নির্বাচিত কলাম
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
মেসির অনন্ত ইচ্ছা কী পূরণ হবে
জাহিদ রহমান
২৯ নভেম্বর ২০২২, মঙ্গলবারফুটবলের এই জাদুকরকে ঘিরে এবারও বিশ্বকাপে নানান উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। চোখ এখন তার দিকেই। সত্যি এবার যদি সব বাধা পেরিয়ে মেসি আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ ফুটবলের শিরোপা মুঠোবন্দি করার অদম্য ক্ষমতা দেখাতে পারেন তাহলে সেটা ফুটবলে হবে এক নতুন ইতিহাস। সেটা করতে পারলে তিনি নানা রেকর্ডে ম্যারাডোনাকে ছাড়িয়ে যাবেন। আর সেটা করতে না পারলে দুঃসহ এক অতৃপ্তি নিয়েই তাকে বিশ্বকাপ আর বিশ্ব ফুটবলের মঞ্চ থেকে বিদায় নিতে হবে। তবে এইসব আলোচনা সামনে এগুবে, না এখানেই শেষ হবে- তা নির্ধারণ হবে ৩০শে নভেম্বর মধ্যরাতে। মেসির অনন্ত ইচ্ছার সমাপ্তি হতে পারে এই রাতেই। আর না হলে এগুতে পারবেন সামনে। কিন্তু প্রতিটি ধাপ ভীষণ ভীষণ কঠিন
গ্রুপ পর্বের খেলায় দ্বিতীয় ম্যাচে মেক্সিকোর সঙ্গে হেরে গেলে এই বিশ্বকাপকে বিদায় জানিয়ে চলে যেতে হতো আর্জেন্টিনাকে। কিন্তু না, আর্জেন্টিনা একটু ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
তবে এবারের বিশ্বকাপে পরপর দুই ম্যাচে দুটি গোল পেয়েছেন আর্জেন্টিনা দলের অধিনায়ক লিওনেল মেসি। বিশ্বকাপে তার গোল সংখ্যা ৮টি। কিন্তু এসব নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। সবার প্রশ্ন মেসি এই বিশ্বকাপে ট্রফি জেতার যে অনন্ত ইচ্ছা নিয়ে এসেছেন সেটা পূরণ হবে কিনা। মেসি ম্যারাডোনাকে ছুঁতে পারবেন কিনা।
কিন্তু পুরো বিষয়টিই অনিশ্চিত। সামনে পোল্যান্ডের সঙ্গে কী হয় সেটি এখন বড় বিষয়। পোল্যান্ডের সঙ্গে আর্জেন্টিনা হেরে গেলে মেসিকে আর কাতারে দেখা যাবে না। এখানেই শেষ নয়, কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলের পর লিওনেল মেসিকে বিশ্বকাপ মঞ্চেও আর দেখা যাবে না। এটিই মেসির আসলে শেষ বিশ্বকাপ। মেসি নিজেও এমনটি প্রায়শই বলছেন। সম্প্রতি আর্জেন্টিনার স্পোর্টস রিপোর্টার ও টিভি প্রেজেন্টার সেবাইসটেন ভিগনিলোর কাছে দেয়া এক সাক্ষাৎকারেও বলেছেন এরপর আর কোনো বিশ্বকাপ খেলার তার ইচ্ছা নেই। এটিই তাই শেষ বিশ্বকাপ। আর এ কারণেই নিজের মাঝে অন্য এক ধরনের রোমাঞ্চও অনুভব করছেন তিনি। সঙ্গে বহুবিধ সংশয়ও তাকে তাড়া করছে। কেননা, এটিই তার জন্য শেষ সুযোগ।
মেসির অনন্ত ইচ্ছা বিশ্বকাপ ফুটবলের ট্রফি হাতে নিয়ে নিজ দেশ আর সমর্থকদের আনন্দের বন্যায় ভাসিয়ে দেবেন। আর সেই যে কিংবদন্তি ম্যারাডোনার নেতৃত্বে ’৮৬ বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফি জয়ের পর থেকে যে বদনাম মাথায় নিয়ে আর্জেন্টিনাকে চলতে হচ্ছে সেটাও মুছে ফেলবেন। দায় মিটিয়ে দেবেন কোটি কোটি সমর্থকের। কিন্তু চাইলেই তো সেটা হয় না। বিশ্বকাপ ফুটবলের শিরোপা জেতা চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু আর্জেন্টিনা দলে একজন মেসি আছে বলেই বারবার শত সম্ভাবনার কথা উচ্চারণ করেন বিশ্বের ফুটবল বোদ্ধাগণ। লিওনেল মেসির ফুটবল জীবনের প্রতিটি পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে রূপ ও রঙের অপূর্ব খেলা। ফুটবল মাঠে অনেকেই যা পারেননি, মেসি সেটা পেরেছেন। তার একক নৈপুণ্যের কাছে সবাই যেন ম্লান। কিন্তু আর্জেন্টিনার পক্ষে বিশ্বকাপ না জেতার আক্ষেপ আর অপূর্ণতাকে বাদ দিলে মেসি যেন সবই মুঠোবন্দি করতে সমর্থ হয়েছেন। একের পর এক কতো স্বীকৃতি আর রেকর্ড এখন তার দখলে! কিন্তু বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ডটাই কেবল অধরা।
বিশ্বকাপে আসার আগে মেসি বলেছিলেন, আর্জেন্টিনা দল এবার ভালো ছন্দে আছে। একটানা ৩৫ ম্যাচে দলটি অপরাজিত। বর্তমান সময়ে আবার আরও কিছু প্রতিভাবান ফুটবলারও যুক্ত হয়েছে দলে। কিন্তু বিশ্বকাপ এমন একটা মঞ্চ এখান থেকে ছিটকে যেতে সময় লাগে না। এ কারণেই মেসি বারবার স্মরণ করেন ২০১৪ সালের বিশ্বকাপের কথা। ফাইনালে শিরোপা জিততে জিততে হেরে গেল তার দেশ। সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাকে তাড়া করে। মেসি নিজেও জানেন সেবার আর্জেন্টিনা শিরোপা পেলে তার ফুটবল জীবনে অপূর্ণতা বলে কিছু থাকতো না। কিন্তু এখন বর্ণাঢ্য জীবন বিশ্বকাপ শিরোপাহীন থাকায় এক বিশাল অপরিপূর্ণতা রয়েছে। মেসি বুঝতে পারেন কিংবদন্তি ফুটবলার ম্যারাডোনার সঙ্গে মূল ফারাক বা ব্যবধান এখানেই। ম্যারাডোনা ১৯৮৬ সালের ২৬শে জুন মেক্সিকো সিটি রাঙিয়ে তুলেছিলেন নিজের পারফরমেন্স আর সফল নেতৃত্ব দিয়ে। সেদিন মেক্সিকোর এস্তাদিয়া এজটিকা স্টেডিয়ামে ১ লাখ ১৪ হাজার ৬ শ’ দর্শকের সামনে পশ্চিম জার্মানিকে ৩-২ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আর্জেন্টিনা। শুধু চ্যাম্পিয়ন বলে কথা নয়, এই বিশ্বকাপের মধ্যদিয়েই ম্যারাডোনা চোখ ধাঁধানো খেলা আর নেতৃত্ব দিয়ে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বের কোটি কোটি ফুটবলামোদীর হৃদয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। সেই থেকে আর্জেন্টিনা বলতে এখনো এক শ্রেণির সমর্থকেরা পাগল ও উন্মাদ। আর্জেন্টিনা ছাড়া তারা কিছুই বুঝেন না। কিন্তু এরপর থেকে আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা অতৃপ্তও।
’৮৬ বিশ্বকাপের পর আর্জেন্টিনা আর চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। যদিও পরের বারই একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ফাইনালে হারতে হয়েছিল জার্মানির কাছে। এরপর জার্মানি দু’বার (১৯৯০ ও ২০১৪), ব্রাজিল দু’বার (১৯৯৪ ও ২০০২), ফ্রান্স দু’বার (১৯৯৮ ও ২০১৮) এবং ইতালি (২০০৬) ও স্পেন (২০১০) একবার করে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হলেও আর্জেন্টিনা আর চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি।
এবারের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা পড়েছে গ্রুপ ‘সি’তে। এই গ্রুপের অন্যান্য দল হলো- সৌদি আরব, পোল্যান্ড এবং প্রতিবেশী মেক্সিকো। গ্রুপ পর্যায়ে এদের সঙ্গে লড়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে আসতে হবে মেসির আর্জেন্টিনাকে। ফুটবল বিশেষজ্ঞদের মতে গ্রুপ লড়াইটার মধ্যে এখন জটিল সমীকরণ বিদ্যমান। প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের কাছে আর্জেন্টিনা পরাজিত হওয়ার পর সমীকরণ আরও জটিল হয়েছে। গ্রুপ পর্বের দু’টি ম্যাচ খেলেছে আর্জেন্টিনা। ৩০শে নভেম্বর গ্রুপের শেষ ম্যাচ পোল্যান্ডের সঙ্গে। এই ম্যাচে জয়ী হলে দ্বিতীয় রাউন্ডে যাবে মেসির দল। এই ম্যাচের ফলাফলের আগে একটু প্রাক ফলাফল দেখা যাক। এ যাবৎ আর্জেন্টিনা এবং পোল্যান্ড মোট এগারো বার মুখোমুখি হয়েছে। এর মধ্যে ৮টিই ছিল প্রীতি ম্যাচ। আর্জেন্টিনা জয়ী হয়েছে ছয় বার। পোল্যান্ড জয়ী হয়েছে তিন বার। দু’বার ম্যাচ ড্র হয়েছে। এরমধ্যে বিশ্বকাপে এ দু’টি দল দু’বার মুখোমুখি হয়েছে। ’৭৪ সালের ১৫ই জুন বিশ্বকাপে পোল্যান্ডের সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি ম্যাচে হেরে যায় আর্জেন্টিনা। পোল্যাল্ড ৩-২ গোলে জয়লাভ করে। অবশ্য চার বছর পর প্রতিশোধ নেয় আর্জেন্টিনা। ’৭৮-এর ১৪ই জুন বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা পোল্যান্ডকে ২-০ গোলে পরাজিত করে। আসলে পরিসংখ্যান কিছুই না। যারা মাঠে খেলবে তারাই জয়ী হবে। এমনো হতে পারে পোল্যান্ড মেসির সব স্বপ্ন ঘুরিয়ে দিয়েছে। এমন এক দোলাচলে এখন লিওনেল মেসি।
আর্জেন্টিনার হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচে মেসির অভিষেক ঘটে ২০০৫ সালের ১৭ই আগস্ট হাঙ্গেরির বিপক্ষে। সে ম্যাচে ২-১ গোলে জয়লাভ করে আর্জেন্টিনা। তবে মেসির পা থেকে নিজ দলের পক্ষে গোল আসে আরও পরে। দেশের পক্ষে ৬ নম্বর ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে তিনি প্রথম গোল পান। ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে এই প্রীতি ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয় সুইজারল্যান্ডে। খেলায় আর্জেন্টিনা ৩-২ গোলের ব্যবধানে পরাজিত হলেও ১৯ নম্বর জার্সি গায়ে মেসি উদ্ভাসিত হন অন্যভাবে। তেভেজের দেয়া গোলে এসিস্ট করেন তিনি। এরপর দ্বিতীয় গোল করেন যথারীতি রাইট উইং থেকে বল নিয়ে ডি-বক্সের সামনে ঢুকে নিজস্ব স্টাইলে গোল করেন। এই যে শুরু আর থামেননি তিনি।
মেসি এ পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে মোট ৯২টি গোল করেছেন যা এখন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোল। তিনি মোট ম্যাচ খেলেছেন ১৬৬টি। বিশ্বকাপ ফুটবলে মেসি এ পর্যন্ত ৪ বার অংশ নিয়েছেন আর মোট ম্যাচ খেলেছেন ১৯টি। এই বিশ্বকাপের আগে তার পা থেকে দেশের পক্ষে গোল আসে মোট ৬টি। এবারের বিশ্বকাপে এ পর্যন্ত তিনি দু’টি গোল করেছেন। আর্জেন্টিনা দলের ক্যাপ্টেন হিসেবে তিনি প্রথম আবির্ভূত হন ২০১১ সালে কলকাতার মাঠে। কলকাতার সল্ট লেকে ভেনিজুয়েলার সঙ্গে একটি প্রদর্শনী ম্যাচ হয় আর্জেন্টিনার। সেই ম্যাচে নেতৃত্ব দেন মেসি। এখন পর্যন্ত তিনিই দলের মহানায়ক।
ফুটবলের এই জাদুকরকে ঘিরে এবারও বিশ্বকাপে নানান উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। চোখ এখন তার দিকেই। সত্যি এবার যদি সব বাধা পেরিয়ে মেসি আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ ফুটবলের শিরোপা মুঠোবন্দি করার অদম্য ক্ষমতা দেখাতে পারেন তাহলে সেটা ফুটবলে হবে এক নতুন ইতিহাস। সেটা করতে পারলে তিনি নানা রেকর্ডে ম্যারাডোনাকে ছাড়িয়ে যাবেন। আর সেটা করতে না পারলে দুঃসহ এক অতৃপ্তি নিয়েই তাকে বিশ্বকাপ আর বিশ্ব ফুটবলের মঞ্চ থেকে বিদায় নিতে হবে। তবে এইসব আলোচনা সামনে এগুবে, না এখানেই শেষ হবে- তা নির্ধারণ হবে ৩০শে নভেম্বর মধ্যরাতে। মেসির অনন্ত ইচ্ছার সমাপ্তি হতে পারে এই রাতেই। আর না হলে এগুতে পারবেন সামনে। কিন্তু প্রতিটি ধাপ ভীষণ ভীষণ কঠিন।