মত-মতান্তর
আইন, অধিকার, গণতন্ত্র
ড. মাহফুজ পারভেজ
(১ বছর আগে) ২০ এপ্রিল ২০২২, বুধবার, ১:৪৩ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১:৫৬ অপরাহ্ন
ব্যক্তিগত ও সমষ্টিকরণ স্তরে আইনের বিস্তৃত পরিধি ও অধিকারের পরিসরের দিকে না তাকিয়ে সাধারণত আইন বলতে আমজনতার চোখে মামলা-মোকাদ্দমার এক দীর্ঘ, জটিল ও কষ্টকর প্রক্রিয়া ফুটে ওঠে। ‘ঘরে মামলা লাগা’ এক অভিশাপ বলেই সকল সমাজেই চিরকাল পরিচিত। কিন্তু ব্যক্তির অধিকারসহ উন্নয়নশীল বহুত্ববাদী কল্যাণকামী রাষ্ট্রে আইন আধুনিক, নিয়মতান্ত্রিক সমাজ গঠনে, শান্তি প্রতিষ্ঠায়, নাগরিক সুরক্ষায়, গণতান্ত্রিক গতিশীলতায় এবং অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধিতে বহুমাত্রিক মঙ্গলময় অবদান রাখে। আর যেকোনও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই সংবিধান হলো সর্বোচ্চ আইন।
বিশেষত, একবিংশ শতকে উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ ও বিশ্বায়নের হাত ধরে যে নয়া অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু হয়েছে, তার লক্ষ্য হল এক আত্মনির্ভর, ন্যায্য এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সক্ষম অর্থনীতি সৃষ্টি করা এবং অংশগ্রহণমূলক, কল্যাণকামী, বহুত্ববাদী রাজনীতির বিকাশ ঘটানো। সমসাময়িককালের সংবিধানের আলোকে প্রণীত আইন সেজন্য সর্বার্থে আধুনিক সমাজ, রাজনীতি, নাগরিকতা ও অর্থনীতি সৃষ্টির এক অমিত ক্ষমতাশালী মাধ্যম।
আইনের বিস্তৃত পরিধি ও পরিসরের মধ্যে ব্যক্তির সুরক্ষা ও অধিকারের স্বীকৃতি যেমন রয়েছে, তেমনিভাবে শ্রম, শিল্প, বাজার সংক্রান্ত ক্রমবর্ধমান জটিলতার পরিবর্তে সমঝোতার ব্যবস্থাও রয়েছ। এমনকি, চিকিৎসক, সাংবাদিক, শিক্ষক, আইনজীবী ও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট প্রভৃতি পেশার মানুষের অধিকার এবং কাজের স্বাধীন পরিধি সম্পর্কের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। যেমন রয়েছে, চিকিৎসার্থী রোগি, ভোক্তা, ক্রেতার অধিকারের বর্ণনাও। শুধু তাই নয়, যেকোনও আধুনিক-গণতান্ত্রিক দেশের আইন নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষের অধিকার যেমন বৃদ্ধি করে, তেমনিভাবে বহু ক্ষেত্রে অধিকারের অপব্যবহারকেও রোধ করে।
ফলে মনুষ্যসুলভ ভুলভ্রান্তি আইনগতভাবে প্রতিবিধান করতে ও সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনের বিভিন্ন বিধি, সংবিধি, অধ্যাদেশ গৃহীত হয়।
যার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ, কোম্পানি অ্যাক্ট, মেডিকেল বা বার কাউন্সিল ইত্যাদি কাজ করে।
পাশাপাশি, নানা ধরনের সামাজিক সমস্যার সমাধানেও বিভিন্নভাবে আইনগত প্রটেকশন দেওয়া হয়। যেমন শিশুশ্রমিক, বিচারাধীন বন্দি ও আগাম জামিনের ক্ষেত্রে মানবিকতা, নাগরিকত্ব, বহুত্ববাদী সমাজে বিবাহ, যৌতুক, এডিস সমস্যা, মাদক, অস্ত্র, সন্ত্রাস, নির্যাতন, পরিবেশ রক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে আইনি ভূমিকা সুস্পষ্ট। বিশেষত, নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী, প্রান্তিক ও দুর্বল জনগোষ্ঠীকে আইনের আওতায় নানাবিক সুবিধা দেওয়া মানবিক দিক থেকেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
আইনের দার্শনিক মর্মবাণী হলো ন্যায্যতা ও ন্যায়বিচার।
গণতন্ত্র ও আইনের শাসন একচেটিয়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্বের পরিবর্তে সকলের জন্য সমান ও পক্ষপাতহীন অধিকারযুক্ত পরিবেশের পক্ষে। এর ব্যতয় হলে আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের স্খলন ঘটে। যে কারণে বিশ্বব্যাপী ঐতিহাসিকভাবেই আইনের শাসন, নাগরিক অধিকার ও গণতন্ত্রের দাবিতে সংগ্রাম হয়েছে সমান তালে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো সেসব পর্যায় অতিক্রম করেই প্রাতিষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক কাঠামোর দেখা পেয়েছে। আইনের শাসন সমুন্নত করেছে। ব্যক্তি স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার সুনিশ্চিত করেছে।
কিন্তু উন্নয়নকামী সমাজের পশ্চাৎপদ পরিস্থিতিতে আইনের শাসন, নাগরিক অধিকার ও গণতন্ত্রের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ ত্রিভুজ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রচিত হয় না। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায় এমন অ-সুখকর দৃষ্টান্ত অসংখ্য। ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দল, দর্শনকে একচেটিয়াভাবে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আইনের শাসন, নাগরিক অধিকার ও গণতন্ত্রের ক্ষতিও হয় সেসব দেশে। যার প্রতিক্রিয়ায় লঙ্ঘিত হয় ব্যক্তির মানবাধিকার, আইনগত অধিকার ও গণতান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা। বৃদ্ধি পায় দলন, পীড়ন, সন্ত্রাস এবং প্রতিসন্ত্রাস।
এমন অ-কাম্য ও অ-গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ববিশ্রুত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও পণ্ডিতগণ পর্যন্ত উদ্বিগ্ন। তাদের প্রেসক্রিপশন একটাই। আর তা প্রধানত আইনের বিস্তৃত পরিধি ও পরিসরের মধ্যে ব্যক্তির সুরক্ষা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের স্বীকৃতির মধ্যে নিহিত।