ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

এক দশকে রাজনৈতিক সহিংসতায় মৃত্যু ১৪০০

নাজমুল হুদা
২৮ জানুয়ারি ২০২৩, শনিবার
mzamin

ফাইল ছবি

সম্প্রতি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ইংরেজি নববর্ষ বরণকে ঘিরে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। এতে মো. ফিরোজ আহমেদ (২৫) নামের এক যুবক নিহত হন। ৩১শে ডিসেম্বর রাত  সাড়ে ৩টার দিকে ঘটে এই ঘটনাটি। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেয়া হয়। পরে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। নিহত ফিরোজ ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের ২৮নং ওয়ার্ডের কার্যকরী সদস্য ছিলেন। গত ৭ই ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয় পুলিশের। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে একজনের মৃত্যু হয়। আহত হন শতাধিক। তাদের মধ্যে দলীয় কর্মী, পথচারী ও পুলিশ সদস্যও রয়েছেন।

বিজ্ঞাপন
নিহত মকবুল হোসেন রাজধানীর বাউনিয়াবাদ এলাকার বাসিন্দা। তিনি নয়াপল্টনে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিচতলায় গুলিবিদ্ধ হন। নিহত মকবুল জুতায় চুমকি লাগানোর কাজ করতেন। গত ৩১শে জুলাই তেল গ্যাসসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে কর্মসূচি করে বিএনপি। এতে ভোলায় পুলিশের সঙ্গে বিএনপি কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী আব্দুর রহিম নিহত হন। আহত হন অন্তত ৪০ নেতাকর্মী। এরমধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন জেলা ছাত্রদল সভাপতি নুরে আলম। তিনদিন চিকিৎসা নিয়ে ঢাকার কমফোর্ট হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার। রাজনৈতিক সংঘাতে এমন মৃত্যু ও আহতের খবর নিয়মিত শিরোনাম হচ্ছে। 

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) গত ১০ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৩ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক সংঘাত ঘটেছে ৬ হাজার ১২৬টি। এসব সংঘাতে নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৪০০ জন। এ ছাড়া আহত হয়েছে ৮৩ হাজার ১৭ জন। এরমধ্যে আওয়ামী লীগের ৩৯২ জন ও বিএনপি’র ৮৪ জন নেতাকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। এই দুই রাজনৈতিক দল ছাড়াও অন্য দলের নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মৃত্যুও রয়েছে। এ ছাড়া ৩১৩ জন সাধারণ মানুষও নিহত হয়েছেন এই ১০ বছরে। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম ও নিজস্ব সোর্সে সংগৃহীত তথ্যের আলোকে প্রতিবছর হালনাগাদ প্রকাশ করে মানবাধিকার সংস্থাটি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ এগিয়ে না নিয়ে বুর্জুয়া ধারায় রাজনীতি হচ্ছে। এতে করে সংঘাত হচ্ছে এবং মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। দেশে যথার্থ নির্বাচন হবে, নির্বাচনের মধ্যে ক্ষমতা পরিবর্তন হবে। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। সমঝোতাহীন ও বুর্জুয়া রাজনীতির অংশই হচ্ছে এই সংঘাত। 

ইমেরিটাস অধ্যাপক, লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, আমাদের দেশে যে রাজনীতি হয় তা আমরা বুর্জুয়া রাজনীতি বলি। এই রাজনীতি হলো ক্ষমতার জন্য। রাজনীতির দুটো ধারা আছে। একটা হলো বুর্জুয়াদের ধারা; যারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে। আরেকটা ধারা হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু এটি বাংলাদেশের প্রধান রাজনীতি হয়ে উঠতে পারে নাই। সেই কারণেই রাজনৈতিক সংঘাতে এত মানুষের মৃত্যু হয়। রাজনৈতিক দলগুলো সব বুর্জুয়া দল। এরসঙ্গে রাষ্ট্র, পুলিশ জড়িত। এই রাষ্ট্র বুর্জুয়ারা শাসন করে। যদিও আমরা এদের বুর্জুয়া বলি কিন্তু তা নামে বুর্জুয়া চরিত্রে বুর্জুয়া নয়। এই অর্থে যে, বুর্জুয়াদের মধ্যে সহিষ্ণুতার একটা গুণ থাকে। সেখানে সংসদীয় রাজনীতি প্রতিষ্ঠার একটা গুণ থাকে। কিন্তু এখন বুর্জুয়াদের সহনশীলতা নেই, এক দল আরেক দলকে সহ্য করতে পারে না। এবং সংসদীয় রাজনীতির ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পায় নাই। কারণ সংসদীয় রাজনীতির মধ্যে সহনশীলতা থাকে। 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, রাজনৈতিক এই সংঘাতের দায় রাষ্ট্রের। প্রত্যেকটা নাগরিকের জীবন ও অধিকার রক্ষা করা উচিত রাষ্ট্রের। কিন্তু রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার হয় যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের দ্বারা। পুলিশ এই ভূমিকা নেয়। রাজনৈতিক কারণে পুলিশ নিরপেক্ষ ভূমিকা নিতে পারে না। যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের পক্ষে থাকে পুলিশ। যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকে তারা রাজনৈতিকভাবে পুলিশকে ব্যবহার করে।
আসকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই এক দশকে রাজনৈতিক সংঘাতে সবচেয়ে বেশি নিহত ও আহতের ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘাতে। আলোচ্য সময়ে এই সংঘাতে ৯৫১ জন নিহত ও আহত হয়েছেন ৫১ হাজার ১০৪ জন।

মানবাধিকারকর্মী ও আসকের নির্বাহী পরিচালক নূর খান মানবজমিনকে বলেন, রাজনৈতিক সংঘাতে মৃত্যুর দায় প্রথম তো সরকারের। এ ছাড়া বিবদমান রাজনৈতিক দল আর সমঝোতাহীন রাজনৈতিক কালচারও দায়ী। সমঝোতাহীন রাজনীতি যখন চালু থাকে এবং গণতন্ত্র যখন সংকুচিত হয় তখন বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা বাড়ে। এই সংঘাত কমাতে সর্বদলীয় আলোচনা ও সমাঝোতার পথ খুঁজে বের করতে হবে। এবং গণতন্ত্রকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়া। এটা সব দলের দায়িত্ব এবং সরকারের দায়িত্ব বেশি। 

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার মানবজমিনকে বলেন, এই রাজনৈতিক সংঘাতের দায় রাজনীতিবিদদের। কারণ রাজনীতি একটা মহান ও গুরুত্বপূর্ণ পেশা। মানুষের কল্যাণ করার পেশা এটি। কিন্তু এই পেশার সঙ্গে যুক্ত যারা তারা যদি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয় এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না। আমাদের হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি এবং নিশ্চিহ্ন করার রাজনীতির ফলে মানুষের কল্যাণের বদলে অকল্যাণই হচ্ছে। এর থেকে আমাদের মুক্তি পাওয়া দরকার। আমাদের রাজনীতির ক্ষেত্রে সমঝোতা হওয়া দরকার। তাহলে আমরা এর থেকে উত্তরণ করতে পারবো। আমি মনে করি তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status