেহটি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় প্রেস ক্লাবে। এরপর মিরপুর বুদ্ধিজীবি কবরস্থানে দাফন করা হয়। সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ১৯শে মে লন্ডনের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল বলেন, গাফ্ফার ভাইয়ের আজীবন স্বপ্ন ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। এটা এখন আমাদের দায়িত্ব। যদি আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে পারি তাহলে গাফ্ফার চৌধুরীর প্রতি প্রকৃত সম্মান জানানো হবে। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, বাংলাদেশ এখন সংকটের মধ্যে, সবচেয়ে বড় হুমকি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা। সেই জায়গাতে গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন সংস্কৃতি আন্দোলনের সবচেয়ে বড় মুখ। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেছেন, লালন করেছেন। তাই রাজনীতিতে হোক বা সংস্কৃতিতে হোক, কোথাও আমাদের সমালোচনা করার জায়গা থাকলে তিনি করতেন। কাজের মধ্য দিয়ে আমরা তার স্বপ্ন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করবো। এ সময় আরও শ্রদ্ধা জানান বিভিন্ন দপ্তরের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও বিশিষ্টজনেরা। এছাড়াও শ্রদ্ধা জানান আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী, সাংবাদিক নেতারা। শ্রদ্ধা জানান বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতনরা। এছাড়াও শ্রদ্ধা জানান সর্বস্তরের মানুষ।
গণস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য দল থেকে শ্রদ্ধা জানাতে না আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হুইল চেয়ারে এসে তিনি বলেন, তার জীবনের ৫০টি বছর কেটেছে বৃটিশ সরকারের পদানতায়। তিনি বৃটিশ ওয়েলফেয়ারের ভর্তুকিতে জীবন কাটিয়েছেন। এ লজ্জা আমার, আপনার সবার, এ লজ্জা জাতির। প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলের। আমি এখানে অনেক রাজনৈতিক দলকে দেখছি না। আমি দলমত নির্বিশেষে সবাইকে অনুরোধ করবো তাকে সম্মানের স্থানে রাখতে। মরার পরে ফেরেস্তা বানিয়ে লাভ নেই। আগে আমরা কি করেছি এটা ভাবতে হবে। তিনি সরকারের কাছে আবেদন করে বলেন, হুমায়ুন আহমেদকে আমরা স্মরণ করি। আমরা গাফ্ফার চৌধুরীকেও স্মরণ করতে চাই। গাফ্ফার চৌধুরীর নামে সাংবাদিক ফান্ড করুন। যাতে সাংবাদিকরা ভালোভাবে চলতে পারে। সাংবাদিকরা যাতে সাহস নিয়ে কথা বলতে পারে।
বিকাল ৩টার দিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় মসজিদে আনা হয়। সেখানে জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় অংশ নেন কয়েক হাজার মানুষ। জানাজা শেষে মরদেহবাহী গাড়ি যায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে। সেখানেও জানানো হয় শ্রদ্ধা। এরপর লাশবাহী গাড়ি ছুটে যায় মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরের উদ্দেশ্যে। বিকাল সাড়ে ৫টায় দাফন করা হয় তাকে। স্ত্রী সেলিমা আফরোজ চৌধুরীর কবরাস্থানের পাশে শেষ ঠাঁই হয় তার। মৃত্যুর পর ২০শে মে তার প্রথম জানাজা হয় ইংল্যান্ডের ব্রিকলেন মসজিদে। সেখানকার আলতাব আলী পার্কের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষ তার প্রতি শ্রদ্ধা জানান। বাঙালির অমর গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র রচয়িতা গাফ্ফার চৌধুরী একাত্তরের মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র ও সাপ্তাহিক জয়বাংলার নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন ২০০৯ সালে। এছাড়াও তার ঝুলিতে রয়েছে ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৭), একুশে পদক (১৯৮৩), বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, সংহতি আজীবন সম্মাননা পদক (২০০৮), মানিক মিয়া পদক (২০০৯), যুক্তরাজ্যের ফ্রিডম অব বারা (টাওয়ার হ্যামলেটস) উপাধি ইত্যাদি। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ১৯৩৪ সালের ১২ই ডিসেম্বর বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জের উলানিয়া গ্রামের চৌধুরী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা হাজি ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী ও মা মোসাম্মৎ জহুরা খাতুন। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে বিএ অনার্স পাস করেন। ১৯৫১ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’ প্রকাশ হলে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সেখানে অনুবাদকের কাজ নেন। এরপর তিনি বহু পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সপরিবারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা হয়ে কলকাতা পৌঁছান আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। সেখানে মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র সাপ্তাহিক জয়বাংলায় লেখালেখি করেন তিনি। এ সময় তিনি কলকাতায় দৈনিক আনন্দবাজার ও যুগান্তর পত্রিকায় কলামিস্ট হিসেবেও কাজ করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে তিনি দৈনিক জনপদ বের করেন। এরপর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলজিয়ার্সে ৭২ জাতি জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যান আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। দেশে ফেরার পর তার স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ হলে তাকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে কলকাতা নিয়ে যান। সেখানে সুস্থ না হওয়ায় তাকে নিয়ে ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডন যান। এরপরই তার প্রবাস জীবন শুরু হয়। তিনি পাঁচ সন্তানের জনক।