ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

রেকর্ডের বাইরে বহু অপরাধ

মরিয়ম চম্পা
২৩ জানুয়ারি ২০২৩, সোমবার
mzamin

রাজধানীর দারুস সালাম সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আহনাফ রহমান। গত বছরের ৩১শে আগস্ট বিকালে বাসা থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি। এ ঘটনায় নিখোঁজ শিক্ষার্থীর মা দারুসসালাম থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। একাধিক বাহিনী ছায়া তদন্ত শুরু করে। কিন্তু নিখোঁজের প্রায় ৫ মাস অতিবাহিত হলেও   আহনাফের সন্ধান দিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ঘটনায় নিখোঁজ শিক্ষার্থীর পরিবার থানায় কোনো মামলা করেননি। থানায় কেন মামলা করেননি জানতে চেয়ে মানবজমিনের সঙ্গে কথা হয় শিক্ষার্থী আহনাফের বাবার। ব্যবসায়ী এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতা আহনাফের বাবা আতাউর রহমান বলেন, সংশ্লিষ্ট থানার তদন্ত কর্মকর্তা এবং পুলিশের ওপর ভরসা নেই আমাদের। তাদের ওপর ভারসা করতে পারি না। যে কারণে ঘটনার ৫ মাস অতিবাহিত হলেও আমরা স্থানীয় থানায় মামলা করিনি।

বিজ্ঞাপন
আগামী সপ্তাহে আদালতে মামলা করবো। আদালতের প্রতি আস্থা রয়েছে। দারুসসালাম থানার উপ-পরিদর্শক (এস আই) আবু জাফর বলেন, থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন তার পরিবার। নিখোঁজ শিক্ষার্থীর পরিবার এ ঘটনায় কোনো মামলা করেননি। কেন করেননি এটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। 

এমন অনেক ঘটনার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা থানায় যাচ্ছেন কম। এতে মামলার রেকর্ড হচ্ছে কম। এর মানে অপরাধ কমে গেছে এমনটা বলা যাবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া পুলিশের সমন্বিত তথ্য বলছে অপরাধ সংক্রান্ত মামলা বাড়ছে। 
গত বছরের ২২শে সেপ্টেম্বর রাজধানীর শাহ আলী থানাধীন এলাকায় মেহেদী হাসান নামের এক যুবককে ছুরিকাঘাত করে গুরুতর আহত করে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। দীর্ঘদিন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মেহেদীর বাবা রাফিউল ইসলাম হামলাকারী শহীদুল ইসলামসহ অন্যদের বিরুদ্ধে শাহ আলী থানায় হত্যাচেষ্টার মামলা করতে গেলে কয়েক দিন ঘুরিয়ে পুলিশ আর মামলা নেয়নি। পরে থানা-পুলিশের চাপের মুখে তিনি হামলাকারীদের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঘটনার তদন্তকারী শাহ আলী থানার এসআই রবিউল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আসামিরা পলাতক ছিল। আমি বিষয়টি সরাসরি তদন্ত করিনি। পরবর্তীতে শুনেছি ভুক্তভোগী এবং অভিযুক্ত উভয়পক্ষ ঘটনাটি ব্যক্তিগতভাবে আপস মীমাংসা করে নিয়েছে। পুলিশের চাপে ভুক্তভোগীর পরিবার সন্ত্রাসীদের সঙ্গে মীমাংসা করতে বাধ্য হয়েছেন এমন অভিযোগের বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি সত্য নয়। এরকম কোনো চাপ প্রয়োগের ঘটনা থাকলে তারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কিংবা ঊর্ধ্বতন পুলিশের কারও কাছে অভিযোগ করতে পারতেন। সেটা তারা কেন করেননি? 

গত নভেম্বর মাসের শেষের দিকে ঢাকার আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানা থেকে ঝুট ক্রয় করে নামিয়ে আনার সময় ঝুট ব্যবসায়ী এমদাদুল ইসলামকে মারধর করে আহত করে স্থানীয় চিহ্নিত কিছু সন্ত্রাসী। এমদাদুল ওই ঘটনায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা না নিলে এমদাদুল এ ঘটনায় র‍্যাব-৪ এর কাছে লিখিত অভিযোগ করেন।
রাজধানীর হাতিরঝিল থানাধীন পশ্চিম রামপুরা এলাকায় বাস করেন সংগীতশিল্পী মার্শিয়া লিলি। বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপিতে চাকরির সুবাদে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পেয়েছেন সম্মাননাসূচক ক্রেস্ট। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে তার বাসা থেকে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ক্রেস্ট, টাকা, মোবাইল ফোন ও স্বর্ণালঙ্কারসহ মূল্যবান অনেক জিনিসপত্র চুরি হয়ে যায়। তার ঠিক এক সপ্তাহ পর আবারো তার বাসায় চুরির ঘটনা ঘটে। একইভাবে ২০২১ সালের মার্চ মাসে তার বাসা থেকে একটি মোবাইল ও টাকা পয়সা চুরি হয়। সর্বশেষ গত বছরের ১লা আগস্ট রাত সাড়ে ১০টার দিকে বাসার জানালা দিয়ে তার ব্যবহৃত একটি মোবাইল ফোন চুরি হয়। এ ঘটনা লিলি হাতিরঝিল থানায় অভিযোগ জানালে গত বছরের ২রা আগস্ট মোবাইল হারানো মর্মে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি নম্বর ১০০) নেয় পুলিশ। ঘটনার দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও কোনো তদন্ত করেনি পুলিশ। ভুক্তভোগী সংগীতশিল্পী লিলি জানান, গত ১২ বছরে একই বাসায় ৭ বার চুরির ঘটনা ঘটেছে। থানায় এসব ঘটনার কথা জানালে পুলিশ মোবাইল হারানো জিডি নিয়েছে। একটি ঘটনারও তদন্ত বা চোরদের ধরতে পুলিশ কোনো অভিযান কিংবা চুরি যাওয়া মালামালও উদ্ধার করতে পারেনি। 

এদিকে রাজধানীতে সত্যিই কি অপরাধের পরিমাণ কমেছে নাকি থানাগুলোতে মামলা রেকর্ড হয় না এ বিষয়ে জানতে সরজমিন একাধিক থানা ঘুরে দেখা গেছে, ভিন্নচিত্র। সংশ্লিষ্ট থানাগুলো জানায়, মহানগরীতে আগের তুলনায় অপরাধ অনেক কমেছে। সে হিসেবে মামলাও কম রেকর্ড হচ্ছে। কিন্তু গত এক বছরের মোট মামলার পরিসংখ্যান বলে রাজধানীতে অপরাধ বেড়েছে। যাত্রাবাড়ী থানায় গত বছরের নভেম্বর মাসে মোট ১০৭টি, ডিসেম্বর মাসে ৮৪টি এবং চলতি বছরের গত ১৯শে জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ৬২টি মামলা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে বেশির ভাগই মারামারি, চুরি, ছিনতাই, সংঘর্ষ এবং ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব সংক্রান্ত। এ বিষয়ে যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম বলেন, আগের তুলনায় অপরাধ কিছুটা কমেছে। সে হিসেবে থানায় মামলাও কম রেকর্ড হচ্ছে। তেজগাঁও থানায় গত বছরের অক্টোবর মাসে ৭১টি, নভেম্বর মাসে ৬১টি, ডিসেম্বর মাসে ৪২টি এবং চলতি বছরের গত ১৮ই জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ২২টি মামলা হয়েছে। যার অধিকাংশই নারী-শিশু, মাদক এবং সংঘর্ষের ঘটনা সংক্রান্ত। মিরপুর মডেল থানায় গত বছরের নভেম্বর মাসে ৬৪টি, ডিসেম্বর মাসে ৪০টি এবং চলতি বছরের ১৯শে জানুয়ারি পর্যন্ত ৪১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সংঘর্ষ এবং মাদকের মামলা বেশি। খিলগাঁও থানায় গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ৪৩টি এবং চলতি বছরের গত ১৮ই জানুয়ারি পর্যন্ত ৩১টি মামলা হয়েছে। সবচেয়ে কম মামলা হয়েছে কলাবাগান থানায়। এখানে গত বছরের নভেম্বর মাসে ১৬টি মামলা, ডিসেম্বরে ১০টি এবং চলতি বছরের গত ১৮ই জানুয়ারি মোট ৭টি মামলা হয়েছে। অপরাধ কমেছে না কি থানায় মামলা রেকর্ড হচ্ছে নাÑ জানতে চাইলে তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অপূর্ব হাসান বলেন, অপরাধের পরিমাণ কমেছে। সে হিসেবে মামলাও কম রেকর্ড হচ্ছে। আবার কখনো বাদীরা সরাসরি থানায় মামলা না করে আদালতে মামলা করেন অনেকে। আদালতে হওয়া মামলার রেকর্ড থানায় থাকে না। 

রাজধানীর থানাগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রাজধানীতে বিগত বছরগুলোর তুলনায় অপরাধ বেড়েছে। বেশি বেড়েছে খুন, চুরি, ডাকাতি, দস্যুতা ও মাদকসংক্রান্ত অপরাধ। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মামলার সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রাজধানীতে ২০২২ সালে বিভিন্ন অপরাধে মামলা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৪৯টি। যা আগের বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। এই বছরে বিভিন্ন অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৬১ হাজার ৪৯৪ জন। যেটা আগের বছর ছিল ৫০ হাজারের মতো। ২০২২ সালে খুন হয়েছেন ১৭৩ জন। ২০২১ সালে সংখ্যাটি ছিল ১৫২। চুরির ঘটনায় মামলার সংখ্যা বেড়েছে ২৮ শতাংশ। ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১০৩টি। দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে ১৪৫টি, আগের বছর দস্যুতার ঘটনা ছিল ১৩৪টি। এদিকে গত বছর রাজধানীর সবচেয়ে বেশি খুনের তালিকার প্রথমে রয়েছে ওয়ারী এরপর মিরপুর থানা। রাজধানীর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ৫০টি থানাকে রমনা, লালবাগ, ওয়ারী, মতিঝিল, তেজগাঁও, মিরপুর, গুলশান ও উত্তরা এই ৮টি অপরাধ বিভাগে ভাগ করে কাজ করে ডিএমপি। আট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে ওয়ারীতে। সংখ্যাগতভাবে এই বিভাগে মোট খুন হয়েছে ৩৭টি। এ ছাড়া মিরপুরে ৩১টি, গুলশান ও মতিঝিলে ২১টি করে, উত্তরা ও লালবাগে ১৭টি করে, রমনায় ১৬টি এবং তেজগাঁও বিভাগে ১৩টি খুনের ঘটনা ঘটে। এর আগের বছরগুলোতে ওয়ারী বিভাগ ও মিরপুরে খুনের ঘটনা বেশি ঘটে। ডিএমপি’র দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব এলাকায় ভাসমান মানুষ বেশি বাস করে এবং ঘনবসতিপূর্ণ, সেসব এলাকায় খুনের ঘটনা বেশি ঘটে। ওয়ারী বিভাগের মধ্যে রয়েছে ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, গে-ারিয়া, কদমতলী ও ওয়ারী থানা। এ ছাড়া ২০২২ সালে ঢাকায় রাজনৈতিক খুনের ঘটনা ঘটেছে তিনটি মতিঝিল, ওয়ারী ও গুলশানে। আগের বছর কোনো রাজনৈতিক খুনের ঘটনা ঘটেনি। গত বছর সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে মাদকসংশ্লিষ্ট অপরাধে। ২০২২ সালে মাদকের মামলা হয়েছে ১৬ হাজার ৩৫টি। যা মোট মামলার ৫৬ শতাংশ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা থানায় মামলার ঝক্কিতে যেতে চান না। ফলে মামলার সংখ্যা দিয়ে প্রকৃত চিত্র বোঝা যায় না। অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালী, রাজনীতিবিদ ব্যক্তিদের তদবির ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের অভিযোগ সহজেই মামলা হিসেবে রেকর্ড করে সংশ্লিষ্ট থানা-পুলিশ। তবে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অথবা সাধারণ মানুষ, গরিব, অসহায় ব্যক্তিরা মামলা করতে গেলে পুলিশ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মামলা না নিয়ে থানায় বসে মীমাংসা কিংবা ফেরত পাঠায় তাদের। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মহানগরীর কোনো থানা এলাকায় ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, খুন এবং অপহরণের মতো অপরাধ বেড়ে গেলে সেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে দেখাতে থানা-পুলিশ এসব ক্ষেত্রে কম মামলা নিয়ে থাকে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপ-কমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেন, পরিসংখ্যান অনুযায়ী মামলার সংখ্যা বেশি। সে হিসেবে অপরাধ কিছুটা বেড়েছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ডিএমপি পুলিশ প্রতিটি থানাভিত্তিক পৃথকভাবে কাজ করছে। মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তবে কোনো ভুক্তভোগী তার এলাকাধীন থানায় গেলে মামলা বা জিডি নিতে থানার ওসিদের প্রতি ডিএমপির সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। প্রকৃত ঘটনা বা অপরাধের বিষয়ে থানা পুলিশ মামলা না নিলে সংশ্লিষ্ট থানার কর্মকর্তাকে আইনের মুখোমুখি করা এবং জবাবদিহিতার আওতায় আনার ব্যবস্থা রয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

 

 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status