ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

বাড়ছে সাইবার অপরাধ

আলোচনায় সাইবার পুলিশ ইউনিট

শুভ্র দেব
২৩ জানুয়ারি ২০২৩, সোমবার
mzamin

সর্বত্রই হানা দিচ্ছে সাইবার সন্ত্রাসীরা। অনলাইন প্ল্যাটফরম যারাই ব্যবহার করছেন তারা সাইবার অপরাধীদের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। সময় যত  যাচ্ছে এ অপরাধের মাত্রা বাড়ছে। বুঝে না বুঝে মানুষ সাইবার অপরাধে জড়াচ্ছে। অনেকে আবার এই অপরাধে দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। চ্যালেঞ্জ করে যে কারো অনলাইন অ্যাকাউন্ট বা সাইট হ্যাক করছে হ্যাকাররা। এ ছাড়া রাষ্ট্রবিরোধী অপ-প্রচারণা, গুজব, হ্যাকিং, অনলাইন ব্যবসার নামে প্রতারণা, পর্নোগ্রাফি এখন হরহামেশাই হচ্ছে। 

সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাইবার অপরাধ যেভাবে বাড়ছে মামলা, ভুক্তভোগী, গ্রেপ্তারের সংখ্যা বাড়ছে। গতানুগতিক অপরাধ ছেড়ে এখন সাইবার অপরাধের দিকে ঝুঁকছে অপরাধীরা। তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার পরও নতুন নতুন অপরাধীর সৃষ্টি হচ্ছে। এতে করে এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা এখন অনেকটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ প্রযুক্তি ছোঁয়া এখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে পৌঁছেছে। সবার হাতে হাতে এখন স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ। তাই অনলাইন ব্যবহার করে মানুষ এখন হারিয়ে যাচ্ছে এক জগৎ থেকে আরেক জগতে। থানা পুলিশেরও অন্য অপরাধ সামলাতে গিয়ে সাইবার অপরাধ নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। 

পুলিশের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে দেশে ২৬৭টি সাইবার অপরাধ সংঘটিত হয়। পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭১টিতে। ২০১৭ সালে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে অন্তত ১৩শ’ সাইবার অপরাধ সংঘটিত হয়। ২০১৭ সালের পর থেকে বিগত বছরগুলোতে এই অপরাধের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে বহুগুণ। এ ছাড়া জঙ্গিদের মধ্যে অন্তত ৮২ ভাগ তরুণ অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অন্ধকার পথে গেছে, যা সাইবার অপরাধের ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত। এসব অপরাধ ঠেকাতে সাইবার পুলিশের বিকল্প নেই। শুধু জঙ্গিবাদ নয়, আর্থিক অপরাধ, প্রতারণা, নারীদের সম্মানহানি, সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছড়িয়ে দেশকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়ার ক্ষেত্রেও সাইবার স্পেস ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব বিষয়ও দেখবে সাইবার পুলিশ ইউনিট।  

আশঙ্কাজনকভাবে সাইবার অপরাধ বাড়লেও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্যবস্থা সেভাবে নেয়া হয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতেও সাইবার ক্রাইম নিয়ে কাজ করার জন্য বিশেষ কোনো ইউনিট নাই। শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরভিত্তিক কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট, মহানগর গোয়েন্দা সংস্থা (ডিবি), র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) থেকে ছোট পরিসরে কিছু কর্মকর্তা দিয়ে সাইবার অপরাধের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। যেসব কর্মকর্তা দিয়ে এই কার্যক্রম চালানো হচ্ছে তাদেরকেও সাইবার অপরাধের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে না। আছে জনবলের অভাব। ঢাকা মহানগর এলাকার বাসিন্দারা এসব ইউনিট থেকে সেবা নিতে পারলেও বিভাগীয়, জেলা ও থানা এলাকার মানুষ এই সেবা থেকে বঞ্চিত। জেলা পর্যায়ে সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করার জন্য আলাদা কর্মকর্তা বা অফিস নাই। তাই জেলার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা সাইবার অপরাধের শিকার হলেও সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এতে করে সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে পুলিশের আলাদা সাইবার ইউনিট গঠন করা। 

গত কয়েক মাস ধরে পুলিশের সাইবার ইউনিট গঠন নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কার্যত বেশ আলোচনা শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে আলোচনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে গড়িয়েছে। বিগত কয়েকটি বৈঠকে কমিটির অনেক সদস্যরা সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আলাদা ইউনিট গঠনের বিষয়ে জোর দিয়েছেন। ২৪তম বৈঠকে কমিটির সদস্য ও সুনামগঞ্জ-৪ আসনের এমপি পীর ফজলুর রহমান তার আলোচনায় বলেন, অনলাইনে দেশবিরোধী নানান ধরনের প্রচারণা এবং অনলাইন জুয়া বৃদ্ধি পাওয়ায় পুলিশের সাইবার ইউনিট গঠন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে সাইবার ইউনিট গঠনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। 

বৈঠকে পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, দেশে পুলিশের অনেক বিশেষায়িত ইউনিট থাকলেও সাইবার নিয়ে কাজ করার জন্য পুলিশের কোনো বিশেষায়িত ইউনিট নাই। সিআইডি ও পুলিশের অন্য ছোট ছোট ইউনিটের মাধ্যমে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। তবে বর্তমানে অনলাইন জুয়া, সাইবার ক্রাইম বৃদ্ধি পাওয়ার একটি বিশেষায়িত ইউনিট গঠন করা সময়ের দাবি। কমিটির সভাপতি ও ঢাকা-২০ আসনের এমপি বেনজির আহমেদ পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট গঠন করা সময়ের দাবি উল্লেখ করে ইউনিট গঠনের জন্য পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বৈঠকে জরুরি ভিত্তিতে আলাদা ইউনিট গঠনের জন্য কার্যক্রম শুরু করার সুপারিশ করা হয়। 

পুলিশ সপ্তাহ-২০২৩ উপলক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের মতবিনিময়ে উঠে এসেছে সাইবার ইউনিট গঠন। 
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগসূত্রে জানা গেছে, পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট গঠনের জন্য গত ৯ই সেপ্টেম্বর জননিরাপত্তা বিভাগে একটি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রস্তাব পাঠানোর জন্য পুলিশ অধিদপ্তরে চিঠি দেয়া হয়েছে। পুলিশ অধিদপ্তর থেকে ইতিমধ্যে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে জননিরাপত্তা বিভাগে। সেখানে বলা হয়েছে  ইউনিটটির নাম হবে সাইবার পুলিশ ইউনিট। এ ইউনিটটি গঠন করার জন্য ২ হাজার ১২১ জনবলের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ইউনিটের প্রধান হবেন একজন ডিআইজি পদমর্যাদার কর্মকর্তা। ইউনিটের হেড অফিস হবে ঢাকায়। তবে দেশের প্রতিটি জেলায় সাইবার ইউনিটের অফিস থাকবে। 
পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তারা বলেছেন, পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশনের আদলেই পুলিশ সাইবার ইউনিট গঠন করা হবে। প্রস্তাবনায় ইউনিট প্রধান হিসেবে ডিআইজি পদ মর্যাদার কর্মকর্তার কথা বলা হলেও ইউনিট প্রধান হিসেবে একজন অতিরিক্ত আইজিপি’র বিষয়টিও আলোচনায় আছে। ইউনিটটি বিদ্যমান পুলিশ কাঠামোয় থেকে স্বতন্ত্র ও বিশেষায়িত ইউনিট হিসেবে কাজ করবে। একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে¡ দু’জন এএসপি, চারজন ইন্সপেক্টর, আটজন এস আই, ১৬ জন এএসআই এবং এর সঙ্গে সাপোর্টিং ফোর্স নিয়ে জেলার অফিস গঠন করা হবে। 

পুলিশ ও সাইবার ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দায়ের করা মামলার ৯০ ভাগই ওই আইনের ৫৭ ধারায় হয়ে থাকে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে আপত্তিকর মন্তব্য প্রচার, অনলাইনে মানহানিকর সংবাদ প্রচারের অভিযোগেও ৫৭ ধারায় মামলা হচ্ছে। পাশাপাশি হ্যাকিং ও অনলাইনে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে এ আইনের ৫৫ ও ৫৬ ধারায় মামলা হয়ে থাকে। 
সাইবার অপরাধকে বিচারের আওতায় আনতে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সরকার। প্রথম বছরে ট্রাইব্যুনালে তিনটি মামলা ছিল। ২০১৪ সালে ৩২টি, ২০১৫ সালে ১৫২টি, ২০১৬ সালে ২৩৩টি মামলা ট্রাইব্যুনালে আসে। ২০১৭ সাল থেকে এ সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। সূত্র আরও জানায়, এ অপরাধের শিকার মাত্র ৩০ শতাংশ মানুষ মামলার আশ্রয় নেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা মামলা করতে অনীহা প্রকাশ করেন। এক জরিপে বলা হয়, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নারীর মধ্যে ৭৭ শতাংশই ফেসবুককেন্দ্রিক সাইবার অপরাধের শিকার। 

সিটি সাইবার, ডিবি সাইবার ও র‌্যাবের সাইবার ইউনিটের কয়েক বছরের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় এই তিনটি ইউনিটের সাইবার ইউনিটের যাত্রার পর থেকে এখন পর্যন্ত মামলা হয়েছে ১৩২৭টি। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৭৫৯ জন সাইবার সন্ত্রাসীকে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের (দক্ষিণ) উপ-কমিশনার (ডিসি) ইকবাল হোসাইন বলেন, সাইবার পুলিশ ইউনিট হলে অধিক ও প্রশিক্ষিত জনবল দিয়ে সাইবার অপরাধ দমন করা সহজ হবে। পরিসংখ্যানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাইবার অপরাধ কমতির দিকে নেই। প্রতি বছর সাইবার অপরাধের মাত্রা বেড়েই চলছে। এখন অনলাইন কেন্দ্রিক প্রতারণা, মোবাইল ব্যাংকিং, হ্যাকিং, পাসওয়ার্ড হ্যাক ইত্যাদি বৃদ্ধি পাচ্ছে। নরমাল অপরাধ কমে যাচ্ছে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের ডিআইজি কুসুম দেওয়ান বলেন, পুলিশের সাইবার ইউনিট গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনেক। ঢাকায়, সিআইডি, ডিবি, র‌্যাব ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সাইবার নিয়ে কাজ করার জন্য আলাদা টিম আছে। কিন্তু ঢাকার বাইরে যারা সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন তারা সেভাবে সেবা পাচ্ছেন না। জেলায় অনেক সাইবার অপরাধ হয় কিন্তু অন্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে থানা পুলিশের পক্ষে সাইবার নিয়ে কাজ করা সম্ভব হয় না। যদি পুলিশের সাইবার ইউনিট হয় তাহলে ঢাকার বাইরে থেকেও সেবা নেয়া ও দেয়া যাবে।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status