ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

আলেহার ১০ বছরের সঞ্চয় নিলো কে?

ইমরান আলী
২২ জানুয়ারি ২০২৩, রবিবার
mzamin

কয়েকটা শুঁটকি মাছ, তেজপাতা আর কিছু শুকনা মরিচ। সঙ্গে দু’ একটা অর্ধপচা আলু ও   গাজর। সামনে নিয়ে বসে আছেন এক বৃদ্ধা। মাথার চুল পুরো পাকা। দাঁত নেই  বললেই চলে। কী করেন? হাসতে হাসতে বললেন, শুনতে পাই না। জোরে বলেন। ফের প্রশ্ন করলে কিছুটা লজ্জা পান। কিছু করি না।  যা পাই বিক্রি করি। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া এই নারী কিছুটা তোতলানো স্বরে জানালেন তার নাম আলেহা খাতুন। 
আলেহা খাতুনের সঙ্গে দেখা শনিবার দুপুরে কাওরান বাজার ২নং সুপার মার্কেটের সামনে। 
এই কাজ কতোদিন ধরে করেন? তার উত্তর দেয়ার আগেই পাশের এক ব্যবসায়ী জানালেন- অনেকদিন হলো।

বিজ্ঞাপন
এইসব কি আর মানুষ কিনে? তাও দিনে যা হয়, তাই দিয়ে চলেন। কখনো কেউ কিছু দিলে নেন। আমরাও তাকে এখানে বসতে দেই। এই বয়সে কই যাবে আর সে।

আলেহা খাতুন বললেন, চলি কোনো রকম। রান্না করতে পারি না। দিন শেষে আয় হয় দেড় থেকে দুইশ’ টাকার মতো। 
ঢাকায় কবে আসা? সেই যুদ্ধের সময়।  যুদ্ধ দেখছি। সেই সময় আমার আব্বা আমারে ধানমণ্ডি এক বাসায় কাজে দেন। সেই বাসায় অনেকদিন কাজ করেছি। আমারে এক কাজ দুইবার করে করতে বলতো তারা। ধমক দিতো। মারধর করতো। পরে সেই কাজ ছেড়ে দিলাম। 

নেত্রকোনার কলমাকান্দার নাজিরপুর  বাড়ি আমাদের। ঢাকা থেকে গ্রামে গেলাম।  আব্বা আমারে বিয়ে দিলো। আমি একটাই মাইয়া। আমার স্বামীরে ঘরজামাই রাখলো। একদিন কিছু লোক এসে ডেকে নিয়ে গেল। এরপর তার আর খোঁজ নাই অনেকদিন। পরে শুনছি  অসুখে মারা গেছে। আমারে নাকি অনেকবার দেখতে চাইছিল।  
আলেহা খাতুনের শ্বশুরবাড়ি লক্ষ্মীপুর। দেবর আর তার স্ত্রী’র বকাঝকার  কারণে শ্বশুরবাড়িতে তার আর যাওয়া হয়নি। 
আলেহা বললেন, মা আমারে খুব আদর করতো। কিন্তু চলি কী করে। ঢাকায় আবার আসলাম। কাওরান বাজারে এই দোকানে, ঐ দোকানে কাজ করি। কেউ টাকা দেয়, কেউ দেয় না। পরে কাজ ছেড়ে এগুলো বেচা ধরি। 

 

 

আলেহা খাতুনের বড় মেয়ে মারা গেছে ছোটবেলায়। বাকি দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। একটার টঙ্গীতে, আরেকটার নিজ গ্রামেই। একটাই ছেলে।  কলমাকান্দায় চায়ের দোকান দিয়েছে সে। মেয়েরা কেমন আছে, তা জানেন না আলেহা খাতুন। 
বললেন, আমার নিজের কোনো জমি নাই। অল্প একটু পাইছিলাম, ছেলে নিয়ে নিছে আমার টিপসই দিয়ে। আমার টাকা দিয়ে ঘর বানাইছে সে। কেউ আর দেখে না আমারে। তাদের ঘর হলো, আমার হলো না। থাকি কাওরান বাজারের কাঠপট্টির এক দোকানের বারান্দায়। ভাড়া লাগে না। দশ বছর ধরে পঁচিশ হাজার টাকা গোছাইছিলাম। ভাবছিলাম গ্রামে  যাবো। কিন্তু কয়েকদিন আগে চোর আমার জামাকাপড়ের বস্তাসহ সব টাকা নিয়ে গেল। 

আলেহা খাতুন কথাগুলো বলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।  বললেন, একটা ছবি তুলেন দেখি! তিনি তার নিজের ছবি দেখে হাসলেন। বললেন, কতো আদর করতো আব্বা-আম্মা আমারে। আর এখন নিজের ছেলেমেয়েরাই দেখে না। কই খাই, কী অবস্থায় আছি! 
আলেহা খাতুনের সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় এগিয়ে এলেন কয়েকজন সবজি ব্যবসায়ী। বললেন, আমরা মাঝে মাঝে দু’চারটা সবজি দেই। সেগুলো বিক্রি করেন। তবে টাকার হিসাব আর মেলাতে পারেন না। বয়স হইছে। অসুখ বিসুখে দেখার কেউ নেই।  এবার আলেহা খাতুন নিজেই প্রশ্ন করলেন আমার একশ’ বছর হইছে না? 
আলেহার সামনে কয়েকটা দশ টাকার নোট পড়ে থাকতে দেখা গেল। দেখিয়ে দিলে বললেন, এগুলো যার যখন মন চায় দিয়ে যায়। ময়লার মধ্যে থাকা নোটগুলো তিনি মুছে আঁচলে গুজলেন।

শেষ জীবনের ইচ্ছা কী? বললেন, মানুষের তো কতো ইচ্ছাই থাকে। কারও কাছ থেকে একটা ঘর পাইনি, ভাতাও পাইনি।  অনেকদিন আগে ঢাকায় এক নেতার লগে দেখা করতে গেছিলাম সাহায্যের জন্য। পুলিশ তাড়িয়ে দিলো। এরপর আর কারও কাছে যাই না। আমার কোনো দুঃখ নাই, কিন্তু... 
আলেহা খাতুনের কথাটা স্পষ্ট বোঝা গেল না। বড্ড ক্লান্ত। এই প্রতিবেদকের চলে আসার সময় নিঃসঙ্গ, একাকিত্বে ভোগা আলেহা খাতুন বললেন, আমার সঙ্গে আর একটু গল্প করবেন?    

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status