শেষের পাতা
নতুন নেশা কেটামিন নিয়ে উদ্বেগ
ফাহিমা আক্তার সুমি
২৯ জানুয়ারি ২০২৩, রবিবারনতুন মাদক কেটামিন। এটি ‘পার্টি ড্রাগ’ নামেও পরিচিত। ভয়ঙ্কর এই মাদকে আসক্ত হওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অভিজাত পরিবারের সন্তানরা সহজে এই মাদক পেয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান, ধানমণ্ডি ও বনানীতে কেটামিনের প্রচুর চাহিদা। বিভিন্ন পার্টিতে নেশাজাতীয় এই নতুন মাদক সেবন করিয়ে ঘটছে ধর্ষণের ঘটনাও। ডিএনসিসি’র কর্মকর্তারা বলছেন, কোমল পানীয়ের সঙ্গে পাউডার জাতীয় মাদকটি মিশিয়ে সেবন করালে অনেকে সেটি বুঝতে পারে না। এটি সেবনের পর অনেকের স্বাভাবিক জ্ঞান থাকে না। এসময় তরুণীদের সঙ্গে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। দাম বেশি হওয়ায় শুধু ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানরা ব্যবহার করে।
এটি ব্যবহারের ফলে মাদকসেবীর নিজের প্রতি কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কেউ কেউ মাদকটিকে বলে ‘রেপ ড্রাগ’ বা ‘পার্টি ড্রাগ’। এর কোনো ঘ্রাণ বা রং নেই। বিভিন্ন দেশে এ মাদক ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। ১৯৭০ সাল থেকে ইউরোপ ও আমেরিকায় এটি খুবই জনপ্রিয়। নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে সেবনকারী অন্য জগতে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। সম্প্রতি রাজধানীর বনানী থানার ১১ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে অভিযান চালায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসিসি) ঢাকা মেট্রো (উত্তর) কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। অভিযানে গ্রেপ্তার হন সৈয়দ নওশাদ নামের এক যুবক। জানা যায়, নওশাদ অভিজাত পরিবারের সন্তানদের কাছে ইয়াবা, হেরোইনসহ বিভিন্ন মাদক বিক্রি করতেন। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে মাদক উদ্ধার অভিযানে গিয়ে কর্মকর্তারা দেখেন, নওশাদ বাসায় বসে মাদক তৈরি করছে। বিভিন্ন কেমিক্যাল ও কৌশলের মিশ্রণে কেটামিন নামের একটি নতুন মাদক উৎপাদন করছে। যা হেরোইনের আড়ালে গুলশান, বনানী ও উত্তরার অভিজাত শ্রেণির মাদকসেবী সন্তানদের কাছে বিক্রি করতো সে। ডিএনসিসি’র কর্মকর্তারা জানান, নওশাদ ধনাট্য পরিবারের সন্তান। সে দীর্ঘদিন ধরে মাদক সেবন করে আসছিল।
তার বাবা একজন ব্যবসায়ী। জিজ্ঞাসাবাদে নওশাদ জানায়, স্কুল জীবনে মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর নওশাদ উচ্চশিক্ষার জন্য মালয়েশিয়া যায়। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে আবার মাদকে জড়িয়ে পড়ে। পড়ালেখা শেষ না করেই ২০০৩ সালে দেশে ফিরে আসে। মালয়েশিয়া বসে শিখে নতুন মাদক তৈরির কৌশল। তরল কেটামিনকে পাউডারে পরিণত করার কৌশল সে মালয়েশিয়াতেই শিখে। এরপর দেশে ফিরে বিভিন্ন পার্টিতে যাওয়া শুরু করে। বিভিন্ন মাদকের আড়ালে নতুন ধরনের এই মাদকটি বিক্রি শুরু করে সে। ডিএনসি’র ঢাকা মেট্রো উত্তর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মেহেদি হাসান জানান, গ্রেপ্তারকৃত নওশাদ দেশে নতুন ধরনের মাদক বাজারজাত করার চেষ্টা করছিল। আমরা অন্য একটি মাদক বিক্রির তথ্যে অভিযান চালিয়ে কেটামিন নামের এই নতুন মাদকটি পাই। আমাদের দেশে কোনো মাদক উৎপাদন হয় না কিন্তু নওশাদ নিজ বাসায় বসে মাদক উৎপাদনের চেষ্টা করছিল। সে নিজেই বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এই মাদক উৎপাদন করতো। তার এই মাদকের ক্রেতা ছিল সমাজের অভিজাত শ্রেণির মাদকসেবীরা। তিনি আরও বলেন, নওশাদ প্রতি গ্রাম কেটামিন বিক্রি করতো ২০-২৫ হাজার টাকায়। আর এই মাদক তৈরিতে ব্যথানাশক বিশেষ একটি ওষুধ ব্যবহার করে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তৈরি করতো এটি।
এটি একটি ‘ক’ শ্রেণির মাদক। এই মাদক দেশে দ্বিতীয়বার ধরা পড়লো। কর্মকর্তারা জানান, ২০১৭ সালে ঢাকার মিরপুর থেকে আন্তর্জাতিক মাদক চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব। তখন র্যাব জানিয়েছিল- নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় তরল কেটামিন তোয়ালেতে মেশানো হতো। সেটি দেখে কেউ বুঝতেই পারতো না তোয়ালেতে কেটামিন রয়েছে। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বিদেশে পাচারের পর সেটিকে বিশেষ কৌশলে আবার তরল কেটামিনে রূপান্তর করা হতো। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসিসি) পরিচালক (অপারেশন ও গোয়েন্দা) অতিরিক্ত ডিআইজি মো. তানভীর মমতাজ মানবজমিনকে বলেন, কেটামিনকে ‘রেপ ড্রাগ’ বা ‘পার্টি ড্রাগ’ বলা হয়। এটি সাধারণত চিকিৎসাক্ষেত্রে অ্যানেস্থেসিয়ার কাজে লাগে। উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীরা অনেক সময় পার্টিতে গেলে এই ড্রাগটি ব্যবহার করে। এটি সেবন করলে তাদের চেতনা লোপ পায়। সে তখন বুঝতে পারে না তার সঙ্গে কী ঘটছে না ঘটছে। দীর্ঘদিন মাদকটি নেয়ার ফলে মানুষের ব্রেন চেঞ্জ হয়ে যায় এবং সে অভ্যস্ত হয়ে উঠে। মাদকটি বর্ণহীন। কোমল পানির মধ্যে এটি দেয়া হয়। বোঝার কোনো সিস্টেম নেই যে এটিতে মাদক আছে। কোনো পার্টিতে গেলে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এটি সেবন করার ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে এটির ইফেক্ট শুরু করে। এর একটাই উপায় সচেতন থাকা।