ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

মাসে ৩ হাজার অভিযোগ

ভুয়া সিমে সাইবার অপরাধ

ফাহিমা আক্তার সুমি
২৬ জানুয়ারি ২০২৩, বৃহস্পতিবার
mzamin

নতুন কৌশলে বেপরোয়া সাইবার অপরাধীরা। অনলাইনে চাকরির বিজ্ঞাপন, ফেসবুক আইডি হ্যাক, স্পর্শকাতর ছবি ও ভিডিও ধারণ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে নানা অপকর্ম   করছে। পাশাপাশি এ সকল অপরাধীরা ভুয়া সিম ব্যবহারে হয়ে উঠছে বেপোরোয়া। এদের আইনের আওতায় আনতে বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। সূত্র জানায়, সাইবার অপরাধ কমাতে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি। এরপরও আসামিদের গ্রেপ্তার ও শনাক্তে পড়তে হয় নানা সমস্যায়। পরিচয় গোপন রাখতে কৌশলে অপরাধীরা ব্যবহার করছে ভুয়া সিম কার্ড। এ সকল সাইবার অপরাধী মোবাইলে অসংখ্য ফেসবুক অ্যাকাউন্ট চালু রাখে। প্রতারকরা এসব অ্যাকাউন্ট চালানোর জন্য তাদের স্মার্ট ফোনে ব্যবহার করে অন্যের নামে নিবন্ধিত সিম কার্ড। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টারের তথ্যমতে, মাসে গড়ে ৩ হাজার সাইবার অপরাধের অভিযোগ আসে এই ইউনিটে।

বিজ্ঞাপন
 বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাইবার অপরাধ যেভাবে বাড়ছে সেভাবে মামলা, ভুক্তভোগী ও গ্রেপ্তারের সংখ্যা বাড়ছে। গতানুগতিক অপরাধ ছেড়ে এখন সাইবার অপরাধের দিকে ঝুঁকছে অপরাধীরা। তাদেরকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার পরও নতুন নতুন অপরাধীর সৃষ্টি হচ্ছে। এতে করে এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা এখন অনেকটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। পুলিশের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে দেশে ২৬৭টি সাইবার অপরাধ সংঘটিত হয়। পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭১টিতে। ২০১৭ সালে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে অন্তত ১৩শ’ সাইবার অপরাধ সংঘটিত হয়। ২০১৭ সালের পর থেকে বিগত বছরগুলোতে এই অপরাধের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে বহুগুণ। 

এছাড়া জঙ্গিদের মধ্যে অন্তত ৮২ ভাগ তরুণ অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অন্ধকার পথে গেছে, যা সাইবার অপরাধের ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত। সূত্র জানায়, ভুয়া সিম তৈরির চক্রগুলো প্রত্যন্ত গ্রামের সহজ-সরল মানুষদের ২০০-৫০০ টাকা দিয়ে তাদের আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে নতুন সিম তোলেন। এগুলো তারা জানেনই না যে, তার নামে এতগুলো সিম ব্যবহার করা হচ্ছে। এরপর সাইবার অপরাধীরা বাড়তি টাকায় সিমগুলো একটি চক্রের কাছ থেকে সংগ্রহ করে।  ফারজানা আক্তার। স্বামী সংসার নিয়ে সুখের সংসার। গেল বছরে হঠাৎ একদিন একটি অপরিচিত ফেসবুক আইডি থেকে মেসেজ আসে। মেসেজের মাধ্যমে তাকে কুরুচিপূর্ণ প্রস্তাব দেয়া হয়। ক্রমাগত এ ধরনের মেসেজ পেয়ে ভয় পান তিনি। মেসেজের উত্তর দেয়া বন্ধ করেন। কু-প্রস্তাবে রাজি না হলে ওই আইডি থেকে তাকে হুমকি দেয়া হয়। তার ছোট ছেলেকে অপহরণ করার ভয় দেখান। এমন হুমকি পেয়ে ফারজানার পরিবার ভয় পেয়ে যান। ভয়ভীতি ও হুমকি থেকে বাঁচতে তার পরিবার মামলা করেন। পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন জানায়, অভিযোগের প্রেক্ষিতে সব সংগ্রহ করা হয়। অভিযুক্ত ভুয়া ফেসবুক আইডি দিয়ে ভুক্তভোগীকে হয়রানির সত্যতা মেলে। এবং অভিযুক্তকে শনাক্ত করা হয়। সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটসহ সরকারি কর্মকর্তা পরিচয়ে প্রতারণা করে আসছিলেন মামুন ইসলাম। 

গত বছরের ৩১শে আগস্ট দিনাজপুর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সিআইডি জানায়, মামুন পেশায় গ্রিল ওয়ার্কশপের কর্মচারী হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে  সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয়ে আবার কখনও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহকারী উপ-সচিব, কখনও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা, কখনও ব্যাংক কর্মকর্তা আবার কখনও ইঞ্জিনিয়ার পরিচয় দেয়। নিজেকে সরকারি কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন মেয়ে ও সাধারণ লোকদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে তাদের সুবিধা পাইয়ে দেয়ার নাম করে অর্থ আত্মসাৎ করতো। তৈরি করতো ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়েদের সঙ্গে স্থাপন করতো প্রেমের সম্পর্ক। সম্পর্কের এক পর্যায়ে সে মেয়েদের বিয়ের প্রস্তাব দিতো। যদি কোনো ভুক্তভোগী তার বিয়ের প্রস্তাবে সাড়া না দিতো তাহলে মামুন আত্মহত্যা করবে বলে ইমোশনাল ব্ল্যাক-মেইল করে মেয়েদের বিয়েতে রাজি করাতো। পরে বিয়ের ফাঁদে ফেলে মেয়েদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করতো। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে সে কখনো দেখা করতো না। বিভিন্ন সরকারি কাজে খুব ব্যস্ত দেখাতো। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সরাসরি বিয়ে করতে আসতে পারছে না বলে মেয়ের নামে কাজী অফিসের সিলমোহরযুক্ত ভুয়া নিকাহ্‌নামা প্রস্তুত করে তাদের ঠিকানায় কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দেয় এবং মেয়েদের কাবিননামায় স্বাক্ষর করে প্রতারক মামুনের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে বলে। একটি মেয়ে সরল বিশ্বাসে মামুনের কথামতো কাজ করার কিছুদিন পর সে মেয়ের বাসায় যায় এবং ইসালামী শরীয়াহ্‌ মোতাবেক বিয়ে করে কিছুদিন একসঙ্গে বসবাস করে। 

ভুয়া বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর মামুন মেয়েটিকে আপত্তিকর ও আশালীন অবস্থায় ভিডিও কলে কথোপকথনের সময় মেয়েটির অগোচরে সে আপত্তিকর অবস্থায় ভিডিও কলের স্ক্রিন রেকর্ড করে সেই ভিডিওগুলো নিজ মোবাইলে সংরক্ষণ করে রাখতো। পরবর্তীতে ভিডিওগুলো অনলাইনে ও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করে দেবে বলে হুমকি প্রদান ও অর্থ দাবি করতে থাকে। এভাবে সে মেয়েটির কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে। মেয়েটি মামুনের প্রতারণার শিকার হয়ে ডিএমপি’র পল্টন থানায় পর্নোগ্রাফি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেন। সিআইডি’র সাইবার পুলিশ সেন্টারের সাইবার ইনভেস্টিগেশন ও অপারেশনস টিম মামুনকে গ্রেপ্তার করে। সূত্র জানায়, তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দায়ের করা মামলার ৯০ ভাগই ওই আইনের ৫৭ ধারায় হয়ে থাকে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে আপত্তিকর মন্তব্য প্রচার, অনলাইনে মানহানিকর সংবাদ প্রচারের অভিযোগেও ৫৭ ধারায় মামলা হচ্ছে। পাশাপাশি হ্যাকিং ও অনলাইনে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে এ আইনের ৫৫ ও ৫৬ ধারায় মামলা হয়ে থাকে। সাইবার অপরাধকে বিচারের আওতায় আনতে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সরকার। প্রথম বছরে ট্রাইব্যুনালে তিনটি মামলা ছিল। ২০১৪ সালে ৩২টি, ২০১৫ সালে ১৫২টি, ২০১৬ সালে ২৩৩টি মামলা ট্রাইব্যুনালে আসে। ২০১৭ সাল থেকে এ সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। সূত্র আরও জানায়, এ অপরাধের মাত্র ৩০ শতাংশ মানুষ মামলার আশ্রয় নেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা মামলা করতে অনীহা প্রকাশ করেন।

 এক জরিপে বলা হয়, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নারীর মধ্যে ৭৭ শতাংশই ফেসবুককেন্দ্রিক সাইবার অপরাধের শিকার। সিটি সাইবার, ডিবি সাইবার ও র‌্যাব’র সাইবার ইউনিটের কয়েক বছরের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় এই তিনটি ইউনিটের সাইবার ইউনিটের যাত্রার পর থেকে এখন পর্যন্ত মামলা হয়েছে ১৩২৭টি। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৭৫৯ জন সাইবার অপরাধীকে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) মুহাম্মদ রেজাউল মাসুদ মানবজমিনকে বলেন, নিজের পরিচয় গোপন রাখতে অন্যের নামে নিবন্ধন করা (ভুয়া) সিম ব্যবহার করে অধিকাংশ প্রতারক। সাইবার অপরাধীদের একটি গ্রুপ আছে যারা বিদেশে থাকে। তাদের মোবাইল, আইপি এডড্রেস, লোকেশন সব ঠিক থাকে। এদিকে দেশে যারা সাইবার অপরাধ করে এদের চিন্তা থাকে নিজের পরিচয় গোপন রেখে কীভাবে সাইবার অপরাধ করা যায়। এদের মূল টার্গেট থাকে অন্যের নামে নিবন্ধন করা সিমগুলো ব্যবহার করা। এই সিমগুলো অপরাধীরা বেশি মূল্যে ক্রয় করে থাকে। অসাধু এক শ্রেণির মানুষ এই সিমগুলো বেশি দামে অপরাধীদের কাছে বিক্রি করে। অভিযান করে এ ধরনের ভুয়া সিম ব্যবহার করা অনেক অপরাধীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। সাইবার অপরাধীদের অনেকগুলো ফেসবুক আইডি চালু থাকে। 

এসব অ্যাকাউন্ট চালানোর জন্য যে স্মার্ট ফোনটি ব্যবহার করা হয় তাতে অধিকাংশ প্রতারকদের পরিচয় গোপন রাখতে তাদের নামে নিবন্ধিত সিমকার্ড ব্যবহার করা হয় না। তাদের গ্রেপ্তারের আশঙ্কা দেখা দিলে প্রতারকরা অ্যাকাউন্ট ডিলিট করা থেকে মোবাইলের আইএমইআই নম্বরও পরিবর্তন করে ফেলে। ফলে সহজে চিহ্নিত করা যায় না প্রতারকদের। তাদের আইনের আওতায় আনতে বেগ পেতে হয়। এটি আমাদের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, বর্তমানে ফোন ও অনলাইন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে যত ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে তত সতর্কতা বাড়েনি। সচেতনতার ব্যাপারে মানুষ খুব উদাসীন। এজন্য অপরাধীরা আরও বেশি সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। সচেতনতা না বাড়ার কারণে হ্যাকাররাও খুব সহজে তাদের আয়ত্তে ফেসবুক আইডি নিয়ে নিতে পারছে।    

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status