প্রথম পাতা
নিপাহ ভাইরাসে ৫ জনের মৃত্যু আক্রান্ত ৮
স্টাফ রিপোর্টার
৩০ জানুয়ারি ২০২৩, সোমবারচলতি বছর নিপাহ ভাইরাসে মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের। আক্রান্তের সংখ্যা ৮ জন। গত বছরের চেয়ে এবার নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ বেশি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। শীতের মৌসুম শুরু থেকেই গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য খেজুরের রস। খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। শীতে খেজুরের রস বাদুড়েরও অন্যতম একটি প্রিয় খাবার। আর বাদুড়ের মুখ দেয়া খেজুরের রস পানে মানুষের মধ্যে দেখা দেয় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই রোগের কোনো টিকা নেই। এটার কোনো স্পেসিফিক চিকিৎসাও নেই। রয়েছে শুধু সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত ২২ বছরে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৭১ শতাংশেরই মত্যু হয়েছে।
আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, নিপাহ ভাইরাস আক্রান্তের অন্যতম কারণ খেজুরের কাঁচা রস। এ ছাড়াও আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসা। এ ছাড়াও পাখি বা বাদুড়ের অর্ধ খাওয়া যেকোনো ফলমূল খেলেও হয়। তাই কাঁচা খেজুর রসের পাশাপাশি যেকোনো পাখির অর্ধ বা আংশিক খাওয়া ফলমূল থেকেও বিরত থাকতে হবে। এই বিষয়গুলোতে আমাদের সচেতন হতে হবে। এ ভাইরাসের ভয়াবহতা প্রসঙ্গে আইইডিসিআর পরিচালক বলেন, নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণটি খুবই মারাত্মক। বলা হয়ে থাকে, নিপাহ ভাইরাসে ৭০ শতাংশেরও বেশি মৃত্যু হয়। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত যাদেরই আক্রান্ত হতে দেখেছি, প্রত্যেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রতিবছর দেশে নিপাহতে অনেক আক্রান্ত হয়, এমনটি নয়। কিন্তু যারাই আক্রান্ত হয়, তারাই মারা যায়। তবে, মৃত্যুর কাছ থেকে যারা ফিরে আসেন, তাদের জন্য এক ভয়াবহ সময় অপেক্ষা করে। বেঁচে থেকেও তারা স্মৃতি হারিয়ে ফেলতে পারেন এবং পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন চিরতরে। অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন বলেন, এই রোগের কোনো টিকা নেই। এটার কোনো স্পেসিফিক চিকিৎসাও নেই। রয়েছে শুধু সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট। যতদিন সে বেঁচে থাকবে, ততদিনই তার চিকিৎসা চলবে।
সচেতনতা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, আইইডিসিআর এটি নিয়ে কাজ করছে, কিন্তু আমাদের একার পক্ষে তো মানুষকে সচেতন করা সম্ভব না। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাশাপাশি প্রচার-প্রচারণায় গণমাধ্যমকেও আরও ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু তাই নয়, সচেতনতার জায়গা থেকে সবাইকেই ভূমিকা পালন করতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), আইসিডিডিআরবিসহ বিভিন্ন সংস্থার তথ্য বলছে, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে প্রাথমিকভাবে মাথাব্যথা, খিঁচুনি, গা ব্যথা, ঘাড় ও পিঠ শক্ত হয়ে যাওয়া, বমি বমি ভাব এবং গলা ব্যথা হতে পারে। এরপর আক্রান্ত ব্যক্তি প্রলাপ বকা শুরু করতে পারে। এ ধরনের রোগী আলো সহ্য করতে পারে না। কখনো কখনো অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। পরিস্থিতির অবনতি হলে হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া অথবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
গত ১১ই জানুয়ারি নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বছরের প্রথম এক নারীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানায় আইইডিসিআর। ভাইরাসে মৃত নারীর বাড়ি রাজশাহী এলাকায়। খেজুরের রস খেয়ে তিনি বাদুড়বাহিত এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এর আগে গত বছরও (২০২২) নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্তের তিনটি কেস পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে দু’জন মারা গেছেন। এদের একজন ছিলেন নওগাঁর, অন্যজন ফরিদপুরের। আইইডিসিআর আরও জানায়, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ৭১ শতাংশ মানুষ মারা যায়। তাই কাঁচা খেজুরের রস খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, বাদুড় যখন খেজুরের রস খায়, তখন তার দ্বারা সেটি ‘ইনফেকটেড’ হয়ে যায়। মানুষ সেই রস কাঁচা খেলে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তারপর আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে তার পরিবারের সদস্য ও পরিচিতরা আক্রান্ত হয়।
লক্ষণ প্রসঙ্গে সংস্থাটি আরও জানায়, দূষিত খেজুরের রস খাওয়ার পর নিপাহ আক্রান্তের লক্ষণ দেখা দিতে ৮ থেকে ৯ দিন লাগতে পারে। অন্যদিকে, ইতিমধ্যে আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে লক্ষণ দেখা দেয় ৬ থেকে ১১ দিন পর। নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ রোধে গত ২০১১ সালে প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে একটি জাতীয় নির্দেশিকা জারি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নির্দেশিকায় খেজুরের কাঁচা রসকে নিপাহ ভাইরাসের প্রধান বাহন হিসেবে চিহ্নিত করে সংক্রমণ রোধ করতে খেজুরের কাঁচা রস খাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
এই বছর নিপাহ ভাইরাসে পাঁচজনের মৃত্যু: গতকাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ে ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, আমাদের কাছে রোগী এসেছে ৮ জন। এরমধ্যে ৫ জন মারা গেছেন। ভাইরাসে আক্রান্তদের ৭০ শতাংশের বেশি মৃত্যু হয়। কাঁচা রস পান করলে, পাখি খাওয়া ফল খেলে এই রোগ হয়। বিশেষ করে বাদুড় এই ভাইরাস বহন করে। বাদুড় খেজুরের রস পান করার পর সেটি মানুষ পান করলে মানুষের শরীরে সেই ভাইরাসটি ঢুকে যায়। অসুস্থ মানুষের সংস্পর্শে সুস্থ মানুষ আসলেও নিপাহ ভাইরাস ছড়ায়। তখন মাল্টিপল রোগী হয়ে যায়, দ্রুত ছড়ায়। এটা আমাদের আশঙ্কার বিষয়। নিপাহ ভাইরাস ছড়ানো প্রতিরোধে সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, প্রথমে মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করা। এজন্য আমরা টিভিসিও তৈরি করেছি। পত্রপত্রিকায় দেয়ার ব্যবস্থা করেছি, আজকে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া আলাদা হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে আমরা একটি বিশেষ ইউনিট তৈরি করেছি, আইসিইউ ইউনিট যেখানে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। নিপাহ ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক নেই। কোনো ভ্যাকসিন নেই, ওষুধও নেই। সিম্পটমেটিক চিকিৎসা দেয়া হয়। যেভাবে আমরা করোনার চিকিৎসা দিয়ে আসছিলাম। মন্ত্রী বলেন, আমাদের সজাগ থাকতে হবে। কাঁচা খেজুরের রস মোটেই পান করা যাবে না। যে ফল কোনো পাখি বা জন্তুতে খেয়েছে, সেগুলোও খাওয়া যাবে না। নিপাহ ভাইরাসের বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে জাহিদ মালেক বলেন, আমরা চেষ্টায় আছি, এটি যাতে ছড়িয়ে না যায়। সেদিকে আমরা সতর্ক অবস্থায় আছি। আল্লাহর রহমতে এটি সেভাবে ছড়ায়নি। ৮ জনের মধ্যে ৫ জন মৃত্যুবরণ করেছেন, এজন্য আমাদের সতর্ক হওয়াটা খুবই জরুরি। গত বছরের চেয়ে এবার নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণটা বেশি বলেও জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সংক্রমণ কেন বেড়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারণ বলা মুশকিল। হয়তো এবার খেজুরের রসের উৎপাদন বাড়ছে, গাছের সংখ্যা বাড়ছে, সেজন্য হয়তো এটা বেশি হচ্ছে।