ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

দেশ বিদেশ

রুবিনার জন্য শোক

হাসনাত মাহমুদ
৪ ডিসেম্বর ২০২২, রবিবার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্মান্তিক ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে সারা দেশের মানুষকে। স্তব্ধ, বিস্মিত, ব্যথিত, ক্ষুব্ধ দেশবাসীর প্রশ্ন- এতটা পৈশাচিকতাও মানুষের পক্ষে দেখানো সম্ভব? শুক্রবার বিকালে রাজধানী’র শাহবাগে গাড়িচাপায় এক নারী প্রাণ হারিয়েছেন। আর পাঁচটা সাধারণ সড়ক দুর্ঘটনা থেকে এটা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। যার সম্পূর্ণ বিবরণ শুনে কোনো শক্ত হৃদয়ের মানুষের পক্ষেও আবেগ সামলানো খুব কঠিন হয়েছে। 
ওইদিন ভগ্নিপতির মোটরসাইকেলে করে হাজারীবাগ যাচ্ছিলেন রুবিনা আক্তার (৪৫)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে যাওয়ামাত্র একটি প্রাইভেটকার তাদের মোটরসাইকেলকে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে ছিটকে ওই গাড়ির সামনে পড়ে যান রুবিনা। তার ওড়না গাড়ির চাকার সাথে পেঁচিয়ে যায়। তবে গাড়িচালক এই ভুলের পরও গাড়ি থামাননি। উল্টো গতি বাড়িয়ে গাড়ি টেনে নেন বেপরোয়াভাবে। চাকায় আটকেপড়া রুবিনাকে নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, ভিসি চত্বর মোড় হয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে নীলক্ষেতে গিয়ে থামেন তিনি।

বিজ্ঞাপন
এ সময় অসংখ্য মানুষের চিৎকার, আহাজারি, গাড়ি থামানোর অনুনয়ে কর্ণপাত করেননি গাড়িচালক। পুরো রাস্তাজুড়ে ওই নারীর রক্ত, শরীরের বিভিন্ন অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে প্রাণ হারান দুর্ভাগা রুবিনা আক্তার।
ঘাতক গাড়িচালককে জনগণের রোষানল থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। সেখানে তার প্রকৃত পরিচয় পাওয়ার পর সবার মধ্যে দেখা দেয় বিষ্ময়। তিনি কোনোরকম অষ্টম শ্রেণি পাস লাইসেন্সহীন অনভিজ্ঞ গাড়িচালক নন। জাফর শাহ নামে এক উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন গাড়ির চালকের আসনে। পেশাগত জীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন। সবার প্রশ্ন একজন মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকের পক্ষে এতটা অমানবিকতা দেখানো কীভাবে সম্ভব? জাফর শাহদের মতো আদর্শচ্যুত, নীতিহীন শিক্ষকের পক্ষে এসব সম্ভব।
সত্তরের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন জাফর শাহ। শুরু থেকে তার পাঠদানের পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি ছিল শিক্ষার্থীদের। সেই সময়ের একাধিক শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি ক্লাসে কোনো ধরনের প্রশ্ন করা পছন্দ করতেন না। কোনো বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করতে গেলেই শিক্ষার্থীদের দিতেন হুমকি। যত ভালোই লিখুক না কেন পরীক্ষার খাতায় দিতেন শূন্য। অভিযোগ আছে, সুন্দরী শিক্ষার্থীদের প্রতি তার ছিল কুদৃষ্টি। তাদের একাডেমিক সুবিধা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে দিতেন ঘনিষ্ঠ হওয়ার প্রস্তাব। রগচটা বদমেজাজি হিসেবেও জাফর শাহের কুখ্যাতি ছিল। তুচ্ছ বিষয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে করতেন চরম দুর্ব্যবহার। নবাগত প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা শুরুতেই  তার এমন আচরণ দেখে হতাশ হয়ে পড়তেন তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন নিয়ে। জাফর শাহের কোনো ধরনের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তার অন্যায় অনিয়মের বিষয়ে প্রথমদিকে কেউ ভয়ে মুখ খুলতেন না। দীর্ঘদিন ধরে এভাবে চলতে চলতে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন জাফর শাহ। শিক্ষা কার্যক্রমে অনুপস্থিত থাকা, রিসার্চ পেপার জমা না দেয়ায় একসময় তাকে সহযোগী অধ্যাপক থেকে পদাবনতি দিয়ে সহকারী অধ্যাপক করা হয়।
বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০০২-০৩ সালের দিকে তার বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনজনিত মারাত্মক অভিযোগ আনেন সেই সময়কার শিক্ষার্থীরা। বিভাগীয় কর্তৃপক্ষকে তারা জানান, জাফর শাহ একই বর্ষের অন্তত ৮৫ জন শিক্ষার্থীকে সব উত্তর লেখার পরেও বিনা কারণে পরীক্ষার খাতায় শূন্য নম্বর দিয়েছেন। পরে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে বিভাগ কর্তৃক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিকে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি এই শিক্ষক। পরে ২০০৭ সালে একাডেমিক সকল কার্যক্রম থেকে তাকে অব্যাহতি দেয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ। এরপর বেতন উত্তোলন ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। পরে ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের এক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়।
এ ব্যাপারে তার সাবেক এক সহকর্মী মানবজমিনকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তার পাঠদান ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ছিল। এসব বিষয়ে তাকে দফায় দফায় আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হলেও তিনি ছিলেন নির্বিকার। বিভাগের সহকর্মীদের সাথে তার খুব একটা সুসম্পর্ক ছিল না। দীর্ঘ দশ বছর একাডেমিক কার্যক্রমের নিষ্ক্রিয় থাকার পর বিভাগের সুপারিশে তাকে চাকরিচ্যুত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
জাফর শাহের ব্যক্তিগত জীবনও ছিল  রহস্যঘেরা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়,  জাফর শাহের পরিবারে কেউ নেই। তার পিতা-মাতা মারা গেছেন অনেক আগেই। স্ত্রী তাকে ডিভোর্স দিয়েছেন প্রায় ৪০ বছর আগে। নেই কোনো সন্তান। আত্মীয়স্বজন বলতে আছে শুধু বাসার কাজের বুয়া, যিনি তাকে ৩ বেলা খাবার দিতেন ও বাসা পরিষ্কারের কাজ করতেন। তিনি খুব বেশি মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখতেন না। প্রতিবেশীদের সাথেও তার খুব একটা বোঝাপড়া ছিল না। এদিকে নীলক্ষেতে জনতার হাতে ধরা পড়ার পর জাফর শাহ নিজেও শিকার হয়েছেন গণপিটুনির। মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে এখন তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসারত।
মর্মান্তিক এ ঘটনার তদন্ত ও ঘাতকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে শুক্রবার রাত থেকেই ক্যাম্পাসে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করে সাধারণ শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। গতকাল দুপুরে নিরাপদ ক্যাম্পাস চেয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিভিন্ন দাবিসংবলিত প্ল্যাকার্ড হাতে অবস্থান নেন অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী। নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের ছাত্র রিফাত শাওন। তিনি চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের নেতৃত্বাধীন স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক।
মানববন্ধনে রিফাত শাওন বলেন, আমাদের একটাই দাবি, নিরাপদ ক্যাম্পাস চাই। শুক্রবার একজন এখানে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন, কালকে তো আমাদের কোনো সহপাঠী দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন। নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করতে হলে ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে বহিরাগত ও ভারী যান চলাচল বন্ধ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে জোর দাবি, তারা যেন এ বিষয়কে একটু ভালোভাবে দেখে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখা তাদের দায়িত্ব। প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ, দয়া করে একবার শিক্ষার্থীদের দিকে তাকান।
এদিকে ঘাতক চালক জাফর শাহের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। শুক্রবার গভীর রাতে রুবিনা আক্তারের ভাই জাকির হোসেন বাদী হয়ে সড়ক পরিবহন আইনে শাহবাগ থানায় মামলাটি করেছেন। এসআই (উপপরিদর্শক) শাহ আলম জানান, বেপরোয়াভাবে প্রাইভেটকার চালিয়ে রুবিনা আক্তারকে মেরে ফেলায় সড়ক পরিবহন আইনে মামলা করা হয়েছে।
 

দেশ বিদেশ থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

দেশ বিদেশ সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status