শেষের পাতা
একটি আংটিতে তিন বিয়ে, প্রতারণার ভিন্ন কৌশল
ইমরান হোসাইন, জাবি থেকে
২০ জানুয়ারি ২০২৩, শুক্রবারতিন বছরের ব্যবধানে করেছেন তিনটি বিয়ে, সবাইকে দিয়েছেন তালাক। এখন চতুর্থ বিয়ের জন্য আংটি পরিয়ে রেখেছেন আরেক মেয়েকে। আগের বিয়ের তথ্য গোপন করে করেছেন একের পর এক বিয়ে। তবে এবার ধরা পড়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ ২৬ বছর বয়সী ওই ছেলের বিয়ের নামে প্রতারণা ও অন্যান্য অনৈতিক বিষয় এখন আলোচনায়। প্রথম বিয়ের আংটি দিয়েই সেরেছেন তিনটি বিয়ের এনগেজমেন্ট। ‘ময়না;, ‘জানপাখি’, ‘তোমাকে না পেলে আমি বিষ খাবো’- এসব তার কমন ডায়ালগ। এছাড়া টিউশনির নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছুদের নানা কৌশলে ফুসলিয়ে এবং ফাঁসিয়ে প্রতারণা ও অর্থ হাতিয়ে নেয়ারও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত ছেলের নাম রাশেদুল ইসলাম ওরফে আদেশ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী তিনি।
ফেসবুকে পোস্টদাতা শিক্ষার্থী মানবজমিনকে বলেন, ‘একটা মানুষকে কতবার না করা যায় বলুন? দিনের পর দিন একটা ছেলে পিছে ঘুরঘুর করছে। যদিও সে আমার ৫ ব্যাচ জুনিয়র। একটা পর্যায়ে মন নরম হয়েই যায়। এরপর পারিবারিকভাবে আমাদের এনগেজমেন্টও হয়। সামনের মার্চ মাসে আমাদের বিয়ে হওয়ার কথাও ছিল। আমি তার জন্মদিন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছি। এনগেজমেন্ট হওয়ার পর সে আমার কাছে একটি আইফোন চায়। এর মাঝে বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ক ও ব্যবসার নাম করে আমার কাছ থেকে ২ লাখ টাকা নেয়। পরে জানতে পারি তার আগে আরও তিনটা বিয়ে হয়েছে। আমি ছাড়াও আরও একটি মেয়েকেও বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। ব্যবসার নাম করে আমার কাছ থেকে নেয়া টাকা দিয়ে একজন স্ত্রীকে তালাক দিয়েছে। সামনে মাসে বিয়ের বিষয়ে পরিবারকে কী বলবো এখন?’
এদিকে রাশেদুলের কাছে প্রাইভেট পড়া এক বান্ধবীর মাধ্যমে পরিচয় হয় সিনথিয়ার (ছদ্মনাম) নামের এজনের সঙ্গে। প্রেম করতে অস্বীকৃতি জানান তিনিও। নানাভাবে প্রেম ও বিয়ের প্রস্তাব দিতে থাকে রাশেদুল। এক পর্যায়ে ‘তোমাকে না পেলে আত্মহত্যা করবো’Ñ এই ভয় দেখালে সিনথিয়া পড়েন বিপাকে। প্রেম নয়, পরিবার রাজি হলে সরাসরি বিয়ের কথা বলেন সিনথিয়া। পরিবারের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে বলেন ওই নারী। পরিচয়ের মাত্র একমাসের মাথায় রাশেদুলের জোরাজুরিতে পারিবারিকভাবে ২০২১ সালের ২০শে আগস্ট বিয়ে হয় সিনথিয়ার। বিয়ের পরই বেরিয়ে আসে রাশেদুলের আসল রূপ।
আশুলিয়া এলাকায় বাসা সিনথিয়ার। সাভারের একটি প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন। সিনথিয়া মানবজমিনকে বলেন, ‘বিসিএস রিটেন পরীক্ষা দিবো, আমি টিউশনি করে মাসে ৪০-৫০ হাজার টাকা ইনকাম করি, আমার অনলাইন ব্যবসা রয়েছে, ‘সারা জীবন তোমাকে সুখে রাখবো’Ñ এ রকম নানান মোহনীয় কথা বলে আমাকে ও আমার পরিবারকে রাজি করে রাশেদুল। আমাদের চেয়েও তার আর্থিক অবস্থা খারাপ জেনেও রাশেদুলের অত্যধিক আগ্রহ দেখে আমার বাবা বিয়েতে রাজি হয়। বিয়ের পর আমার পরিবার সংসারে যাবতীয় জিনিসপত্রের খরচ বহন করতো। কিন্তু বিয়ের দুইমাস না পেরুতেই তার আসল রূপ বেরিয়ে আসে। ব্যবসার জন্য আমার পরিবারের কাছে টাকা চাওয়া শুরু করে। ফ্রিজ ও ব্যবসার জন্য আমার বাবার কাছ থেকে সে ২ লাখ টাকা নেয়। কথায় কথায় আমার গায়ে হাত তুলে। একবার তো মেরে আমাকে রক্তাক্ত পর্যন্ত করেছে। মারধর করে রুমে তালা মেরে দিয়ে রাখতো সে। অসুস্থ ও অনিচ্ছা সত্ত্বেও বারবার আমাকে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করতো। একসময় রান্নার জন্য বাজার সদাই করা বন্ধ করে দেয়। সে বাইরে গিয়ে খেয়ে আসতো। টানা কয়েকদিন না খেয়ে ছিলাম। একপর্যায়ে সহ্য করতে না পেরে পরিবারের কাছে চলে যাই। তখন জানতে পারি তার আগে দুইটি বিয়ে হয়েছিল। তখন আমি ২০২২ সালের ১৮ই আগস্ট তালাক নিই।’
এদিকে টিউশন পড়ানো আরও দুই ছাত্রীকে বিয়ে করেছে রাশেদুল। ২০২০ সালে ৭ই নভেম্বর একটি, অন্যটি ২০২১ সালে। করোনাকালীন সময়ে বিশ^বিদ্যালয়ের পাশর্^বর্তী ইসলামনগর কাজী অফিসে বিয়ে হয় তাদের। ২০২০ সালের বিয়েতে উপস্থিত বিশ^বিদ্যালয়ের ৪৭ ব্যাচের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘মেয়েটি আমার ফ্ল্যাটে থাকতো। বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য রাশেদুলের কাছে টিউশন পড়তো। বাড়ি সিরাজগঞ্জ। মেয়ের বয়স আঠারো এর নিচে হওয়ায় আমি মেয়েকে ও মেয়ের নিকটাত্মীয়কে বারবার বুঝিয়েছি। কিন্তু রাশেদুলের কথার জালে জড়িয়ে পড়ে মেয়েটি। তারপর তাদের ইসলামনগরে বিয়ে হয়। রাশেদুল তো ১০১ টাকা দেনমোহরে বিয়ে করবে। পরে আমাদের জোরাজুরিতে এক লাখ টাকা কাবিন হয়। ৬ মাস পর আরেক মেয়ের সঙ্গে দেখি। শুনি তাদের তালাক হয়ে গেছে।’
এদিকে টিউশনির নামে বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছুদের জিম্মি করে টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। অগ্রিম টাকা নিয়ে সপ্তাহে একদিন-দুইদিন পড়িয়ে সময় কাটানোর অভিযোগ তুলেছেন শিক্ষার্থীরা। জাবি’র ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থী নাসিম খান জানান, ‘কোচিংয়ের নামে পোলাপানরে জিম্মি করে টাকা নেয়া তার বহু পুরনো পেশা। আমার স্কুলের কিছু জুনিয়রের কাছ থেকে কোচিং-এর নামে জিম্মি করে টাকা নিয়েছে এবং শেষমেশ কোনো জিনিসপত্র না নিয়ে পোলাপানগুলা আমবাগান (বিশ^বিদ্যালয়ের পার্শ^বর্তী এলাকা) থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। ওদের মধ্যে একজন ভয়ে ভর্তি পরীক্ষাই দিতে আসেনি। আর বাকি ভর্তিচ্ছুদের গার্ডিয়ান আমার কথায় পরীক্ষা দিতে পাঠিয়েছিলো। সে একটা বড় মাপের ধান্দাবাজ।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ^বিদ্যালয়ে একাধিক নারীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন রাশেদুল। করেছেন রাস্তাঘাটে যৌন হেনস্তা। একাধিক মেয়েকে পাঠিয়েছে নিজের অশ্লীল ছবি। যার ডকুমেন্ট প্রতিনিধির কাছে এসেছে। প্রতারণার ঘটনা প্রকাশিত হলে জাবি’র মীর মশাররফ হোসেন হল থেকে রাশেদুলকে মেরে বের করে দেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা জানান, এ রকম একজন প্রতারকের জায়গা এই হলে হবে না।
বর্তমানে রাশেদুল রয়েছেন নিজ গ্রামে। একাধিক নম্বরে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে পরিবারের লোকজনের মাধ্যমে দুইদিন ধরে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। বড়বোন জানান, ‘আমরা রাশেদুলের বিয়ের বিষয়ে কিছু জানি না। এ বিষয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসান বলেন, ‘আমাদের যৌন নিপীড়ক সেল রয়েছে। ভুক্তোভোগী শিক্ষার্থী যদি অভিযোগ করেন, তাহলে প্রমাণ সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’