ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

কেন ঢাকা আসছে মানুষ?

ফাহিমা আক্তার সুমি
২৪ জানুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার
mzamin

মোবারক হোসেন। বয়স বত্রিশ। চেহারায় চিন্তার ছাপ। মাথায় কাপড় মোড়ানো। খোলা আকাশের নিচে তার বসবাস। প্লাস্টিকের বোতল ও কাগজ সংগ্রহ করে তা বিক্রির টাকায় চলে জীবন। মোবারকের বাড়ি ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায়। সেখানে একটি অটোরিকশা ভাড়ায় চালাতেন তিনি। রিকশাটি চুরি হয়ে যায় বছর খানেক আগে। যাত্রী বেশে ৩ যুবক চুরি করে তার রিকশাটি।

বিজ্ঞাপন
এরপর ওই ৩ তরুণসহ তার নামে একটি মামলা দায়ের করেন অটোরিকশার মালিক। মামলার ভয়ে ঢাকায় চলে আসেন মোবারক। ঢাকায় এসে আবার রিকশা চালানো শুরু করেন। এখানেও পরপর দুইটি রিকশা চুরি হয় তার। 

শুক্রবার দুপুরে হাইকোর্ট মাজারে দেখা হয় মোবারকের সঙ্গে। সেখানে তিনি নামাজ শেষে খাবারের অপেক্ষায় ছিলেন। মোবারকের ভাষ্যমতে, বাড়িতে জায়গা-জমি, পরিবার সব আছে। আমি অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে চালাতাম। একদিন ৩ যুবক আমার রিকশায় ওঠে। পরে তারা আমাকে মারধর করে রিকশা চুরি করে নিয়ে যায়। এরপর মালিক টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে। ওই ৩ জনকে আমি মোটামুটি চিনতাম। তারা এই কাজ করবে আমি ভাবতে পারিনি। এই রিকশার দাম ৬০ হাজারের বেশি। তারা নিয়ে হয়তো ২০ হাজার টাকা বিক্রি করেছে। কিন্তু মালিককে তো আমার টাকা দেয়া লাগবে। এই রিকশা চালিয়ে যা আয় হতো তা পরিবারকে দিতাম। বাবা ডায়াবেটিসের রোগী ছিলেন। ৩ বছর আগে মারা যান। আমার আর ওই ৩ ছেলের নামে মামলা করে রিকশার মালিক। মামলার ভয় ও টাকার চাপে ঢাকায় এসেছি। গ্রামের মামলার চেয়ে মানসম্মানটা বেশি বড়। এক বছর হলো রিকশাটি চুরি হয়েছে আমার। ঢাকায় এখন প্লাস্টিক ও কাগজ টোকাই। কখনো কখনো বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েও ধোয়ামোছার কাজ করি। পরিবারের সবাইকে ছেড়ে পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে এখন আমি রাস্তায় পাগলের মতো ঘুরছি। তিনি বলেন, করোনার আগে মালয়েশিয়া পাঠানোর জন্য দালালের মাধ্যমে টাকা দেয় আমার পরিবার। সেখানেও যেতে পারিনি। 

শুধু মোবারক নয়, কাজের সন্ধানে রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, লঞ্চ ঘাটে প্রতিদিন এসে নামেন অনেক মানুষ।  গ্রামে কাজ না থাকায় শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বেকার যুবক ও বয়স্করা ছুটে আসেন কর্মব্যস্ত এই নগরে। ছোটবড় বিভিন্ন কাজে যুক্ত হচ্ছেন তারা। আবার কাজের খোঁজে রাতদিন হন্যে হয়ে ঘুরছেন অনেকে। কেউবা আবার ঘুরছেন মামলার বোঝা কাঁধে নিয়ে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঘুরে কথা হয় ঢাকায় আসা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে। 

করোনাকালে কাজের সুযোগ কমে যাওয়া বা কর্মক্ষেত্র হারিয়ে অনেকে যেমন ঢাকা ছেড়েছেন তেমনি গ্রামের অনেক কর্মহীন মানুষ রাজধানীতে আসছেন কাজের খোঁজে। তবে অর্থনৈতিক সংকট আর নিত্যপণ্যের উচ্চ মূল্যের এই সময়ে ঢাকায় কাজ করতে আসা মানুষদেরও খুব একটা স্বস্তি মিলছে না। 

একজন ৩০ বছর বয়সী সৈকত। পরিবারের সঙ্গে দেখা নেই দুই বছর ধরে। অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে ছুটছিলেন চাকরির জন্য। চাকরি যোগাড় করতে না পেরে এলাকায় ব্যবসা শুরু করেন। ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নেন। এই ঋণের কিছু টাকা পরিশোধ করতে পারলেও কিছুদিন পরে ব্যবসায় লোকসান হয় তার। অসহায় হয়ে পড়েন সৈকত। বাড়িতে বয়স্ক বাবা-মা তার। একসময় লোনের টাকা আর পরিশোধ করতে পারছিলেন না তিনি। একপর্যায়ে মামলা হয় তার নামে। 

সৈকত বলেন, পড়াশোনা শেষ করে ইচ্ছে ছিল চাকরি করবো। কিন্তু ভালো কোনো চাকরি না পেয়ে ব্যবসা শুরু করি। ব্যবসার জন্য কিছু টাকা ধার-দেনা করি। এদিকে অন্য বন্ধুরাও আমার কাছ থেকে বেশকিছু টাকা ধার নেয়। সব মিলিয়ে ভালোই যাচ্ছিল। হঠাৎ বন্ধুরা আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে অনেকে গা-ঢাকা দেয়। এদিকে আমার ব্যবসায় যা আয় হয় তা দিয়ে দেনা পরিশোধ করতে থাকি। একসময় ব্যবসা নষ্ট হয়ে যায়। টাকা দিতে না পারায় আমার নামে মামলা হয়। পুলিশ আমার বাড়ি এসে হয়রানি করতে থাকে। এক সময় আমি চলে আসি ঢাকায়। এখানে এসেও সবসময় আতঙ্ক ভর করে। শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলেও ভালো কোনো চাকরিতে এপ্লাই করতে পারছি না। বাড়িতেও বাবা-মাকে দেখতে যেতে পারি না।   

নিলক্ষেত মোড়ে রিকশায় যাত্রীর অপেক্ষায় ছিলেন হাবিবুর রহমান। তিনি লালমনিরহাট থেকে এসেছেন। হাবিবুর বলেন, ২৭-২৮ বছর ধরে ঢাকায় রিকশা চালাই। দেশে কোনো জমিজমা নেই। পরের জমিতে কাজ করে আর সংসার চালানো যায় না। যে বাড়ির জায়গা আছে এই রিকশা চালিয়ে তা দিয়ে জমি কিনে একটা বাড়ি করেছি। ৪ সন্তান আমার। এখন যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালানো খুব কষ্টের। মাসে ১৩-১৪ হাজার টাকা হয়। বাড়িতে খরচ পাঠাতে হয়। নিজের খরচ আছে। গ্রামে কৃষি কাজ সবসময়ও থাকে না। পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকলে আরও যন্ত্রণা বেড়ে যাবে। আয়ের সঙ্গে ব্যয় মেলাতে হিমশিম খেতে হবে।  

৩ মাস আগে জামালপুর থেকে ঢাকায় এসেছেন রহিম মোল্লা। তিনি হেঁটে হেঁটে পান সিগারেট বিক্রি করেন। রহিম বলেন, গ্রামে একটি মুদি দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করতাম। ৫ মাস আগে দোকানের মালিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর  তিনি দোকান বন্ধ করে দেন। আমিও বেকার হয়ে পড়ি। গ্রামে অন্য কোনো কাজ তেমন পাওয়া যায়নি। এলাকার এক চাচার পরামর্শে ঢাকায় চলে আসি। এখানে এসে হেঁটে হেঁটে পান সিগারেট বিক্রি করি। মোটামুটি ভালো আয় হয়। বাড়িতে বাবা-মাকে টাকা পাঠানো লাগে।

জামাল হোসেন বলেন, রংপুরে আমাদের বাড়ি। ২০০৬ সাল থেকে ঢাকায় রিকশা চালাই। যখন ফসল থাকে তখন কাজের জন্য গ্রামে চলে যাই। এক সপ্তাহ পরেই ধান লাগানোর জন্য জমি ঠিক করতে যাবো। বাড়িতে বউ-বাচ্চা রয়েছে। তাদের খরচ পরের জমি চাষ করে চালানো সম্ভব হয় না। এখন বয়স হয়েছে। আরও কিছুদিন রিকশা চালিয়ে বাড়িতে চলে যাবো। সেখানে গিয়ে গরু পালবো। এই গরু কিনতেও অনেক টাকার প্রয়োজন।

ফুটপাথে পলিথিনের ছাউনি দিয়ে ছোট ঘর করে থাকেন রাবেয়া ও তার স্বামী। তিনি বলেন, এক বছর ধরে ঢাকায় থাকি। পটুয়াখালী আমাদের বাড়ি। গ্রামে ঘরবাড়ি কিছু নেই। সব নদীতে ভেঙে নিয়ে গেছে। গ্রামে কাজেরও কিছু নেই। আমাদের তো বাঁচতে হবে। ঢাকায় এসে আমি ও আমার স্বামী যখন যেটা পাচ্ছি তখন সেটা করছি। দিনে মোটামুটি যা আয় হয় তা দিয়ে খাবার খরচটা হয়ে যাচ্ছে। এভাবে কিছুদিন পর পর ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে থাকি।

গুলিস্তানে ফুটপাথে ফল বিক্রি করেন আসিফ। তিনি বলেন, গ্রামে তেমন কোনো কাজ পাওয়া যায় না। সেজন্য ঢাকায় এসেছি। এখানে এসে ফল বিক্রি করি। আগে একটি জুতার দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করতাম। সেখানে তেমন আয় হতো না। এখন মোটামুটি ভালো আয় হচ্ছে। প্রতিদিন ১ হাজার টাকা লাভ থাকে। মাঝে মাঝে গ্রামে গিয়ে কৃষিকাজও করি। বাড়িতে বাবা-মা ও ছোট ১ ভাই আছে। বাবার বয়স হওয়ায় সংসারের খরচটা আমাকেই চালাতে হয়।

ছোট্ট শিশু রাকিব। ঘুরে ঘুরে পানি বিক্রি করে। রাকিবের মা ফুল বিক্রি করেন। দুইজনের আয়ের টাকা দিয়ে চলে তাদের সংসার। রাকিব বলে, আমি ঘুরে ঘুরে পানি বিক্রি করি। আমাদের বাড়ি নেত্রকোনা। বাবা আরেকটি বিয়ে করায় মা আমাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। গ্রামে একটি ঘর ছাড়া কিছুই নেই আমাদের। মা ফুল বিক্রি করার পাশাপাশি বাসাবাড়িতেও কাজ করেন। আমাদের দুইজনের টাকায় কোনোমতে সংসার চলে। গ্রামে থাকলে তো না খেয়ে থাকতে হতো। বাবাও আমাদের খোঁজ রাখেন না।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status