ঢাকা, ২৯ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সময় অসময়

নারী-পুরুষের অধিকারে মেধা কতোটা জরুরি?

রেজানুর রহমান
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, সোমবার
mzamin

সম্প্রতি একজন প্রবাসী লেখিকার একটি বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যৌন সম্পর্কের অন্ধকার জগৎ এই বইয়ের মূল বিষয়। তিনি কার কার সঙ্গে যৌন লীলা করেছেন সেসব কথাও ওই বইয়ে লেখা আছে। কী ভয়াবহ ব্যাপার! সাহিত্যে যৌনতারও সৌন্দর্য আছে। কিন্তু এ কেমন যৌন সৌন্দর্য? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বইটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। অনেকেই বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে কটু মন্তব্য করছেন আবার তারাই অনেকে মন্তব্য লিখেছেন বইটি পড়ে দেখতে হবে। তার মানে লেখিকার উদ্দেশ্য সফল। এ যদি হয় বাস্তবতা তাহলে তো কেউ আলো খুঁজবে না। অন্ধকার খুঁজবে। কারণ অন্ধকারের আলোচনা বেশি।


আমি মেয়ে তো কী হয়েছে? পুুরুষেরা যা করে আমারও তাই করার অধিকার আছে।

বিজ্ঞাপন
পুরুষেরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে প্যান্টের চেইন খুলে পেশাব করে, আমিও এভাবে পেশাব করবো। পুরুষেরা সিগারেট খায়, আমিও খাবো। পুরুষেরা মদ খায়, রাত করে বাসায় ফেরে, আমিও রাত করে বাসায় ফিরবো। পুরুষেরা কথায় কথায় বউকে পেটায়, আমিও কথায় কথায় স্বামীকে পেটাবো। পুরুষেরা কথায় কথায় বউকে তালাক দেয়, আমিও যখন খুশি তখনই স্বামীকে তালাক দেবো। এটা আমার অধিকার।  হ্যাঁ সব কথাই ঠিক। কথার মধ্যে যুক্তি আছে। পুরুষ যা করতে পারে, মহিলা কেন তা করতে পারবে না? মহিলা অর্থাৎ নারীর ক্ষেত্রে এখনো কি ‘অবলা’ শব্দটিই গুরুত্ব পাবে? আমি ঢাকায় নিকেতনে ভাড়া বাসায় থাকি। চ্যানেল আইতে আনন্দ আলোয় অফিস শেষ করে মাঝে মাঝে হেঁটেই বাসায় যাই। আড়ং’র পাশ দিয়ে নিকেতনে যাওয়া-আসার একটি গেট আছে। ওই গেটের সামনে কয়েকটি দোকানে সারাদিন ভিড় লেগেই থাকে। একদিন দেখলাম এক তরুণী তার বন্ধুদের সাথে বসে প্রকাশ্যে সিগারেট টানছে। বেঞ্চিতে তার বসার স্টাইলে পুরুষালি ভাব। ডেমকেয়ার। এই দৃশ্য দেখে একটু যেন হোঁচট খেলাম। যদিও এই দৃশ্য শুধু নিকেতনেরই নয়। ঢাকার সর্বত্র জনসমক্ষে প্রকাশ্যে মেয়েরা সিগারেট টানছে আজকাল। চারপাশে কী হচ্ছে এসব? একথা যখন ভাবছি তখন হঠাৎ মনে হলো কেউ একজন আমাকে প্রশ্ন করলো- মেয়েরা সিগারেট টানলে ক্ষতি কী? পুরুষেরা যখন সিগারেট টানে তখন তো কেউ কিছু বলে না।

 মেয়েদের বেলায় এত চোখ টাটায় কেন? প্রশ্নটা আসলে আমি নিজেই নিজেকে করেছি। কথার মধ্যে যুক্তি আছে। পুরুষ সিগারেট খেতে পারলে মেয়েরা কেন পারবে না। যদিও সিগারেট নেশাজাতীয় দ্রব্য। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। নেশা খাবি খা, মারা যাবি যা। কেউ যদি সিগারেট খেয়ে শরীরের ক্ষতি করতে চায় করুক, মরতে চায় মরুক। পুরুষের জন্য সাত খুন মাফ। আর মেয়েদের বেলায় যত নিষেধাজ্ঞা...নিয়মনীতি...অগ্রসরমান সমাজে এমন বৈষম্য চলবে না।  সত্যি বলতে কি, তবুও মেয়েদের সিগারেট খাওয়া আমার অপছন্দ। সিগারেট মাদকের পর্যায়ে পড়ে। জেনে শুনে কেন মেয়েরা সিগারেট খাবে। ছেলেদের সঙ্গে যদি প্রতিযোগিতা করতেই হয় তাহলে পেশাগত, মেধাগত প্রতিযোগিতা হলে ক্ষতি কি? মেয়েরা পুরুষ হতে চায়। অর্থাৎ পুরুষের মতো স্বাধীনতা চায়। আমিও তা চাই। কিন্তু সিগারেট টানার মধ্যে কী এমন স্বাধীনতা আছে? সিগারেট শরীরের জন্য ক্ষতিকর। নারী-পুরুষ সবারই সিগারেট বর্জন করা উচিত। ছেলেরা সিগারেট টানে, তাই বলে মেয়েদেরকেও সিগারেট টানতে হবে- এর পক্ষে আমি কোনো যুক্তি দেখি না। হিরো আলম নামের একজন তরুণ দেশে ব্যাপক আলোচিত। বগুড়া থেকে জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন।

 নির্বাচনে পরাজয়বরণ করেছেন। তার ধারণা তাকে নির্বাচনে ষড়যন্ত্র করে হারানো হয়েছে। হিরো আলম একজন অভিনেতা, চলচ্চিত্র প্রযোজক। তার ক্ষোভ, তিনি দেখতে অসুন্দর, ভালো লেখাপড়া জানেন না। তাই সমাজের উপরতলার মানুষ তাকে পছন্দ করে না। মূলত এই সেন্টিমেন্টকে পুঁজি করে হিরো আলম নামের এই তরুণ ফেসবুকের হিরো হয়ে উঠেছেন। গত কয়েকদিন ধরে দেখছি বিভিন্ন টেলিভিশনের টকশোতেও হিরো আলম বক্তা হয়ে আসছেন। সত্যি বলতে কি এই বিষয়টিও আমি কেন যেন মেনে নিতে পারছি না। হিরো আলমের অনেক ফ্যান, ফলোয়ার। তিনি যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যান তখন শত শত মানুষ তাকে দেখার জন্য উঁকি ঝুঁকি মারে। কেউ কেউ টিটকারীও দেয়। তবুও হিরো আলম নায়ক। সৌন্দর্য একজন মানুষের নিজস্ব সম্পদ। সব মানুষই সুন্দর। কে ফর্সা, কে কালো এটা বিবেচ্য বিষয় নয়। বিবেচ্য হলো মেধা। হিরো আলম মেধাবী কি মেধাবী না সেটা নির্ধারণের যোগ্যতা আমার নেই। তবে ছোট্ট একটা প্রশ্ন আছে আমার। হিরো আলমকে অনেকে ভাবেন তারুণ্যের প্রতিনিধি। তার মানে আমরা কি হিরো আলমের মতোই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আশা করছি? হিরো আলম অবশ্যই এক অর্থে হিরো। তবুও আমি তার পক্ষে মত দিতে পারছি না।

 

 

ফেসবুকের কল্যাণে এখন সবাই নায়ক, সবাই নায়িকা। মুহম্মদ জাফর ইকবাল, দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, জনপ্রিয় লেখক। অথচ তার ব্যাপারেও নেগেটিভ মন্তব্য করতে দ্বিধা করি না। তার মানে বিশিষ্টজনেরা ভুল করলে আমরা কি কেউ কিছু বলবো না? অবশ্যই বলবো। কিন্তু এই ‘বলার’ মধ্যেও তো একটা শ্রদ্ধাবোধ থাকবে, সমীহ থাকবে। আমরা যেন সেই শ্রদ্ধাবোধ ও সমীহ করার মানসিকতা বর্জন করতে চলেছি। সেদিন বইমেলায় দেখলাম একজন বিশিষ্ট লেখক মেলার মাঠে প্রায় একা নিঃসঙ্গ হেঁটে যাচ্ছেন। দু’একজন যে তাকে সালাম দিচ্ছে না তা কিন্তু নয়। কিন্তু হঠাৎ দেখলাম একজন তরুণকে ঘিরে পেছন থেকে একটা জটলা সামনের দিকেই আসছে। ওই তরুণ একজন তারকা। অভিনয় করেন। একটা বই লিখেছেন। তার অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য সবাই তার পিছু নিয়েছে। বিশিষ্ট ওই লেখকের পাশ দিয়ে জটলাটা চলে গেল। শতাধিক বইয়ের লেখক হা করে তাকিয়ে আছেন। অথচ বইমেলায় শতাধিক বইয়ের লেখকেরই তো এমন সম্মান পাবার কথা। কিন্তু কে দিবে তাকে সম্মান? এমন যদি হতো ওই লেখক আপত্তিকর কিছু লিখতেন, বিতর্কিত বিষয় তার বইয়ের মলাট বন্দি হতো তাহলে পঙ্গপালের মতো মানুষ ছুটতো তার পেছনে। 

সাংবাদিকরাও মরিয়া হয়ে উঠতো তার সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য। আসলে আমরা অনেকটা অন্ধকারের দিকেই ছুটছি। যা কিছু নেগেটিভ তাই যেন আলোচনার বিষয়। সে কারণে সুযোগ বুঝে লেখালেখিতেও অন্ধকার খুঁজছেন অনেক লেখক। কারণ অন্ধকারের প্রতি অর্থাৎ নিষিদ্ধ সবকিছুর প্রতিই মানুষের আজকাল আগ্রহ বেশি। যার যে কাজ, তাকে সেই কাজের ক্ষেত্রে মর্যাদা দিচ্ছি না। এবারের বইমেলায়ও দেখছি তারকাদের বই প্রকাশের হিড়িক। কারণ তারকাদের বই প্রকাশ করলে প্রকাশকদের তাৎক্ষণিক লাভ। ফলে একশ্রেণির চতুর প্রকাশক মূলধারার কবি-লেখকদের পেছনে না ছুটে তারকাদের  পেছনেই ছুটছেন। সাহিত্যমান কাম্য নয়, বাণিজ্যই তার বা তাদের কাছে মুখ্য। এমন কথাও শোনা যাচ্ছে, হিরো আলমকে দিয়েও বই লেখানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। হয়তো আগামী বইমেলায় দেখা যাবে নায়িকা পরীমনিও বই লিখেছেন। কারণ তার বইয়ে তাৎক্ষণিক বাণিজ্য সুবিধাই পাওয়া যাবে বেশি।  আবারো বলি, আমরা বুঝে না বুঝে মূলত অন্ধকারের দিকেই ধাবিত হচ্ছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অনেক সুফল আছে। কিন্তু এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই আমাদের অনেক সর্বনাশ করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতিবাচক খবরই ব্যাপক গুরুত্ব পাচ্ছে। একটি ভালো বইয়ের কথা লিখুন, খুব একটা লাইক কমেন্টস পাবেন না।

 তবে খারাপ বই নিয়ে লিখুন, যে বইয়ে যৌনতার ছড়াছড়ি অথবা বিতর্কিত কোনো বিষয় নিয়ে লেখা হয়েছে, দেখবেন সেই বই নিয়ে একটা হইচই পড়ে যাবে।  সম্প্রতি একজন প্রবাসী লেখিকার একটি বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যৌন সম্পর্কের অন্ধকার জগৎ এই বইয়ের মূল বিষয়। তিনি কার কার সঙ্গে যৌন লীলা করেছেন সেসব কথাও ওই বইয়ে লেখা আছে। কী ভয়াবহ ব্যাপার! সাহিত্যে যৌনতারও সৌন্দর্য আছে। কিন্তু এ কেমন যৌন সৌন্দর্য? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বইটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। অনেকেই বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে কটু মন্তব্য করছেন আবার তারাই অনেকে মন্তব্য লিখেছেন বইটি পড়ে দেখতে হবে। তার মানে লেখিকার উদ্দেশ্য সফল। এ যদি হয় বাস্তবতা তাহলে তো কেউ আলো খুঁজবে না। অন্ধকার খুঁজবে। কারণ অন্ধকারের আলোচনা বেশি।  লেখাটি শুরু করেছিলাম মহিলাদের পুরুষ হওয়ার উদ্‌গ্র বাসনার চিত্র তুলে ধরে। পুরুষ সিগারেট টানে, কাজেই মহিলারাও সিগারেট টানবে এতে ক্ষতির কিছু দেখি না। পুরুষ মদ খায়, মহিলারও মদ খাবে এটাও দোষের কিছু নয়। 

রাত-দুপুরে পুরুষ বাসায় ফিরে, কাজেই মহিলাদের ফিরতে দোষ কোথায়? দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় পুরুষ ও মহিলার বিভাজন করা ঠিক হবে না। নারী ও পুরুষের সম্মিলিত শক্তিই দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিচ্ছে। সবই ঠিক আছে। তবুও কথা থেকে যায়। আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধ বলে একটা কথা আছে। নারী-পুরুষের বিভাজন আমি মানি না। শুধু অনুরোধ করবো, আমরা যেন নিজস্ব সংস্কৃতিকে ভুলে না যাই। একটি পরিবার। স্বামী-স্ত্রী, দুই ছেলে-মেয়ে। কেউ কারও খোঁজ রাখে না। কলেজপড়ুয়া ২ ছেলে-মেয়ে স্বাধীন জীবন বেছে নিয়েছে। দু’জন মাদকে আসক্ত। ঘরে বসেই সিগারেট, মদ খায়। বন্ধুদের নিয়ে অশোভন আড্ডা দেয়। দেশের কিছুই তাদের ভালো লাগে না। টিভি নাটক ভালো লাগে না। সিনেমা পছন্দ নয়। দেশের গান অপছন্দ। এই পরিবারটা আমাদের নয়। সত্যি আমাদের নয়। শেষ কথা, নারী ও পুরুষের প্রতিযোগিতাটা হোক মেধা ও মননে। সদ্য প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষায় মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে ভালো করেছে। ফুটবলে মেয়েরা অব্যাহত গতিতে ভালো করছে। এমন প্রতিযোগিতাই সর্বত্র আলো ফেলুক। শুভকামনা সবার জন্য।  

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status